ওষুধের বাজার ধরতে উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো এখন আর কমিশন বা দামি উপহার দিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছে না। চিকিৎসকদের নামে গবেষণাপত্র তৈরি ও আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশ করে দেওয়ার ফাঁদে ফেলছে তারা। অর্থের বিনিময়ে এসব কাজ করে দিতে গড়ে উঠেছে কিছু প্রতিষ্ঠানও। এতে গবেষণায় ন্যূনতম সম্পৃক্ত না হয়ে, গবেষণা সম্পর্কে না জেনেই কিছু চিকিৎসক বিশেষজ্ঞ ও গবেষক বনে যাচ্ছেন। এ ধরনের অনৈতিক চর্চার কারণে দেশের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা গবেষণা কার্যক্রম দুর্বল হয়ে পড়ছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশি চিকিৎসকদের গবেষণাকর্মের গ্রহণযোগ্যতা কমছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কয়েকজন অধ্যাপক কালবেলাকে জানান, কয়েকটি বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি মূলত চিকিৎসকদের এ ধরনের সুবিধা দিয়ে থাকে। এসব ওষুধ কোম্পানির সহযোগিতা এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ের মেডিকেল ও পাবলিক হেলথ শিক্ষার্থীদের টাকার বিনিময়ে গবেষণার নামে কপি পেস্ট সুবিধা দিতে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। এগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রমিস, রাইটিং এক্সপার্ট কনসালট্যান্সি ফার্ম, ‘রিসার্চ একাডেমি’ ‘দ্য স্পিয়ার’ ইত্যাদি। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে চিকিৎসকদের মোবাইল, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ এবং ইমেইলে নিয়মিত বিজ্ঞাপন পাঠানো হয়।
বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির এ ধরনের প্রবণতার কারণ জানতে চাইলে তারা বলেন, দেশি ওষুধ কোম্পানিগুলোর আগ্রাসী বিপণন ব্যবস্থার কারণে বেশ কিছু বিদেশি কোম্পানিকে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হয়েছে। আইনি বাধ্যবাধকতায় বহুজাতিক কোম্পানিগুলো দেশীয় কোম্পানির মতো তৈজসপত্র, বিমান টিকিট, নগদ টাকা বা যে কোনো উপহার দিতে পারে না; কিন্তু গবেষণায় ব্যয় করতে পারে। যেহেতু এদেশীয় চিকিৎসকরা নগদ কমিশন বা উপহার ছাড়া ব্যবস্থাপত্রে ওষুধ লেখেন না, তাই ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে বহুজাতিকরা এই কৌশল অবলম্বন করছে।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘ওষুধ কোম্পানির এ ধরনের সুবিধা দেওয়া এবং চিকিৎসকদের নেওয়া এক ধরনের অপরাধ। তবে এটা এড়ানো কঠিন নয়। মনে রাখতে হবে, যে কোনো গবেষণামূলক ডিগ্রি দেওয়া হয় একজন সুপারভাইজারের সুপারিশে। কারণ গবেষণা করা হয় সুপারভাইজারের অধীনে। সুপারভাইজার হিসেবে যিনি থাকেন তিনি সহজেই শিক্ষার্থীর জালিয়াতি শনাক্ত করতে পারেন, যদি তিনি আন্তরিক হন। তাই এ ধরনের অপরাধ প্রবণতার দায় অধ্যাপকরাও এড়াতে পারেন না।’
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পাবলিক হেলথ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা বলেন, এভাবে থিসিস লেখানো বা প্রকাশ করা সম্পূর্ণ অনৈতিক। আমরা জেনেছি, সম্প্রতি কিছু চিকিৎসক ও কিছু একাডেমিশিয়ান এ ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন। এ কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষাগুলোতে রিসার্চ পেপার ও থিসিস পেপার কঠোরভাবে বিচার বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘এই অনৈতিক কাজের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় পাস করবেন, একাডেমিশিয়ানরা পদোন্নতি পাবেন। কিন্তু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চিকিৎসক, গবেষক ও গবেষণা মান হারাবে।’
অধ্যাপক রেজা চিকিৎসকদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে গবেষণাপত্রের সংখ্যার চেয়ে মানের দিকে গুরুত্ব প্রদানের পরামর্শ দিয়েছেন।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানকালে হাতে আসা ‘প্রমিস’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, তারা রিসার্চ, ট্রেনিং ও কনসালট্যান্সি সার্ভিস দেয়। এর মধ্যে বিশেষভাবে কেস রিপোর্ট, অরিজিনাল আর্টিক্যাল, রিভিউ আর্টিকেল, থিসিস পেপার, প্রটোকল সিনপসিস, পিএইচডি সাপোর্ট, র-ডাটা এন্ট্রি, রাইটিং সাপোর্ট, পাবলিকেশন সাপোর্টের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
যোগাযোগ করা হলে প্রমিস-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু সালেহ মো. জিয়াউদ্দিন মানিক বলেন, তারা শুধু চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য গবেষণাপত্র তৈরি ও আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশের ব্যবস্থা করে দেন। এর বিনিময়ে কত টাকা নেওয়া হবে, তা বিষয়বস্তুর ওপর নির্ভর করে।
‘রাইটিং এক্সপার্ট কনসালট্যান্সি ফার্ম’ নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনে রিসার্চ পেপার রাইটিং, থিসিস রাইটিং, পাবলিকেশন রিসার্চ ও থিসিস সার্ভিস দেওয়া হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
সম্প্রতি বিজ্ঞাপনে দেওয়া নম্বরে ফোন করা হলে প্রতিষ্ঠানটির চিফ অ্যাডভাইজর জি এম আহসানউল্লাহ বলেন, তারা সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে থাকেন। তবে বিস্তারিত জানতে অবশ্যই অফিস সময়ে যোগাযোগ করতে হবে।
‘রিসার্চ একাডেমি’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান তাদের বিজ্ঞাপনে বলছে, ‘উই আর প্রোভাইডিং রিসার্চ সাপোর্ট’। এর মধ্যে রয়েছে প্রোপোজাল রাইটিং, রিসার্চ ডিজাইন, ডাটা কালেকশন অ্যান্ড অ্যানালাইসিং, লিটারেচার রিভিউ, এডিটিং অ্যান্ড ফরমেটিং, প্রোটকল রাইটিং, ম্যানুস্ক্রিপ্ট, প্রেজেন্টেশন, প্রি রিভিউ সাপোর্ট, জার্নাল সিলেকশন, পাবলিকেশন। অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক বা জনস্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষণার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব কাজ তারাই করে দেবে।
তবে সবচেয়ে লোভনীয় বিজ্ঞাপন দিয়েছে ‘দি স্পিয়ার’। প্রতিষ্ঠানটি তাদের বিজ্ঞাপনে লিখেছে, ‘গেট অথরশিপ (রাইট ইউয়োর নেম ইন পেপার এজ অথর) ইন ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল। তারা মাইক্রোবায়োলজি, জেনেটিক, ফার্মাকোলজি, ইউরোলজি, নেফ্রোলজি, গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি, সার্জারি, মেডিসিন এবং গাইনকোলজি বিষয়ে বিশ্বাসসযোগ্য গবেষণাপত্র তৈরি ও প্রকাশের নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে অগ্রিম কোনো টাকা দিতে হবে না বলেও বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের সেবা নিয়ে পাবলিক হেলথ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চিকিৎসক বলেন, ‘স্নাতকোত্তর পর্যায়ের থিসিস ও গবেষণার জটিলতা থেকে মুক্তি পেতে অনেকের মতো এমন একটি প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হই। এক্ষেত্রে আমাকে ব্যয় করতে হয়েছে দেড় লাখ টাকা। অনেককে তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকাও ব্যয় করতে হয়। তবে চেম্বারে রোগী বেশি এমন সহকারী ও সহযোগী অধ্যাপক পর্যায়ের চিকিৎসকদের নামে গবেষণাপত্র তৈরি করে আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশের সব ব্যয় বহন করে কয়েকটি ওষুধ কোম্পানি। এভাবে ওই চিকিৎসকরা পদোন্নতির ক্ষেত্রে সুবিধা পাচ্ছেন।’
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফজলে রাব্বী বলেন, ‘গবেষকদের একক বা দলগতভাবে গবেষণা কাজ সম্পাদন ও প্রবন্ধ লেখার কথা। এক্ষেত্রে অভিজ্ঞদের কাছ থেকে ভাষাগত ও ব্যাকরণগত সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে। সেটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। কিন্তু আমাদের দেশে কিছু প্রতিষ্ঠান চিকিৎসকদের নামে সায়েন্টিফিক আর্টিকেল (বৈজ্ঞানিক নিবন্ধন) লিখে দেয়। যেখানে আর্টিকেলে কোম্পানির নিজস্ব তথ্য উপাত্ত সংযুক্ত করা হয়। কোম্পানিগুলো সায়েন্টিফিক আর্টিকেল শুধু লিখেই দেন না, এটি নির্দিষ্ট চিকিৎসকের নামে আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশের ব্যবস্থাও করেন। আমাদের অনেক স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থী এবং পদোন্নতিপ্রত্যাশী চিকিৎসক এসব সার্ভিস নিচ্ছেন। এতে সাময়িকভাবে লাভবান হলেও প্রকৃতপক্ষে তার কোনো কৃতিত্ব নেই।’
তিনি বলেন, ‘বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় এসব কাগুজে গবেষণাপত্র ১০০ বা ২০০ ডলারের বিনিময়ে ছাপা হয় প্রিডেটির জার্নালে। এসব জার্নাল আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের সংজ্ঞায় প্রিডেটরি জার্নালকে জালিয়াতি, প্রতারণামূলক, বা ছদ্ম-জার্নাল বলা হয়েছে। এসব জার্নাল পিয়ার রিভিউ দেওয়ার জন্য মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করে, আর্টিকেল প্রসেসিং সম্পর্কে তথ্য গোপন করে, জার্নালের সম্পাদকীয় বোর্ডের সদস্যদের ভুলভাবে উপস্থাপন করে এবং কপিরাইট বা নৈতিকতার লঙ্ঘন করে।
সার্বিক বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সদ্যবিদায়ী মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম বলেন, ‘চিকিৎসকদের এই নৈতিক স্খলন দুঃখজনক ও লজ্জাজনক। এভাবে কেউ অধ্যাপক হলে তিনি কাউকে সুপারভাইস করতে পারবেন না।’
তিনি বলেন, ‘পদোন্নতির জন্য যদি এই প্রবণতা তৈরি হয় তাহলে নিয়োগবিধি, আইন ইত্যাদি পরিবর্তন করতে হবে। কিন্তু চিকিৎসকদের এ ধরনের অবক্ষয় মেনে নেওয়া যায় না।’