বাঙালি জাতির জীবনে আগস্ট মাস স্থায়ী কলঙ্কের মাস হিসেবে পরিগণিত হবে ইতিহাসের পাতায়। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করার ভেতর দিয়ে যে কৃষ্ণকাল নেমে এসেছিল এই ভূখণ্ডে, তা কখনো বিস্মৃত হবে না বাঙালি চিত্ত থেকে। এটা শুধু ব্যক্তি বা পরিবারের বিনাশ নয়, বাঙালি জাতির সুদীর্ঘকালের অর্জনকে ইতিহাসের পাতা থেকে নিশ্চিহ্ন করার সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র বললেও তা যথেষ্ট হবে না। একটি জাতিগোষ্ঠীর আবহমান কালের সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, আত্মপরিচয়ের সন্ধানের প্রয়াসকে নির্দয়ভাবে ধ্বংস করার হিংস্র কার্যক্রম চলেছিল ১৯৭৫ সালের এই মাসে। যদি পঁচাত্তরের আগস্ট মাস আমরা বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখব—এর দুটি অংশ। প্রথম অংশ আগস্টের সূচনা থেকে ১৫ তারিখ এবং দ্বিতীয় অংশ ১৫ আগস্ট থেকে একটা গোটা সময়, যা চলেছিল সুদীর্ঘ দুই দশকের অধিককাল পর্যন্ত। শুধু তাই নয়, বাঙালি জাতিকে এ অভিশাপ বহন করতে হবে আর কতকাল, কে জানে!
আগস্টের প্রথমাংশ ঘাতক ও দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীদের নৃশংস আয়োজনের প্রস্তুতি পট। এ সময়টায় তারা নিজেদের পরিকল্পনা সাজিয়েছে, প্রশাসনে গুপ্তচরদের দায়িত্ব বণ্টন করেছে, রাজনীতিতে ব্যাপক অদৃশ্য মুখোশ ছড়িয়ে দিয়েছে, বঙ্গবন্ধুর উদারতার রন্ধ্রপথে প্রবিষ্ট করেছে মৃত্যুবাণ। আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারী ব্যক্তিগুলোকে করেছে সংহত এবং নির্ধারিত সময়ে ইতিহাসের কলঙ্কজনক নৃশংসতা প্রদর্শন করে বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন রক্তরঞ্জিত করেছে।
আজ আমরা যদি ইতিহাসের কাঠগড়ায় আগস্ট মাসকে দাঁড় করাই, তাহলে দেখব—আরও শিহরন সৃষ্টিকারী পরিস্থিতির উদ্ভব। বাঙালি জাতিসত্তার স্থান দখল করল এক অদ্ভুত মিশ্রিত জাতিচিন্তা। ধর্মের নামে এমন এক কুসংস্কারের কৃষ্ণকায় নেকাবে জাতিকে জড়িয়ে দেওয়া হলো; যার ফলে বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় নিকষ কালো অন্ধকারের আবর্তে ক্রমশ নিমজ্জিত হতে থাকল। মূল্যবোধ ধীরে ধীরে অন্তর্হিত হলো। এভাবে ক্রমাগত ক্ষয় হতে শুরু করেছে বাঙালির সহস্র বৎসরের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য।
প্রতিবার আগস্ট মাস এলেই যেন সাময়িক উত্তেজনা নিয়ে আমরা স্মৃতির ভান্ডার সাজাই। মুখস্থ বাক্য চয়ন করে যে পুষ্পমাল্য রচনা করি, তাতে তো হৃদয়ের স্পর্শ থাকে না, বিশ্বাসের প্রকাশ থাকে না, চেতনার প্রতিফলন থাকে না—থাকে শুধু সংকীর্ণ আত্মপ্রচার। এটা তো প্রকারান্তরে আগস্টের ঘাতকদেরই জয়ধ্বনি হয়ে যায়।
আমরা কি শোককে শক্তিকে পরিণত করতে পেরেছি? আমরা কি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও স্বপ্ন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং অসাম্প্রদায়িক জাতি ও রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য যথাযথ ত্যাগ নিশ্চিত করতে পেরেছি? আমরা কি মানুষের অন্তরের মানুষটাকে জাগিয়ে তোলার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হতে পারছি?
যখন আমরা আত্মাকে অন্বেষণ করে এর উত্তর খুঁজে পাব, সেদিনই বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুকে আমরা খুঁজে পাব।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, দৈনিক কালবেলা
মন্তব্য করুন