আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘একদফা’ দাবি আদায়ে সব ধরনের সহযোগিতা করবে বিএনপি। তবে দলীয় কর্মসূচি নিয়ে এখনই মাঠে নামবে না দলটি। সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বাস্তবতার আলোকে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন।
বিএনপি নেতারা বলছেন, কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই সমর্থন দিয়েছে বিএনপি। এরপর ছাত্রদল, যুবদলসহ বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা বিক্ষিপ্তভাবে মাঠের কর্মসূচিতে সক্রিয় হন।
তাদের মতে, শিক্ষার্থীদের ঘোষিত একদফা সম্পূর্ণ যৌক্তিক এবং এটি দেশের জনগণের দাবি। এই যৌক্তিক দাবিতে চলমান আন্দোলনে তাদের শুধু সমর্থন নয়, সব ধরনের সহযোগিতাও থাকবে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন হলেও রাজনৈতিক দল হিসেবে যা করা দরকার, বিএনপি তা করবে। পাশাপাশি দলীয় নেতাকর্মীসহ দেশের সাধারণ মানুষকেও ছাত্রদের আন্দোলনে সর্বাত্মক সহযোগিতার আহ্বান জানানো হয়।
বিএনপি নেতারা বলছেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের দাবিতে বিএনপি বিভিন্ন দল ও জোটকে সঙ্গে নিয়ে যুগপৎভাবে আন্দোলন করে আসছে। এই দাবিতে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে আন্দোলন চালিয়ে আসা বিএনপি সম্প্রতি জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে একদফার ঘোষণা বিএনপির সেই আহ্বানের সুফল বলেই মনে করছেন দলটির নেতারা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলনে আমরা শুরু থেকেই সমর্থন জানিয়েছি। কিন্তু সরকার দমন-পীড়ন, নির্যাতন করে আন্দোলন দমনের চেষ্টা করেছে। নিরীহ শিক্ষার্থীদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। একেকটি পরিবার শেষ হয়ে যাচ্ছে। মা-বোন এবং বাবাদের কান্নায় আকাশ-বাতাস আজ ভারি হয়ে উঠেছে। এই নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনা সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। এজন্য সরকারই দায়ী। ফলে শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবি আজ একদফায় রূপান্তরিত হয়েছে। আমরাও সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবিতে আন্দোলন করে আসছি। তিনি বলেন, আমরা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সমর্থন জানালেও সেভাবে নামিনি। শিক্ষার্থীরাই তাদের আন্দোলন করছে। আন্দোলনে আমাদের এই সমর্থন অব্যাহত থাকবে।’
জানা গেছে, গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবিতে আবারও সংগঠিত হয়ে মাঠে নামার পরিকল্পনা করছিল বিএনপি। এ লক্ষ্যে গত জুনে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় করে বিভিন্ন পরামর্শ নেয় দলটি। আন্দোলন-কর্মসূচির বিষয়ে বিভিন্ন প্রস্তাবনাও উঠে আসে আলোচনায়। কিন্তু কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে মাঠের কর্মসূচি দেয়নি বিএনপি। একপর্যায়ে ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনে নৈতিক সমর্থন দেয় বিএনপিসহ অনেক রাজনৈতিক দল এবং জোট। সরাসরি মাঠে থাকার নির্দেশ না থাকলেও বিক্ষিপ্তভাবে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে মাঠে নামেন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। বিভিন্ন দল বিশেষ করে গণতন্ত্র মঞ্চ একাধিক কর্মসূচি পালন করছে। ছাত্র আন্দোলন ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গ্রেপ্তার এড়িয়ে নানা কৌশলে তৎপর রয়েছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল বলেছেন, ‘ছাত্ররা যখন আন্দোলন শুরু করেছে. তখনই এর যে যৌক্তিকতা, তা নিয়ে আমরা কথা বলেছি। আমরা শুরু থেকেই তাদের সঙ্গে সহযোগিতা শুধু নয়, তাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছি। আমরা এখনো আরও বেশি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই যে, ছাত্রদের এই যৌক্তিক আন্দোলনে আমাদের শুধু সমর্থন নয়, আমাদের সব ধরনের সহযোগিতা তাদের প্রতি থাকবে। যেহেতু শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এটা। সেজন্য রাজনৈতিক দল হিসেবে আমাদের যে দায়িত্ব-কর্তব্য সেই দায়িত্ব-কর্তব্য আমরা পালন করছি এবং করব। সারা দেশের নেতাকর্মীর প্রতি এই আহ্বান জানাব যে, ছাত্রদের এই যৌক্তিক আন্দোলনে সবার সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করা উচিত। কেননা, দেশে এখন গণজাগরণ শুরু হয়ে গেছে। জনগণ এবং শিক্ষার্থীদের বিজয় অবশ্যই হবে।’
বিএনপি নেতারা মনে করেন, কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী যে আন্দোলন, সেই আন্দোলন এখন জনগণের আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। তারা দীর্ঘদিন ধরে যেই দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন, সেই দাবিতে শিক্ষার্থীরাও এখন মাঠে নেমেছেন। তাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন সাধারণ মানুষও। শুধু ছাত্ররা নন সব ভয়ভীতি উপেক্ষা করে অভিভাবক, চিকিৎসক, আইনজীবী, শিল্পী-সাংস্কৃতিক কর্মী, সাংবাদিকসহ সব পেশার মানুষ এ আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ‘ছাত্রদের আন্দোলনটা ছাত্রদের হাতেই থাকা ভালো। না হলে আন্দোলন নস্যাতে একটি চক্র উঠেপড়ে লাগবে। বিএনপি রাজনৈতিক দল হিসেবে যা করা দরকার, তা করবে। আমাদের দল এরই মধ্যে সমর্থন জানিয়েছে। পাশাপাশি ছাত্রদের সহযোগিতার জন্য সারা দেশে নেতাকর্মীদের আহ্বান জানানো হয়েছে। শিক্ষার্থীদের একদফা দাবির প্রতি আমাদের পূর্ণ সমর্থন আছে। তাদের দাবি আমাদের দাবিরই যৌক্তিকতাকে প্রমাণ করে।’
বিএনপি নেতারা জানান, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালেই গত ২৬ জুলাই বিএনপির পক্ষ থেকে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেওয়া হয়। গণতন্ত্র মঞ্চের চার দল, ১২ দলীয় জোটের ১২ দল, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের ১১ দল, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যের চারটি দল, গণঅধিকার পরিষদ, এলডিপি, গণফোরাম, পিপলস পার্টি, লেবার পার্টিসহ বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের মিত্ররা জাতীয় ঐক্যে থাকবে। এ ছাড়া চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, ববি হাজ্জাজের এনডিএমসহ আরও ১৫টি রাজনৈতিক দলকেও পাশে চায় বিএনপি। এর মধ্যে বাম ও ডানপন্থি রাজনৈতিক দল রয়েছে। গত ২৯ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম বলেছেন, জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তারা সবার সঙ্গেই থাকবেন।
গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয় জোনায়েদ সাকী কালবেলাকে বলেন, ‘এখন দেশে যা হচ্ছে, সেটি ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান। ছাত্রদের একদফা দাবির প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন আমাদের আছে। কারণ আমরা শুধু রাজনীতি করি না, আমরাও তো জনগণের অংশ।’