দেশে সাধারণত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার কর্মীদের ওয়াকিটকি ব্যবহার করার অনুমোদন রয়েছে; কিন্তু সেই ওয়াকিটকি এখন যত্রতত্র পাওয়া যাচ্ছে। ওয়াকিটকি আমদানি, বিক্রয় ও ব্যবহারে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) লাইসেন্স এবং অনুমতি নেওয়ার বিধান থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা মানা হচ্ছে না। বিভিন্ন বৃহৎ ও স্বনামধন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও ব্যক্তি পর্যায়েও ব্যবহৃত হচ্ছে অবৈধ ওয়াকিটকি। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভুয়া পরিচয়ে ছিনতাই, ডাকাতি বা অপহরণের কাজে ওয়াকিটকি ব্যবহার হয়। কেউ কেউ আবার ক্ষমতা ও প্রভাব জাহির এবং প্রশাসনের সঙ্গে সুসম্পর্ক আছে এমন ‘ইমেজ’ তৈরি করতে অবৈধ ওয়াকিটকি রাখেন।
ওয়াকিটকি হচ্ছে হাতে বহনযোগ্য মাইক্রোফোন এবং স্পিকারযুক্ত বেতার রেডিও ডিভাইস। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন-২০০১-এর ধারা ৫৫(১) বলছে, কোনো ব্যক্তি লাইসেন্স ছাড়া দেশের ভূখণ্ডে বা আঞ্চলিক সমুদ্রসীমায় বা এর ওপরের আকাশসীমায় যোগাযোগের উদ্দেশ্যে কোনো বেতার যন্ত্রপাতি স্থাপন, পরিচালনা বা ব্যবহার করতে পারবে না বা কোনো বেতার যন্ত্রপাতিতে কমিশন কর্তৃক বরাদ্দকৃত বেতার ফ্রিকোয়েন্সি ব্যতীত অন্য কোনো ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করতে পারবে না।
জানা গেছে, প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ‘শর্ট বিজনেস রেডিও (এসবিআর)’ এবং ‘প্রাইভেট মোবাইল রেডিও (পিএমআর)’Ñ এ দুই ধরনের ওয়াকিটকির লাইসেন্স ও অনুমতি দেয় বিটিআরসি। সাধারণত স্বল্প পরিসরে বা সীমিত এলাকার জন্য এসবিআর এবং বৃহৎ পরিসরের জন্য পিএমআর ওয়াকিটকির অনুমোদন দেওয়া হয়। এসবিআরের জন্য বিটিআরসির লাইসেন্সের প্রয়োজন নেই, অনুমতিই যথেষ্ট। আর পিএমআরের জন্য লাইসেন্স নিতে হয়। সব শর্ত পূরণ সাপেক্ষে গোয়েন্দা সংস্থার ‘ক্লিয়ারেন্স’ পেলে এই লাইসেন্স দেয় বিটিআরসি। তবে উভয়ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট ফি দিয়ে আবেদন করতে হয়। পাশাপাশি তরঙ্গ বরাদ্দ এবং ওয়াকিটকির সংখ্যার ভিত্তিতে প্রতি বছর নির্দিষ্ট ফি পরিশোধ করতে হয়।
পিএমআরের ক্ষেত্রে লাইসেন্সগ্রহীতাকে নির্দিষ্ট এবং একক তরঙ্গ বরাদ্দ করা হয়। অতীতে পিএমআর লাইসেন্স শুধু সরকারি সংস্থাকে দেওয়া হতো এবং এর ওয়াকিটকিগুলো কালো রঙের। বর্তমানে অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে পিএমআরের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে ‘শেয়ার্ড ফ্রিকোয়েন্সি’ বরাদ্দ হয় এসবিআরের ক্ষেত্রে। এসবিআরগুলো নীল, হলুদ বা লাল রঙের হয়ে থাকে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকা, গাজীপুর, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজারের বিভিন্ন হোটেল এবং রিসোর্টে অবৈধ ওয়াকিটকির ব্যবহার সর্বাধিক। পাশাপাশি বিভিন্ন শপিং মল, প্রেক্ষাগৃহ, আবাসিক ভবন ও এলাকা এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অনুমতি ছাড়াই ওয়াকিটকি ব্যবহৃত হচ্ছে। রাজধানীর হোটেল লা মেরিডিয়েন, হোটেল রেঁনেসা, পল্লবী উত্তর বাড়ি ও ফ্ল্যাট মালিক সমিতি, কক্সবাজারের লং বিচ হোটেল, ক্রাউন প্লাজায় ওয়াকিটকি ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু তাদের কোনো অনুমোদন নেই। যদিও লং বিচ হোটেল কর্তৃপক্ষ কালবেলার কাছে লাইন্সেস থাকার দাবি করেছে।
অন্যদিকে অনেকেই এসবিআর অনুমতি নিয়ে পিএমআর ডিভাইস ব্যবহার করছেন। কোথাও কোথাও অনুমোদিত সংখ্যার অধিক ওয়াকিটকি ডিভাইসও ব্যবহার করছে। ঢাকার মিরপুরের থাই রিক্রিয়েশন ক্লাবের রঙিন ওয়াকিটকি ব্যবহারে এসবিআর অনুমতি থাকলেও সেখানে একাধিক কালো রঙের পিএমআর ডিভাইস ব্যবহৃত হচ্ছে। একই অবস্থা কক্সবাজারের সি-গাল এবং কক্স টুডের। হোটেল সি-গালের প্রধান নির্বাহী শেখ ইমরুল ইসলাম ছিদ্দিকী কালবেলার কক্সবাজার প্রতিনিধি ওয়াহিদুর রহমান রুবেলকে বলেন, শুরুতে কালো রঙের অনেক ওয়াকিটকি কেনা হয়েছিল; কিন্তু অনুমোদন চেয়ে আবেদন করেও পাইনি। এখন হোটেলের অভ্যন্তরে ৭-৮টি রয়েছে। অনুমোদন না পেলে সেগুলোও বন্ধ করব।
কক্স টুডের ব্যবস্থাপক আবু তালেব বলেন, ওয়াকিটকি (কালো রঙের) নেওয়ার পর অনুমতির আবেদন করেও পাইনি। আশা করছি দ্রুত পাবো। অনুমতি ছাড়া ব্যক্তি পর্যায়েও ওয়াকিটকি ব্যবহারের নজির রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘রবিনহুড’ নামে বিতর্কিত পশুপাখি উদ্ধারকারী আফজাল খান কালো রঙের ওয়াকিটকি ব্যবহার করেন। তিনি তার সঙ্গীদেরও দিয়েছেন অবৈধ ওয়াকিটকি। এ বিষয়ে জানতে তার মোবাইল নম্বরে ফোন করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। হোয়াটসঅ্যাপে কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
যে কারণে অবৈধ ওয়াকিটকির ব্যবহার: অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিজেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য বা তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক আছে অথবা ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী জাহির করতেই ব্যক্তি পর্যায়ে অবৈধ ওয়াকিটকি ব্যবহৃত হয়। তবে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের অনুমোদনহীন ওয়াকিটকিও অসৎ উদ্দেশে ব্যবহার করা হয়। ফ্রিকোয়েন্সি জানা থাকলে এবং ডিজিটালি এনক্রিপটেড না হলে বাইরের কোনো অবৈধ বেতার যন্ত্র ওয়াকিটকিতে হওয়া কথোপকথন শুনতে পারে। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সরকারি সংস্থার কথোপকথন কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পক্ষের অবৈধ ওয়াকিটকির মাধ্যমে শোনার ঝুঁকি রয়েছে।
জানতে চাইলে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক কালবেলাকে বলেন, ওয়াকিটকির মতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসের প্রতি সাধারণ মানুষের ভয় এবং সতর্কতা দুটিই রয়েছে। এ কারণে অনেকে নিজেকে ক্ষমতাবান হিসেবে জাহির এবং প্রভাব বিস্তার করতে অবৈধ ওয়াকিটকি ব্যবহার করে। এটা ব্যবহার করে সে চাঁদাবাজি, ছিনতাই বা অপহরণ করতে পারে।
আসে খেলনা হিসেবে, বিক্রি অনলাইনে: ওয়াকিটকি এখন অনলাইনেই কেনা যায়। সেগুলো ‘হোম ডেলিভারি’ও হয়। কালবেলার অনুসন্ধানে এমন অন্তত দুটি দেশিয় প্ল্যাটফর্ম শনাক্ত হয়। ‘ওয়াকিটকি জোন বিডি’ এবং ‘ওয়াকিটকি নেটওয়ার্ক’ নামের দুটি ফেসবুক পেজ থেকে মাত্র ১০ হাজার টাকায় ২টি ওয়াকিটকি ডিভাইস ‘ক্যাশ অন ডেলিভারি’তে ঘরে বসেই কেনা যায়। এগুলোর রেঞ্জ ৫ থেকে ৮ কিলোমিটার। ৪০ থেকে ৫০ কিলোমিটার রেঞ্জের ২টি ওয়াকিটকির দাম ৩০ হাজার টাকা। এ ছাড়াও চীনভিত্তিক ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ‘আলী এক্সপ্রেস’ থেকেও কেনা যায় এগুলো। এসব অবৈধ ওয়াকিটকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে বিক্রি হচ্ছে।
ওয়াকিটকি নেটওয়ার্কের পেজে দেওয়া নম্বরে হোয়াট অ্যাপে যোগাযোগ করলে জানানো হয়, ১০ হাজার টাকা দামের ডিভাইস ব্যবহারে লাইসেন্স লাগে না। তবে কেউ চাইলে তারা ২ মাসের মধ্যে লাইসেন্সও করে দিতে পারবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিদেশফেরত যাত্রীদের লাগেজের ভেতর এবং কখনো ‘খেলনা’ বলে কাস্টমসের চোখ ফাঁকি দিয়ে এগুলো দেশে আনা হয়। অর্থাৎ খেলনার চালানের ভেতর কয়েক পিস আসল ওয়াকিটকি থাকে।
যা বলছে বিটিআরসি: অবৈধ ওয়াকিটকি বিক্রিকারীদের বিরুদ্ধে ২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ৮টি অভিযান করেছে বিটিআরসি। এসব অভিযানে ৯৭টি সেট জব্দ হয় এবং ৮ জনকে গ্রেপ্তার এবং ৮টি মামলা দায়ের হয়। বিটিআরসি কমিশনার (স্পেকট্রাম) প্রকৌশলী শেখ রিয়াজ আহমেদ বলেন, অনুমোদনহীন ওয়াকিটকির ব্যবহার রাষ্ট্রীয় অপরাধ। যে ধরনেরই হোক না কেন, ওয়াকিটকি ব্যবহার করতে অবশ্যই অনুমতি নিতে হবে। শুধু ওয়াকিটকি না, যে কোনো বেতার যন্ত্রের ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য।