এনায়েত শাওন
প্রকাশ : ২৯ জুলাই ২০২৪, ০২:৫৯ এএম
আপডেট : ২৯ জুলাই ২০২৪, ০৮:৪৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সাংগঠনিক দুর্বলতা

গৃহবিবাদে ধুঁকছে আ.লীগ

গৃহবিবাদে ধুঁকছে আ.লীগ

দীর্ঘ দেড় দশক ধরে ক্ষমতায় থাকলেও সাংগঠনিক সক্ষমতা বাড়াতে পারেনি আওয়ামী লীগ। বরং অনেক ক্ষেত্রেই দুর্বল হয়েছে দলের অবস্থা। দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে একসময় সারা দেশে শক্তিশালী সাংগঠনিক কাঠামো থাকলেও এই মুহূর্তে অনেকটাই এলোমেলো অবস্থা। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ক্ষমতাসীন দল ও তাদের সহযোগী সংগঠনগুলোর দুর্বলতা। পদপদবি ও বিভিন্ন নির্বাচন ঘিরে দলের অভ্যন্তরে চরম বিভক্তি তৈরি হয়েছে। প্রতিটি স্তরের এই গৃহবিবাদ ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলটির সাংগঠনিক দুরবস্থার অন্যতম কারণ বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

জানা গেছে, ক্ষমতায় আসার পর থেকে গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারীদের (‘হাইব্রিড’ হিসেবে পরিচিত) প্রভাব বিস্তার, ত্যাগী নেতাকর্মীদের অবমূল্যায়ন ও প্রভাবশালীদের একাধিপত্য বেড়ে যাওয়ায় তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠন দুর্বল হয়েছে। দলীয় নেতাকর্মীদের উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া নিয়ে ব্যস্ত। এতে সাধারণ মানুষের সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে। অনেক নেতাকর্মীর নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের কারণে এই জনবিচ্ছিন্নতা আরও বেড়েছে।

অন্যদিকে দলীয় পদপদবি ও নির্বাচনে মনোনয়ন নিয়ে দলের মধ্যে বিভক্তি বেড়েছে। সেই বিভেদের দেয়ালে ঘি ঢেলেছে বিগত জাতীয় সংসদ ও উপজেলা নির্বাচন। গত সাধারণ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে লড়াইয়ে নেমেছিলেন দলীয় নেতারা। ৬২টি আসনের অধিকাংশ স্থানেই স্বতন্ত্র হিসেবে আওয়ামী লীগের নেতারা জয়ী হন। পরে আওয়ামী লীগের নিষেধ সত্ত্বেও সন্তান-স্বজনদের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ভোটে রাখেন মন্ত্রী-সংসদ সদস্যরা। দলকে চ্যালেঞ্জ করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বজনদের জয়ী করতে ভূমিকা রাখেন সংসদ সদস্যরা। অর্থের কাছে হার মেনেছেন দলের অনেক ত্যাগী নেতা। ফলে বিভক্তির সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে আওয়ামী লীগের তৃণমূল। মন্ত্রী-এমপি ও প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে গৃহবিবাদের বলি হয়েছে দলের প্রকৃত কর্মী ও সংগঠন। সংকটকালে ঐক্যের পরিবর্তে স্পষ্ট হয়েছে বিভেদের এই দেয়াল।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাক কালবেলাকে বলেন, ‘দলের মধ্যে কিছু বিভক্তি তো আছেই। সম্প্রতি কোটাবিরোধী আন্দোলন ব্যবহার করে জামায়াত-শিবিরের নাশকতাকারীরা যেভাবে পরিকল্পনামাফিক আক্রমণ করেছে, সেখানে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের প্রতিরোধ কিছুটা দুর্বল ছিল। কিন্তু আমাদের নিজেদের মধ্যে সমন্বয় বাড়িয়ে দলকে সুসংগঠিত করার বিকল্প নেই। বিভক্তি দূর করে স্বাধীনতার সপক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে আগামীদিনে দল পরিচালনা করতে হবে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্ষমতার দ্বন্দ্বে দ্বিধাবিভক্ত আওয়ামী লীগের তৃণমূলে নেই দলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। ফলে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সহিংসতা প্রতিরোধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়তে পারেনি ক্ষমতাসীন দল। ঢাকার যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, রামপুরা, বাড্ডা, বনশ্রী, মিরপুর, মোহাম্মদপুরে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। নরসিংদী, চট্টগ্রাম, মাদারীপুর, সাভার, বগুড়াসহ অনেক এলাকায় ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এক পর্যায়ে কারফিউ জারি করতে বাধ্য হয় সরকার।

সূত্র জানায়, এসব এলাকায় বর্তমান ও সাবেক এমপির মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তা আন্দোলন প্রতিরোধের প্রধান অন্তরায় হিসেবে দেখা দেয়। ঢাকার বাইরে যেসব এলাকায় সহিংসতা হয়েছে, সেখানে স্থানীয় এমপি, সাবেক এমপি ও চেয়ারম্যানদের ত্রিমুখী দ্বন্দ্বে বিপর্যস্ত আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যেও বিষয়টি উঠে এসেছে। তিনি কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় দল হিসেবে আওয়ামী লীগের নানা দুর্বলতা তু্লে ধরেছেন। তিনি এমপিদের ব্যর্থতা ও কাউন্সিলরদের সমন্বয়হীনতার সমালোচনাও করেছেন।

সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে আসার পর দুর্বলতা কাটিয়ে দলকে চাঙ্গা করার লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে ধারাবাহিক বৈঠক করে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ। বিভেদ এতটাই স্পষ্ট যে, একটি বৈঠকে যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল ও ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচির বাগযুদ্ধ হাতাহাতিতে গড়ায়। ঢাকা-৮ নির্বাচনী এলাকার আওতাধীন বিভিন্ন ইউনিটের সভায়ও হট্টগোল করেন যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। মহানগর উত্তরের মোহাম্মদপুর থানার ২৭টি ইউনিট কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সংসদ ও উপজেলা নির্বাচনের পর দলের দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিরসনে উদ্যোগ নিয়েছিল আওয়ামী লীগ। দেশের আট বিভাগের সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্তরা তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। সেখানে অভ্যন্তরীণ সংঘাতের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারিও দেন কেন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা; কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৬ মাসে দেশের বিভিন্ন এলাকায় রাজনৈতিক সহিংসতায় ৪১ জন নিহত হয়েছেন। এ ধরনের ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ৩ হাজার ৭৩৬ জন।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও পরবর্তী সহিংসতা, সিটি করপোরেশন নির্বাচন এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতাসহ বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক সংঘাত ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে মোট ৪৪০টি।

পর্যালোচনায় দেখা গেছে, রাজনৈতিক সহিংসতার এসব ঘটনার বেশিরভাগই ঘটেছে ক্ষমতাসীন দলের দুই গ্রুপের মধ্যে। এতেই স্পষ্ট হয়, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এখন একে অপরের প্রতিপক্ষে পরিণত হয়েছে।

এ বিষয়ে মন্তব্য চাওয়া হলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম কালবেলাকে বলেন, ‘গৃহবিবাদের কারণে কিছু সমস্যা হচ্ছে, এটা সত্য। গত জাতীয় নির্বাচনেও এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। সম্প্রতি নাশকতাকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে না পারায়ও তা স্পষ্ট হয়েছে। যাত্রাবাড়ী, উত্তরা ও ডেমরায় আগে থেকেই দলীয় বিভক্তির অভিযোগ ছিল। অন্যান্য জায়গায় দলের নেতাকর্মীরা জানমালের নিরাপত্তায় প্রতিরোধ করেছেন। মহানগরের কমিটি করতে না পারায় নেতৃত্বহীন ছিল বিভিন্ন ওয়ার্ড ও থানা। এ বিষয়গুলো সমাধান করে ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগ গড়তে কাজ চলছে।’

এদিকে দুর্বলতা আঁচ করতে পেরে রাজধানীসহ সারা দেশে সংগঠন চাঙ্গা করার উদ্যোগ নিয়েছে ক্ষমতাসীন দল। এরই অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। আত্মসমালোচনা করে সেই বৈঠকে দলকে ঐক্যবদ্ধ করার বার্তা দেন তিনি। এরপর থেকে রাজধানীতে বিভিন্ন ওয়ার্ড, সংসদীয় আসনভিত্তিক বৈঠক করছেন কেন্দ্রীয় ও মহানগর নেতারা।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান কালবেলাকে বলেন, ‘দুর্বলতা তো আছেই, অস্বীকার করছি না। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় দলের মধ্যে এক ধরনের শৈথিল্য এসেছে। নেতাকর্মীদের মধ্যে আন্দোলন করার চেতনা নষ্ট হয়ে গেছে। এমনকি অপশক্তির বিরুদ্ধে রাজপথে মোকাবিলা করার সাহস হারিয়ে ফেলেছে। দুর্বল থেকে সবল করার উপায়ও আছে। সেই পথে আওয়ামী লীগ হাঁটছে।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
ঘটনাপ্রবাহ: কোটা সংস্কার আন্দোলন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বুধবার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

ডিএমপির ২ থানায় নতুন ওসিসহ ৭ পুলিশ পরিদর্শকের পদায়ন

১৮ সেপ্টেম্বর : নামাজের সময়সূচি

এমবাপ্পে-এনড্রিকে ভর করে রিয়ালের জয় 

মহাসড়ক অবরোধ করে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের বিক্ষোভ

সাবেক সংসদ সদস্য সেলিম আলতাফ জর্জ গ্রেপ্তার

বড় জয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শুরু মার্তিনেজের ভিলার

শিক্ষায় ৩১ বছরের বৈষম্যের অবসান চান মাউশির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা

১২ জেলারসহ ৩৪ কারা কর্মকর্তাকে বদলি

১০

ডিএমপির ৮ কর্মকর্তাকে বদলি

১১

মাজার ভাঙার প্রতিবাদে হরিরামপুরে সমাবেশ

১২

ভারতবিরোধী পোস্ট শেয়ার করায় বিএনপি নেতার ভিসা বাতিল

১৩

ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান মো. শাহজাহানের

১৪

সাড়ে ১০ কেজি স্বর্ণালংকারসহ মিয়ানমারের ২ নাগরিক আটক

১৫

অপহৃত ইউপি চেয়ারম্যানকে উদ্ধার করল সেনাবাহিনী

১৬

আবাসিক হলের শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের সঙ্গে ঢাবি উপাচার্যের মতবিনিময়

১৭

বরিশাল মেট্রোপলিটনে চার থানায় নতুন ওসির যোগদান

১৮

পাবনা-কুষ্টিয়া মহাসড়ক অবরোধ / পদ্মা নদীর ভাঙন রোধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি

১৯

ডেঙ্গুতে আরও ৫ জনের মৃত্যু

২০
X