বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে নিজেই কথা রাখেননি সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। প্রতিমন্ত্রীর এমন নজিরে পিছিয়ে ছিলেন না আমলারাও। মন্ত্রণালয় এবং এর অধীন দপ্তর, সংস্থা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা যে যেভাবে পেরেছেন, করেছেন বিদেশ সফর। নিজের একান্ত সচিব এবং ব্যক্তিগত কর্মকর্তাকেও (পিও) বিদেশ সফর করিয়েছেন পলক। কখনো সরকারের কখনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে বিদেশ সফর করেছেন এসব কর্মকর্তা। মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শুধু সাত মাসের দায়িত্বকালেই নিজেসহ অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা বিদেশ সফর করেন। গত ৭ জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচনের পর গঠিত সরকারে টানা তৃতীয়বারের মতো প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছিলেন জুনাইদ আহমেদ পলক। ১১ জানুয়ারি ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন তিনি। এর তিন দিন পর আইসিটি বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে ওই বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদেশ সফর না করার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন তিনি, যা বলবৎ ছিল গত জুন পর্যন্ত। এমনকি উল্লিখিত সময়ে তিনি নিজে এবং আইসিটি বিভাগের সচিবও বিদেশ সফর করবেন না বলে ঘোষণা ছিল তার। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে আইসিটি টাওয়ারে অনুষ্ঠিত ওই সভায় পলক বলেন, আমাদের রপ্তানি উপার্জন বাড়াতে হবে। রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করতে হবে। এর মধ্যে প্রথম পদক্ষেপ যেটি আমার হাতের আছে, আগামী ছয় মাস (জানুয়ারি-জুন) আমি বিদেশে যাব না, সচিব যাবেন না। আইসিটি বিভাগের কেউ বিদেশ সফরে যাবে না। কোনো প্রশিক্ষণে না, কোনো শিক্ষা সফরে না। আমরা আগামী ছয় মাসের জন্য সম্পূর্ণভাবে বিদেশ সফর বন্ধ করে দিলাম।
তবে মুখে বলা এসব কথার প্রয়োগ বাস্তবে দেখা যায়নি। বিদেশ সফরে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন তিনি। গত এপ্রিলে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ওরাকলের এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সিঙ্গাপুর ভ্রমণ করেন তিনি। তার ওই ভ্রমণের খরচ বহন করে আইসিটি বিভাগের আওতাধীন বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) একটি প্রকল্প। গত জুনে ফ্রান্সে প্রযুক্তিবিষয়ক একটি অনুষ্ঠানেও অংশ নেন তিনি। পলকের আশীর্বাদে মন্ত্রণালয়ের সচিব থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত কর্মকর্তা পর্যন্ত পর্যায়ের আমলারাও বিদেশ সফরের সুযোগ পেয়েছেন। ২৬ থেকে ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ‘মোবাইল ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস-২০২৪’-এ অংশ নিতে স্পেনের বার্সালোনা সফর করেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান এবং যুগ্ম সচিব তৈবুর রহমান। একই অনুষ্ঠানের জন্য ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ২ মার্চ পর্যন্ত স্পেন সফর করেন বিটিআরসির সদ্য পদত্যাগ করা চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মহিউদ্দিন আহমেদ। তার সফরসঙ্গী ছিলেন বিটিআরসির আরও দুই কর্মকর্তা।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের ওয়েবসাইট সূত্রে জানা যায়, ‘সি মি উই ৬ কনসোর্টিয়াম মেম্বার অরেঞ্জ’ আয়োজিত ক্রয় গ্রুপ, চুক্তি সমন্বয় সভা এবং ব্যবস্থাপনা সভায় অংশ নিতে ফ্রান্স সফর করেন বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবলস পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি ও সি-মি-উই ৬ প্রকল্পের পরিচালক মির্জা কামাল আহমেদ। তার সফরসঙ্গী ছিলেন প্রতিমন্ত্রী পলকের ব্যক্তিগত সচিব মুশফিকুর রহমান। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি তাদের সফরের অনুমতি দিয়ে সরকারি আদেশ জারি হলেও সেই আদেশে সফরকালের তারিখ উল্লেখ নেই।
গত ৭ ফেব্রুয়ারি ডাক অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সাদিয়া আফরিন বৃষ্টিকে প্রতিবেশী একটি দেশে সফরের অনুমতি দিয়ে আদেশ জারি করে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ। ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মার্চ পর্যন্ত আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেন তিনি, যার ব্যয় বহন করে ওই অনুষ্ঠানের আয়োজক।
পোস্ট মাস্টার জেনারেল কার্যালয়ের সহকারী পোস্ট মাস্টার জেনারেল (স্টাফ) নাইমুর রহমান ২৯ জানুয়ারি থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত থাইল্যান্ডে একটি কোর্সে অংশ নেন। ‘ব্যবসা উন্নয়ন এবং বিপণন কোর্স’ শীর্ষক ওই প্রশিক্ষণের খরচ বহন করার কথা রয়েছে আয়োজকদের। তবে ১ জানুয়ারি জারি করা সরকারি আদেশে ‘আয়োজক’ সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই।
বিদেশ সফরে পিছিয়ে নেই বিটিআরসির কর্মকর্তারাও। ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ‘আইএসএস ওয়ার্ল্ড (ইন্টেলিজেন্স সাপোর্ট সিস্টেমস ফর ইলেকট্রনিক সার্ভেল্যান্স, সোশ্যাল মিডিয়া/ডার্ক ওয়েব অ্যান্ড সাইবার ক্রাইম ইনভেসটিগেশন’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই সফর করেন কমিশনের উপপরিচালক (এসএস) এস এম তাইফুর রহমান। বিদেশ সফরের সরকারি আদেশ বলছে, এই সফরের খরচ বহন করে ‘স্পাইডার ডিজিটাল ইনোভেশন এফজেড এলএলসি’।
৪ মার্চ থেকে ৮ মার্চ পর্যন্ত থাইল্যান্ডের পাতায় ‘এপিটি ওয়্যারলেস গ্রুপ’র ৩২তম সভায় অংশ নিতে অনুমতি পেয়েছেন কমিশনের আরেক উপপরিচালক (এসএম) মাহফুজুল আলম। বলা হয়, এই সফরের খরচ বহন করবে এশিয়া প্যাসিফিক টেলিকমিউনিটি। অন্যদিকে, ৫ থেকে ৮ মার্চ সিঙ্গাপুরের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি কেন্দ্র সফরের অনুমতি পেয়েছেন বিটিআরসির সিস্টেম অ্যান্ড সার্ভিস (এসএস) বিভাগের চার কর্মকর্তা। তারা হলেন, পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এস এম রেজাউর রহমান, জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক তৌসিফ শাহরিয়ার, উপসহকারী পরিচালক কামাল সিদ্দিকী এবং মাসুম খান।
প্রতিমন্ত্রীর নির্দেশনা ভেঙে বিদেশ সফরে করেছেন আইসিটি বিভাগের কর্মকর্তারাও। ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মার্চ পর্যন্ত জাপানের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ইনফরম্যাটিক্স পরিদর্শনের অনুমতি পেয়েছিলেন বিসিসির নির্বাহী পরিচালক রণজিৎ কুমার এবং পরিচালক (ট্রেনিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) গোলাম সারওয়ার। ২০ থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত থাইল্যান্ড সফর করেন বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ‘বিডিসেট’ প্রকল্পের পরিচালক আমিরুল ইসলাম। এই সফরের খরচ বহন করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘এ জেড টেকনোলজি’। আর ২৬ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত একটি ওয়ার্কশপে অংশ নিতে মালদ্বীপ সফর করেন আইসিটি বিভাগের তৎকালীন যুগ্ম সচিব এ টি এম জিয়াউল ইসলাম।
সরকারি আদেশ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের এ তালিকা অনেক দীর্ঘ। পলকের সর্বশেষ দায়িত্বকালের প্রথম ছয় মাসেই অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা বিদেশ সফর করেছেন। অভিযোগ আছে ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের বিদেশ পাঠাতে বেশ উদার ছিলেন তিনি। উল্লিখিত সময়ে বিদেশ সফর করেননি আইসিটি বিভাগের এমন এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, এমন কর্মকর্তারা বিদেশ সফর করেছেন, যাদের চাকরির সঙ্গে এসব সফর সামঞ্জস্যপূর্ণ না। বিভিন্ন সময় সরকারি কর্মকর্তা বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নন, এমন ব্যক্তিদেরও বিদেশ সফরে পাঠিয়ে ছিলেন পলক।
আর্কাইভ 
| ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ 
