মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
শাহনেওয়াজ খান সুমন
প্রকাশ : ০১ আগস্ট ২০২৩, ০২:২২ এএম
আপডেট : ০১ আগস্ট ২০২৩, ০৮:২০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বস্তি উন্নয়নের টাকায় ডিএনসিসির পিকনিক

বিশিষ্টজন বলছেন দুঃখজনক
বস্তি উন্নয়নের টাকায় ডিএনসিসির পিকনিক

চলতি বছরের শুরুতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র, কাউন্সিলর, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা সপরিবারে মুন্সীগঞ্জে বার্ষিক বনভোজনে যান। ৬ ও ৭ জানুয়ারি দুদিনের জন্য সিরাজদীখানের ঢালিস আম্বার নিবাস রিসোর্ট ভাড়া নিয়ে সেখানে অবস্থান করেন তারা। যাতায়াতের জন্য নেওয়া হয় বিশেষ এসি বাস। সন্ধ্যায় আয়োজন করা হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এই আয়োজনে অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে নেওয়া হয়নি কোনো ফি। ওই বনভোজনের মধ্যেই প্রথা ভেঙে প্রথমবার ঢাকার বাইরে অনুষ্ঠিত হয় ডিএনসিসির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী বোর্ড সভা। বনভোজন ও বোর্ড সভার জন্য ৬৪ লাখ ৮১ হাজার ২৬৫ টাকা খরচ করা হয় সিটি করপোরেশনের তহবিল থেকে। বিনোদনমূলক এই ব্যয়ের পুরোটাই দেখানো হয়েছে সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন খাতে।

ডিএনসিসির ওই বোর্ড সভায় সভাপতিত্ব করেন মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। ডিএনসিসির সচিব মোহাম্মদ মাসুদ আলম ছিদ্দিকের সঞ্চালনায় সভায় উপস্থিত ছিলেন ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা, প্রধান প্রকৌশলী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহম্মদ আমিরুল ইসলাম, প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কমডোর এস এম শরিফ-উল ইসলামসহ সব বিভাগীয় প্রধান এবং ডিএনসিসির কাউন্সিলররা।

ওই সভায় অংশ নেওয়া ডিএনসিসির ১৭ নম্বর সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জাকিয়া সুলতানা বলেন, ‘১৯তম করপোরেশন সভা ঢালিস আম্বার নিবাস রিসোর্টে অনুষ্ঠিত হয়। সব কাউন্সিলর উপস্থিত ছিলেন।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ডিএনসিসির ২১তম করপোরেশন সভায় সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়নের নামে গত বছরের ১৫ আগস্ট থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত মোট ২ কোটি ৬৪ লাখ ৩৯ হাজার ২২৬ টাকা ব্যয় অনুমোদন করা হয়। যেসব কাজে বিপুল পরিমাণ এই টাকা ব্যয় করা হয়েছে, তার বেশিরভাগের সঙ্গেই সমাজের কল্যাণ কিংবা বস্তি উন্নয়নের সম্পর্ক নেই।

বোর্ড সভায় উপস্থাপন করা নথিপত্র বলছে, ডিএনসিসির সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন খাতে দেখানো ব্যয়ের মধ্যে রয়েছে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে প্যান্ডেল, গেট, লাইট ইত্যাদি বাবদ ৪৯ লাখ ১১ হাজার ৬৮০ টাকা, শেখ রাসেল দিবস ও জেলহত্যা দিবস নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন দিনের আয়োজন বাবদ ৯ লাখ ৯৬ হাজার করে মোট ১৯ লাখ ৯২ হাজার টাকা, ডিএনসিসির উন্নয়ন কার্যক্রম বিষয়ে বিদেশি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে

আলোচনা বাবদ ৪৮ লাখ ২২ হাজার টাকা, মেট্রোরেল উদ্বোধন অনুষ্ঠান উপলক্ষে ডিএনসিসির এরিয়া ব্র্যান্ডিং সংক্রান্ত কাজে ৪১ লাখ ২১ হাজার ৬০০ টাকা, কর্মকর্তা ও কাউন্সিলরদের বার্ষিক বনভোজন এবং দ্বিতীয় পরিষদের ১৯তম করপোরেশন সভা বাবদ ৬৪ লাখ ৮১ হাজার ২৬৫ টাকা এবং মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান বাবদ ৪০ লাখ ৩০ হাজার ৬৮১ টাকা।

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও বস্তি এলাকার অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে ডিএনসিসি। তবে এই বিভাগের কাজের তেমন কোনো তৎপরতা চোখে পড়ে না। গরিব ও অসহায় মানুষের নামে অর্থ খরচ হলেও সুফল বস্তিবাসী পান না।

ডিএনসিসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন বিভাগ তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য প্রকল্প এবং কার্যক্রম নিচ্ছে না। এমনকি তারা জানেও না উত্তর সিটিতে কয়টি বস্তি আছে। ফলে এ বিভাগের নামে তেমন বরাদ্দও থাকে না। তাই অন্য খাতে খরচ করে এ বিভাগের নামে দেখানো হয়।

সম্প্রতি নগর ভবনের বস্তি উন্নয়ন বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, বিভাগটি যতটা গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক ততটাই অবহেলিত। এ বিভাগের একমাত্র কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবির খানের কাছে ডিএনসিসি এলাকায় কতটি বস্তি রয়েছে জানতে চাইলে তিনি তা জানাতে পারেননি। বস্তি উন্নয়ন নিয়ে জানতে চাইলে হুমায়ুন কবির খান বলেন, ‘বস্তি উন্নয়ন বিভাগের কাজ মূলত এনজিওগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করা। আমাদের বেশিরভাগ কাজ এনজিওর সঙ্গে। সিটি করপোরেশনের সঙ্গে এনজিওগুলোর বিভিন্ন মেয়াদে চুক্তি থাকে। যেমন ইউএনডিপির সঙ্গে চুক্তি ছিল। সর্বশেষ দেড় বছর চুক্তির মেয়াদ বেড়েছে। ২০২৪ সাল পর্যন্ত এই চুক্তি থাকবে।’

এনজিওর সঙ্গে সমন্বয় ছাড়া সিটি করপোরেশন আর কী কাজ করে—এমন প্রশ্নের উত্তরে হুমায়ুন কবির খান বলেন, ‘করপোরেশন দুর্যোগের সময় কাজ করে। বস্তি পুড়ে গেলে, ভেঙে গেলে মেয়রের ঐচ্ছিক যে তহবিল রয়েছে, সেখান থেকে সহযোগিতা করা হয়। প্রাথমিক খাবারের ব্যবস্থা ও অনুদান দেওয়া হয়। পুড়ে গেলে প্রতি পরিবারকে ৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। বস্তি উন্নয়নে যে বাজেট দেওয়া হয় সে অর্থ বস্তির অন্যান্য উন্নয়নে খরচ করা হয়।’

বনভোজন, বিভিন্ন দিবসের প্যান্ডেল-গেট সাজানোর নামে ব্যয়ের টাকা সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়নের নামে দেখানোর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে প্রধান সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মামুন-উল-হাসান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এ বিষয়ে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা বলেন, ‘যে কোনো আয়োজনে নানা কারণে খরচ হয়ে থাকে। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে এর এখতিয়ার মেয়রের আছে। সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়নের টাকা শুধু বস্তি উন্নয়নে খরচ হবে, বিষয়টি এমন নয়। অনেক সময় আমাদের রাতারাতি তিনগুণ, চারগুণ টাকা দিয়ে প্যান্ডেল করতে হয়। তখন টাকার দিকে তাকানোর কোনো সুযোগ থাকে না।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষক এবং নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আকতার মাহমুদ খান বলেন, ‘বাজেটের এক খাতের টাকা অন্য খাতে দেখানো আর্থিক অনিয়মের মধ্যেই পড়ে। সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়নের নামে সিটি করপোরেশনের যে বাজেট, তার মধ্যে একটি বরাদ্দ থাকার কথা। এই বিভাগের টাকা অন্য কোনো জায়গায়, অন্য কোনো নামে ব্যয় দেখানোর চেষ্টা করা খুবই অপ্রত্যাশিত। এটি খুবই দুঃখজনক। অথচ বস্তিবাসীর সরাসরি ভোটে মেয়র নির্বাচিত হন।’

তিনি বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের জমিতে কোনো বস্তি নেই; ব্যক্তি মালিকানাধীন স্থানে গড়ে ওঠা বস্তিতে চাইলেই কিছু করা যায় না—এগুলো বলা দায় এড়ানো ছাড়া কিছুই নয়। অন্য সংস্থার যেসব জায়গায় বস্তি আছে, সেগুলো সরকারি জায়গা। যেখানে নাগরিকদের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ছাড়াও বহু কাজের সুযোগ আছে। যা করতে কোনো বাধা নেই। ব্যক্তি মালিকানাধীন বস্তিতে অবকাঠামো, নাগরিকসেবা না দিলেও স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা—এগুলো দিতে তো বাধা নেই।’

ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘স্থানীয় সরকার আইনে বলা আছে, বস্তি উন্নয়নে সিটি করপোরেশন যে কোনো ধরনের উন্নয়ন কাজ করতে পারে। এখন সিটি করপোরেশন এলাকায় যে বস্তিটি পড়ে সেটি ব্যক্তি মালিকানাধীন হোক বা খাসজমিতে হোক, সিটি করপোরেশন কাজ করবে। যে কোনো বস্তির উন্নয়নের এখতিয়ার সিটি করপোরেশনকে দেওয়া আছে। শুধু আগুন লাগলেই যে ব্যবস্থা নিতে হবে, এমন নয়। বস্তিবাসীদের জন্য যে কোনো উন্নয়ন করা সিটি করপোরেশনেরই দায়িত্ব। এটি বলার সুযোগ নেই, খাসজমি বা ব্যক্তি মালিকানা জমিতে উন্নয়ন করা যাবে না।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘অধিকারের জায়গা থেকে একজন মানুষ হোক আর দুই কোটি মানুষ হোক, বস্তিবাসীর জীবনমান উন্নয়নে উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারি এমন কয়েকটি উদ্যোগ আছে, তবে তা আকারে অপ্রতুল।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মোংলায় নারীকে কুপিয়ে হত্যা, যুবকের বিরুদ্ধে অভিযোগ 

নাগরিক কমিটিতে সারজিস-তুহিনসহ যুক্ত হলো ৪৫ জন

বিয়েতে গান বাজিয়ে শাস্তির মুখে বর

নরসিংদীতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল দুই বন্ধুর

প্রেমের বিয়ের বিপক্ষে পাকিস্তানের বেশিরভাগ মানুষ

সিলেটে হত্যা মামলায় বাবাসহ দুই ছেলের মৃত্যুদণ্ড

বিএনপি ক্ষমতায় এলে ক্রীড়াঙ্গনে রাজনীতিকরণ হবে না : আমিনুল হক 

আইইউবিএটির ইইই অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের কমিটি ঘোষণা

জেতার সুযোগ সিলেটের, শঙ্কায় চট্টগ্রাম

চিন্ময়কে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে রংপুরে বিক্ষোভ

১০

টাস্কফোর্সসহ ভোক্তা অধিকারের বাজার তদারকি

১১

ছেলেদের সমান সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন জ্যোতিরা : হাবিবুল বাশার

১২

হজ এজেন্সিগুলোকে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা 

১৩

চিন্ময়ের মুক্তির দাবিতে লক্ষ্মীপুরে মিছিল

১৪

শাহবাগ থেকে ফিরেই ঋণের লোভ দেখানো সংগঠকের বাড়ি ঘেরাও

১৫

‘আব্দুর রাজ্জাক সাধারণ চালচলনের এক অসাধারণ মানুষ ছিলেন’

১৬

ডিজিটাল নিরাপত্তা এবং জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রচারণা 

১৭

চিন্ময়কে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে খুলনায় বিক্ষোভ

১৮

গর্ভধারণের নামে ভয়ঙ্কর প্রতারণার খেলা

১৯

সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে সহিংসতা প্রতিরোধ নিশ্চিত করার আহ্বান

২০
X