জাকির হোসেন লিটন
প্রকাশ : ০৯ আগস্ট ২০২৪, ০৩:৩৭ এএম
আপডেট : ০৯ আগস্ট ২০২৪, ০৮:০৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

দারিদ্র্য বিমোচনে আজীবন নিবেদিতপ্রাণ ড. মুহাম্মদ ইউনূস

সারাবিশ্বে সম্মানিত
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি: সংগৃহীত
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি: সংগৃহীত

১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সংকটময় অর্থনীতির অনিশ্চিত গন্তব্যের একটি স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে রাষ্ট্র ও সরকারের অভ্যন্তরে অনেকেই তৎপর ছিলেন। বেশ কয়েকজন অর্থনীতিবিদও এগিয়ে এসেছিলেন একটি গতিশীল ও উন্নয়নমূলক আর্থসামাজিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার সেই প্রচেষ্টায়। এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত ব্যতিক্রম হিসেবে আবির্ভূত হন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে প্রত্যন্ত গ্রামীণ সমাজে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নেওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের নারীদের ক্ষমতায়নের অবরুদ্ধ দুয়ার খুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রথম ও প্রধান নায়ক। সারাবিশ্বে সম্মানিত, সমাদৃত ও স্বীকৃত হিসেবে যাদের নাম উচ্চারিত হয়, ড. ইউনূস তাদেরই একজন। তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক ও ক্ষুদ্রঋণের ধারণা শুধু বাংলাদেশই নয়, উন্নত বিশ্বেও ঝড় তুলে দিয়েছে, যা বিশ্বের অনেক দেশে এমনকি সবচেয়ে ধনী ও অগ্রসর দেশের কোটি মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করেছে।

জানা যায়, গত শতকের ৭০ দশকের মাঝামাঝি ড. মুহাম্মদ ইউনূস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা শুরু করেন। তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই জোবরা গ্রামে একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প গ্রহণ করেন। যার মূল লক্ষ্য ছিল গ্রামের দরিদ্র মানুষের আয় বৃদ্ধি করে তাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সূচনা ও জীবনমানের উন্নয়ন। বিদ্যমান আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে ড. ইউনূস জোবরা গ্রামে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখলেন, গ্রামীণ দরিদ্রদের মধ্যে ঋণ বিতরণ করলে সেই ঋণ বিনিয়োগের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতায় ব্যবহৃত হয় এবং গ্রামীণ দরিদ্রদের আয় বৃদ্ধি পায়। ড. ইউনূস জোবরা গ্রামে পরিচালিত তার পরীক্ষামূলক কর্মসূচিতে প্রমাণ করলেন, দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে শর্তহীন ঋণ প্রদানে কোনো ঝুঁকিও নেই। তার জোবরা গ্রামের এই পরীক্ষামূলক গবেষণা দারিদ্র্য বিমোচনে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করে।

শুরুতে অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশের কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে ঋণ প্রদানের চেষ্টা করেন। পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রকল্প হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। ক্রমেই গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ঋণ দেওয়ার পাশাপাশি ঋণগ্রহীতাদের প্রশিক্ষণ ও তাদের উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি গ্রহণ করে গ্রামীণ ব্যাংক। এ উদ্যোগ অভূতপূর্ব সাফল্যের সূচনা করে। নারীর ক্ষমতায়নে গ্রামীণ ব্যাংক হয়ে ওঠে প্রধান চালিকাশক্তি। নারীদের অর্থনৈতিক মুক্তির অগ্রদূত হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন ড. ইউনূস। এর আগে ব্যাংকের প্রচলিত নিয়মনীতির মধ্যে এমন কোনো ব্যবস্থাও ছিল না, যাতে করে দরিদ্র জনগোষ্ঠী ঋণ গ্রহণ করতে পারে। অধ্যাপক ইউনূসের আগে কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ গ্রামীণ অধস্তন ও হতদরিদ্র জনগণের উন্নতির কথা চিন্তা করলেও কোনো ফলপ্রসূ ধারণা বা উদ্যোগ দেখা যায়নি।

আধুনিক পুঁজিবাদী অর্থনীতির স্তম্ভ ব্যাংক ব্যবস্থা দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ‘ব্যাংক ব্যবহারে অযোগ্য’ আখ্যা দিয়ে ব্যাংকিং সুবিধার আওতা থেকে বাদ দিয়ে দেয়। কারণ ঋণের বিপরীতে গ্যারান্টি হিসেবে দেওয়ার মতো কোনো জামানত থাকে না তাদের। ‘ক্ষুদ্রঋণ’ ধারণাটি এ দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জ করে সম্পদহীন দরিদ্রদের ঋণদান করে। পুঁজির অভাবে ছোট পরিসরেও যারা ব্যবসার উদ্যোগ নিতে পারেনি, সারাবিশ্বের এমন কোটি কোটি মানুষের সামনে ঋণের নতুন এক জগত খুলে দেয় তার সে ধারণা। তিনি বলতে চেয়েছেন, ‘ঋণ’ পাওয়া মানুষের অধিকার। নারীদের কেন্দ্র করে ক্ষুদ্রঋণ প্রসারে তার যে কর্মপদ্ধতি, ‘সহায়হীন নারীদের’ দিয়ে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যে লড়াই, তা অসংখ্য সামাজিক বিধিনিষেধ ও প্রাচীন কুসংস্কার ভেঙে দিয়েছে। ৯৭-৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে ঋণ পরিশোধের মাধ্যমে ওই নারীরা ব্যাংকের দেউলিয়া হওয়ার ভয় এবং ঋণ পরিশোধের হারকে চ্যালেঞ্জ করেছেন, যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় বিশ্বের সেরা ব্যাংকগুলোকেও।

জানা যায়, ড. ইউনূসের চিন্তা শুধু দরিদ্রদের ঋণ দেওয়াতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তারা কীভাবে ব্যবসা শুরু করবেন, পরিচালনা করবেন, হিসাব রাখবেন, ব্যবসা চালিয়ে যাবেন—সেসব শেখানোও এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠী সমাজের বোঝা থেকে উৎপাদনশীল শ্রেণিতে পরিণত হয়। বর্তমানে গ্রামে-গঞ্জে উৎপাদনশীলতার যে বিপ্লব দেখছি, তার জন্য সরকারের নীতির পাশাপাশি সমান ভূমিকা রেখেছে এই ‘ক্ষুদ্রঋণ’। গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের নারীদের মধ্যে বিতরণের ফলে আর্থসামাজিক চিত্রের পরিবর্তন ঘটে। নারী আবির্ভূত হয়েছে অগ্রগতির চালিকাশক্তি রূপে। প্রায় পাঁচ দশক ধরে গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণদান কর্মসূচি দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে গুণগত উন্নয়ন ঘটিয়েছে।

দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রযুক্তিও যে ভূমিকা রাখতে পারে—এমন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন উদ্যোগের কৃতিত্বও অধ্যাপক ইউনূসের। যখন মোবাইল ফোন বিশ্বের যে কোনো দেশে বিলাস পণ্য হিসেবে বিবেচিত হতো, তখন বাংলাদেশের গ্রামীণ নারীদের দারিদ্র্য বিমোচনে তাদের উদ্যোক্তা-দক্ষতা ব্যবহার করে টেলিযোগাযোগ সেবাদানে কাজে লাগান তিনি। যার মাধ্যমে ওই নারীরা বিশ্বব্যাপী ‘টেলিফোন লেডি’ নামে পরিচিতি লাভ করেন। এ ছাড়া টেলি শিক্ষা, টেলি মেডিসিন, মশা নিরোধক, কম খরচে পানি পরিশোধন এবং আরও অনেক প্রযুক্তির প্রসারে তার অবদান অপরিসীম।

অধ্যাপক ইউনূস আজ বিশ্বনন্দিত। তিনি চিন্তা-চেতনা, আদর্শ এবং জীবন ভাবনার ক্ষেত্রে ছিলেন অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ও দ্বিধাহীন। অধ্যাপক ইউনূস বিশ্বের ২৪টি দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৬১টি সম্মানসূচক ডিগ্রি পেয়েছেন। ১০টি দেশের রাষ্ট্রীয় সম্মাননাসহ ৩৩টি দেশ থেকে ১৩৬টি সম্মাননা পান তিনি। ফরচুন ম্যাগাজিন তাকে ২০১২ সালে ‘সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদ্যোক্তা’ আখ্যা দিয়েছিল। টাইম, নিউজউইক এবং ফোর্বস ম্যাগাজিনের কভারে তাকে স্থান দেওয়া হয়েছে। নোবেল শান্তি পুরস্কার, ইউনাইটেড স্টেটস প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম এবং ইউনাইটেড স্টেটস কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল পাওয়া ইতিহাসের মাত্র সাতজনের মধ্যে তিনি একজন। বিশ্বের ৩৯টি দেশের ১০৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ে সামাজিক ব্যবসাকেন্দ্রিক বিভাগ, সেন্টার বা একাডেমিক কার্যক্রম আছে, যেগুলোকে সম্মিলিতভাবে ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার বলা হয়। ২০২৩ সালের ২৩ নভেম্বর অধ্যাপক ইউনূসকে রাশিয়ার ফিন্যান্সিয়াল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা বোর্ডের চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। টোকিও অলিম্পিকে ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটি তাকে ‘অলিম্পিক লরেল’ সম্মাননা দিয়েছে। সম্প্রতি সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ফুটবল সামিটে তাকে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার দেওয়া হয়। এ ছাড়া তিনি জাতিসংঘ এবং বেসরকারি বৈশ্বিক ফাউন্ডেশনসহ প্রায় সব বহুপক্ষীয় সংস্থার উপদেষ্টা পর্যায়ে কাজ করেছেন। এর বাইরেও তিনি বেশকিছু ইউরোপীয় দেশের রাজকীয় সম্মাননা পেয়েছেন। তার উদ্ভাবিত সামাজিক ব্যবসা আজ বিশ্বের বহু দেশে বহু প্রতিষ্ঠানে চালু হয়েছে। এর সুফল লাভ করছে বিশ্বের বিপুলসংখ্যক মেহনতি মানুষ। গ্রামীণ ব্যাংক মডেল যেমন অনেক দেশেই দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখছে, তেমনি সামাজিক ব্যবসায় ও অধস্তন শ্রেণির সামাজিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখছে।

১৯৪০ সালের ২৮ জুন চট্টগ্রামের হাটহাজারীর কাপ্তাই বাথুয়া গ্রামে একটি বা মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেওয়া এই বিশ্বনন্দিত অর্থনীতিবিদ।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নারী উদ্যোক্তা তনির স্বামী মারা গেছেন

ভারত থেকে এলো ২৪৫০ টন চাল

নারায়ণগঞ্জে আগুনে পুড়ল দুই কারখানা

উপসচিব বিতর্ক এবং আন্তঃক্যাডার বৈষম্যের বাস্তবতা 

কিশোরগঞ্জে হাসপাতালে ভুল ইনজেকশনে ২ রোগীর মৃত্যু

আবারও আসছে শৈত্যপ্রবাহ

দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে শক্তিশালী মালদ্বীপের পাসপোর্ট

কুয়াশা ও তাপমাত্রা নিয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের নতুন বার্তা

দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন দাবানলকে ভয়াবহ করছে আরও

ধুম ৪-এ রণবীর

১০

আমি কারাগারে বৈষম্যের শিকার : পলক

১১

পয়েন্ট হারানোর পর গোলকিপারের ওপর ক্ষোভ ঝাড়লেন গার্দিওলা

১২

লালমনিরহাটে পেট্রল পাম্প থেকে বাস চুরি

১৩

অন্তর্বর্তী সরকার পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রেখে কাজ করছে : আইজিপি

১৪

পুলিশের সাবেক সোর্সকে পিটিয়ে হত্যা

১৫

অপরাধ-বিতর্কিত ভূমিকায় জড়িত কর্মকর্তাকে ধরা হবে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

১৬

দাবানলে প্রাণহানির সর্বশেষ

১৭

ইনজুরিতে বিপিএলকে বিদায় বললেন রাহকিম কর্নওয়াল

১৮

ডেসটিনির এমডি রফিকুলসহ ১৯ জনের ১২ বছর কারাদণ্ড

১৯

আনিসুল-দীপু মনিসহ ৯ জন নতুন মামলায় গ্রেপ্তার 

২০
X