দীর্ঘ দেড় দশক ধরে সব ক্ষেত্রে চরম দলীয়করণের খেসারত দিচ্ছে দেশ। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদত্যাগের হিড়িক লেগেছে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মাঝারি স্তরের কর্মকর্তারাও শামিল হচ্ছেন এই মিছিলে। প্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, স্বায়ত্তশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা, এমনকি বাণিজ্য সংগঠনের শীর্ষ পদেও লেগেছে এই আঁচ। শুধু তাই নয়, স্থানীয় সরকারের প্রায় সব জনপ্রতিনিধি এখন আত্মগোপনে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাষ্ট্র পরিচালনায় একদলীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও ভিন্ন মত দমনের মানসিকতার কারণেই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। আওয়ামী লীগের শাসনামলে প্রশাসনের নিম্নস্তর থেকে সর্বোচ্চ পদ পর্যন্ত সর্বত্র দলীয়করণ করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতা ও দক্ষতার চেয়ে দলীয় আনুগত্যকে একমাত্র মাপকাঠি করা হয়েছে। ফলে ওই সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ‘দলবাজ’ ব্যক্তিদের পদত্যাগ কিংবা অপসারণ অবধারিত।
সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার কালবেলাকে বলেন, ‘চরম দলীয়করণের কারণেই শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তো ব্যবহার হয়েছে শেখ হাসিনার নিজস্ব লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে। কারও সঙ্গে কোনো ধরনের বিএনপি-জামায়াতের সংশ্লিষ্টতা থাকলেই তার চাকরি হয়নি। গত ১৫ বছরে চরম দলীয়করণ হয়েছে। দেশটার অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। যার ফল আমরা এখন পাচ্ছি। সরকার পতনের পর দলীয় লোকজন বিভিন্ন জায়গা থেকে সরে যেতে থাকায় রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানে সংকট দেখা যাচ্ছে।’
২০০৮ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এরপর ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনেও জয় পান তারা। তবে তিনটি নির্বাচনই কার্যত ‘একতরফা’ ছিল। নির্বাচন কমিশনের নামে গঠন করা হয়েছিল পকেট কমিশন। আজ্ঞাবহ কয়েকটি দল নির্বাচনে এলেও তাদের দেশব্যাপী প্রার্থী দেওয়ার মতো নেতাকর্মী ছিল না। এর মধ্যে ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচনে এলেও তাদের বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করা হয়। পাশাপাশি বাকি যারা ছিলেন তাদেরও
প্রচার-প্রচারণায় মাঠে দাঁড়াতেই দেয়নি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এর পরও গণরায়ের ওপর ভরসা না রেখে ওই নির্বাচনে আগের রাতেই ব্যালট বাক্স ভরে রাখা হয়েছিল।
এই তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয় এবং অবস্থানকে পাকাপোক্ত করতে কাজ করেন সরকারের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারা। দলীয় নেতাকর্মীরা দিনের আলোয় ভোট কাটলেও নির্বিকার ছিল পুলিশ প্রশাসন। অভিযোগ উঠেছিল, বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ভোট কাটায় সহযোগিতা করে পুলিশ।
অভিযোগ রয়েছে, পুলিশের মহাপরিদর্শক থেকে শুরু করে থানার পরিদর্শক পর্যন্ত নিজেদের মতাদর্শের লোকদের পদায়ন করেছিল আওয়ামী লীগ। এ ছাড়া পুলিশের বিভিন্ন উইং প্রধানদেরও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে দলগত বিবেচনায়। ফলে এসব কর্মকর্তারা অবতীর্ণ হন দলীয় কর্মীর ভূমিকায়। যার চূড়ান্ত ফল দেখা গেছে গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের মধ্য দিয়ে। কারণ পুলিশনির্ভর সরকার বুঝতেই পারেনি জনগণের সঙ্গে তাদের দূরত্বের বিষয়। যার ফলে সরকারের পতনের সঙ্গে পুলিশের ঊর্ধ্বতন অনেক কর্মকর্তাই পদত্যাগ করেন। অনেককে আবার অবসরে পাঠানো হয়।
একই চিত্র সরকারের প্রশাসন বিভাগেও। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব থেকে শুরু করে অতিরিক্ত সচিব, অধিদপ্তর প্রধান, ডিসি, ইউএনওদের নিয়োগ এবং পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে দলীয় বিবেচনায়। অনেককে আবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে অত্যধিক পুরস্কৃতও করা হয়েছে। সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া সিনিয়র আমলাও গা ঢাকা দিয়েছেন।
কেবল পুলিশ কিংবা জনপ্রশাসনেই নয়, দলীয়করণ করা হয়েছিল বিচার বিভাগেও। উচ্চ আদালতের সব বিচারপতিই নিয়োগ পান দলীয় বিবেচনায়। এ ছাড়া ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় এবং জেলায়ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেওয়া হয়েছে দলীয় প্রীতি থেকে। গত কয়েকদিনে উচ্চ আদালত থেকে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া প্রায় সব বিচারপতিই পদত্যাগ করেছেন।
গত তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন সফলভাবে শেষ করার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে নির্বাচন কমিশন। দীর্ঘদিন ধরেই একটি স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র নির্বাচন কমিশনের দাবি থাকলেও গত তিনটি নির্বাচনে নির্লজ্জ দলীয়করণ করা হয়েছে নির্বাচন কমিশনেও। নিয়োগ দেওয়া হয়েছে দলীয় মতাদর্শের কর্মকর্তাদের। বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গত পনেরো বছরে যত শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে, তার বেশিরভাগই নিয়োগ হয়েছে দলীয় বিবেচনায়। অপেক্ষাকৃত কম ফলাফল নিয়েও দলীয় কর্মীরা দেদার শিক্ষক হয়েছেন বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ ছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগও হয়েছে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে। ফলে সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনসহ পূর্বেকার সব আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীর ওপর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নানা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। শুধু উপাচার্যই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ পদেও বসানো হয়েছে দলীয় আদর্শের শিক্ষক-কর্মকর্তা। এ ছাড়া গত দেড় দশক দলীয় নেতাকর্মীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ায় বিরোধী মতের শিক্ষকের সংখ্যাও কমেছে, যে কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম এবং দুর্নীতি নিয়েও কেউ প্রতিবাদ করেনি।
তবে গণবিক্ষোভে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পরেই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊর্ধ্বতনরা পদত্যাগ করা শুরু করেন। এরই মধ্যে দেশের প্রায় বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, প্রক্টরিয়াল বডি এবং হল প্রভোস্টরা পদত্যাগ করেছেন।
এ ছাড়া দেশের আর্থিক খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও চেপেছিল দলীয়করণের ভূত। বাংলাদেশ ব্যাংক, সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন, নানা সরকারি ব্যাংক-বীমায়ও সরকার ঘনিষ্ঠদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে পদায়ন করা হয়েছিল। এরাও সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে নিজেরাও পদত্যাগ করেন। ফলে দেশের অর্থনীতিতেও একটা ঝাঁকুনির সৃষ্টি হয়েছে। নতুন করে ঢেলে সাজানো পর্যন্ত এই খাত এমন নড়বড়ে থাকবেই বলে মনে করছেন বিশিষ্টজন।
রাষ্ট্রচিন্তাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘সর্বত্র দলীয়করণ একটি কারণ। তবে আরও কারণ আছে, ২০১৪ থেকে ৩টি নির্বাচন হয়েছে। এই নির্বাচন যেভাবে হয়েছে, এটার বিরুদ্ধে মতামত ছিল যে, এগুলো কোনো নির্বাচন হয়নি। দ্রব্যমূল্য এত বাড়ছে, যে কারণে সমাজের এক-তৃতীয়াংশ লোক খুব বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে আছে। এর পরে বিদেশে এত টাকা পাচার, এত কথা পত্রপত্রিকায় দীর্ঘদিন ধরে আসছে। এটা নিয়ে হাসিনা সরকার নীরবই ছিল, যা বর্তমান পরিস্থিতির একটা বড় কারণ।’
এমিরেটস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, ‘শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পেছনে দলীয়করণ অন্যতম একটা কারণ। তবে আরও কারণ ছিল। মানুষের এই যে অভাব-অনটন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, নানা রকম অত্যাচার, গুম হওয়া, খুন হওয়া কণ্ঠরোধ করা এগুলোও ছিল। দলীয়করণও একটা কারণ, তবে একমাত্র কারণ বলা যাবে না।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং রাষ্ট্রচিন্তক সুলতান মাহমুদ রানা কালবেলাকে বলেন, ‘দলীয়করণ শেখ হাসিনার পতনের একটি কারণ, এটার সঙ্গে অবশ্যই একমত আমি। তবে যে কোনো রাজনৈতিক দলই সরকার পরিচালনার জন্য তার রাজনৈতিক অনুসারীদের বসানোর চেষ্টা করে। বাংলাদেশে আপনি নিরপেক্ষ লোক পাবেন না। সবাই কোনো না কোনো দলের অনুসারী। তবে যাদের বসানো হয়, তাদের নেতার পক্ষেই কাজ করা সমর্থনযোগ্য নয়। তাদের পার্টির ঊর্ধ্বে উঠে দেশের জন্য কাজ করা দরকার ছিল।’
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন করে দলীয়করণ হচ্ছে—এমন অভিযোগ করে সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘পুরোনো লোকদের সরিয়ে এখন আবার দলীয় লোকজন বসানো হচ্ছে। এখনো আবার দলীয়করণ হচ্ছে।’