সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে দেশজুড়ে সহিংসতা ও প্রাণহানির তথ্য সংগ্রহ করছে বিএনপি। এ ঘটনায় হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত ও সুনির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহে কাজ করছে দলের একটি বিশেষ টিম। সেই সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে বিপুলসংখ্যক মানুষের গ্রেপ্তারসহ মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে নজর রাখছে দলটি। প্রাথমিকভাবে কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য সংগ্রহ করে বিভিন্ন দেশের দূতাবাস ও আন্তর্জাতিক সংস্থায় পাঠানো হয়েছে। সেইসঙ্গে দেশে-বিদেশে বাড়ানো হয়েছে কূটনৈতিক যোগাযোগ। ক্ষমতাসীন সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানোর কৌশল হিসেবেই এসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে বিএনপি সূত্রে জানা গেছে।
জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে হতাহত ও গ্রেপ্তারের বিবরণসহ বিস্তারিত তথ্য কূটনীতিকদের অবহিত করতে চায় বিএনপি। তথ্য সংগ্রহ শেষ হলে যত দ্রুত সম্ভব ঢাকায় অবস্থিত বিভিন্ন দেশের দূতাবাস ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কার্যালয়ে সেগুলো পাঠানো হবে বলে দলীয় সূত্র নিশ্চিত করেছে।
কোটাবিরোধী আন্দোলনকে ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর পদক্ষেপ ও হতাহতের ঘটনার প্রতিবাদ ও গ্রেপ্তার বন্ধ এবং বিচারের দাবিতে তাৎক্ষণিকভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশ দূতাবাস ও মিশনের সামনে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন সংশ্লিষ্ট দেশে অবস্থানরত শিক্ষার্থী ও বাংলাদেশিরা। তাদের সঙ্গে ওইসব দেশে থাকা বিএনপির নেতাকর্মীরাও অংশ নিয়েছেন।
বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক রাশেদুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে নিরীহ ছাত্রছাত্রীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দমাতে আওয়ামী লীগ সরকার যে বর্বর ও কঠোর আচরণ করেছে, তা বিবেকবান কারও পক্ষেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। তারা ইন্টারনেট বন্ধ করে কারফিউ জারি ও সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছে, যা খুবই অপ্রত্যাশিত এবং অগণতান্ত্রিক। ক্ষমতাসীনদের মনে রাখতে হবে যে, বিশ্ব এখন ষাটের দশকে নেই। একবিংশ শতাব্দীতে এসে তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে সরকারের দমন-পীড়নের সব চিত্র সবার কাছে উন্মোচিত হয়েছে। গণমাধ্যমে দুই শতাধিক মৃত্যুর তথ্য এসেছে। প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হবে; কিন্তু সরকার সহিংসতার দায় বিএনপির ওপর চাপিয়ে গণগ্রেপ্তার চালাচ্ছে।’
বিএনপি নেতারা মনে করছেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে দেশে যে সহিংস পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তা আপাতত সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে; কিন্তু শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন দমাতে গিয়ে সরকার যেসব কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে, তার সমালোচনা করছে আন্তর্জাতিক মহল। বিষয়টি নিয়ে সরকারের ওপর নানামুখী চাপ আসতে শুরু করেছে। কারণ এই আন্দোলনে শিক্ষার্থীসহ অনেক মানুষ মারা গেছেন। অনেকে আহত হয়েছেন। আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে আনার পর থেকে দেশব্যাপী চলছে গ্রেপ্তার অভিযান। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশ এই পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। বিষয়টি জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন বৈশ্বিক সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সংগঠনের নজরদারিতেও আছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় সহিংসতায় কতজন নিহত হয়েছেন, কত লোক আহত হয়েছেন, আর কতজনকে আটক করা হয়েছে, তার বিস্তারিত তথ্য প্রকাশের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি গত বৃহস্পতিবার আহ্বান জানান জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থার প্রধান ফলকার তুর্ক। তিনি বিক্ষোভ সামাল দেওয়ার সময় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক নীতি ও মান মেনে চলার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এ ছাড়া বাংলাদেশে কোটা আন্দোলন ঘিরে সংঘটিত সহিংসতা ও বর্তমান পরিস্থিতিতে উদ্বেগ জানিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার ফলকার টুর্ককে চিঠি দিয়েছেন বিশ্বের ১৪০ শিক্ষাবিদ, লেখক ও বুদ্ধিজীবী। গত বৃহস্পতিবার লেখা ওই চিঠিতে তারা অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে সরকারের ওপর চাপ বাড়ছে বলে মনে করেন তারা।
বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সহ-সম্পাদক ড. শাকিরুল ইসলাম খান শাকিল কালবেলাকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের ওপর সরকার যেভাবে দমন-পীড়ন চালিয়েছে, তা বিশ্বে নজিরবিহীন। এরই মধ্যে বিক্ষোভকারীদের সরাসরি গুলি করায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। বিক্ষোভ দমনে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের প্রমাণে কথা জানিয়ে পদক্ষেপ নিতে বলেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। ব্রিটিশ পার্লামেন্টেও আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন দুজন এমপি। এ ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশ ছাত্র আন্দোলনে বিষয়ে অত্যন্ত গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। নিশ্চয়ই তাদের কাছে আন্দোলন দমনে বলপ্রয়োগের তথ্য রয়েছে। এসব তো নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য অস্বস্তির কারণ। তারা সহিংসতার দায়ভার নিয়ে পদত্যাগ না করলে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতি হবে বাংলাদেশের, যা সবার জন্যই অনাকাঙ্ক্ষিত।’
বিএনপির চেয়ারপারসনস ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজরি কমিটির বিশেষ সহকারী বদরুল আলম চৌধুরী শিপলু কালবেলাকে বলেন, ‘কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থামাতে অতিমাত্রায় বল প্রয়োগের কারণে আন্তর্জাতিক পরিসরে সরকারের ওপর চাপ বাড়ছে এবং তা অব্যাহত থাকবে। এর কারণ, সরকার যেভাবে বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তা নিচ্ছে না।’
এদিকে কোটাবিরোধী আন্দোলন ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দেশজুড়ে কারফিউ জারি, সেনাবাহিনী মোতায়েন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অব্যাহত গ্রেপ্তার অভিযান ও সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে বিএনপির সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। ইন্টারনেট সংযোগ পুরোপুরি স্বাভাবিক না হওয়ায় দলটির নেতাকর্মীরা অনেকটাই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। তারা সরাসরি ফোন নম্বরে কথা বলা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন। ইন্টারনেট সংযোগের অপ্রতুলতার কারণে ভার্চুয়াল সভাও করতে পারছেন না। নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তালাবদ্ধ থাকায় আরও জটিলতায় পড়েছেন দলটির শীর্ষ নেতারা। ফলে আন্দোলনের বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহে বেগ পেতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের। এরপরও ভিন্ন মাধ্যমে কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহত, আহত, নিখোঁজ, গ্রেপ্তার ও মামলায় অভিযুক্তদের তালিকা করার কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন বিএনপির একাধিক দায়িত্বশীল নেতা।
এদিকে বিএনপির মিডিয়া সেলের একাধিক সদস্য জানান, ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভাও করা যায়নি। এর মধ্যে বিএনপির দপ্তর শাখার প্রধান ও দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গ্রেপ্তার এবং কার্যালয়ের মূল ফটকে তালা দেওয়ার পর এ শাখা অকার্যকর হয়ে পড়ে। সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু ছাড়া দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত বাকি সবাই আত্মগোপনে আছেন। অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের দপ্তরের দায়িত্বে থাকা নেতাদের সঙ্গেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। মামলা-হামলা আর গ্রেপ্তারের ভয়ে তারা আছেন আত্মগোপনে। যে কারণে ঢাকাসহ সারা দেশের ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মীদের সব তথ্য সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।