স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগে চাকরি হারিয়েছিলেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের জুনিয়র পার্সার (কেবিন ক্রু) মোহাম্মদ কামাল হোসেন নেহাল। পরে বিশেষ বিবেচনায় চাকরি ফেরত পেলেও একধাপ পদাবনতি দেওয়া হয়। সেখান থেকে ফেরেন আগের পদে। এবার তাকে এক ধাপ পদোন্নতি দেওয়ার সব আয়োজন সম্পন্ন করেছে বিমান। আজ রোববার তার মৌখিক পরীক্ষা (ভাইভা) গ্রহণের কথা।
শুধু নেহাল নন, একই দিন পদোন্নতির ভাইভা রয়েছে আরও ১৬ জন জুনিয়র পার্সারের। তারা এই পদোন্নতি পেয়ে ফ্লাইট পার্সার হচ্ছেন। তবে তাদের সবার বিরুদ্ধেই রয়েছে গুরুতর অভিযোগ, অনেকে চোরাচালানে জড়িয়ে চাকরি হারিয়েছিলেন। পদাবনতিসহ নানা ধরনের শাস্তি ভোগ করেছেন কেউ কেউ। এই কর্মীরা চোরাচালানের মতো অপকর্মে জড়ানোয় ভাবমূর্তি হারাতে হয়েছিল রাষ্ট্রীয় সংস্থা বিমানকে। তাদেরই এখন পদোন্নতি দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।
বিমানের কাস্টমার সার্ভিস পরিদপ্তর সূত্র জানায়, প্রতিটি ফ্লাইটে একজন ফ্লাইট পার্সার দায়িত্ব পালন করেন। বিমানে এখন ফ্লাইট পার্সার পদে রয়েছেন অন্তত ৭৬ জন। কিন্তু বিমান প্রতিদিন গড়ে ৩০টি রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। সে হিসেবে প্রতি ফ্লাইটে একজন করে ফ্লাইট পার্সার দায়িত্ব পালন করলে ৪৬ জনকেই বসে থাকতে হয়। এর পরও নানা অপকর্মে শাস্তি ভোগ করা এই জুনিয়র পার্সারদের ফ্লাইট পার্সার হিসেবে পদোন্নতির তোড়জোড় শুরু হওয়ায় রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জুনিয়র পার্সার থেকে ফ্লাইট পার্সার পদে পদোন্নতির প্রক্রিয়ায় থাকা কর্মীদের মধ্যে কামাল হোসেন নেহাল একটি ফ্লাইটে দায়িত্ব পালনের সময় জুতার ভেতর স্বর্ণ চোরাচালান করে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কাস্টমস কর্মকর্তাদের হাতে ধরা পড়েন। তদন্তে ঘটনা প্রমাণিত হওয়ায় তাকে বরখাস্ত করে বিমান। পাশাপাশি পদাবনতি দিয়ে জুনিয়র পার্সার থেকে স্টুয়ার্ড পদে দেওয়া হয়। চলতি বছরই তাকে ফের পদোন্নতি দিয়ে জুনিয়র পার্সার করা হয়। এই পদোন্নতির এক বছর পার না হতেই তাকে এখন আরেকটি পদোন্নতি দিয়ে ফ্লাইট পার্সার করে তাকে ‘পুরস্কৃত’ করা হচ্ছে। যদিও বিমানের সার্ভিস রেগুলেশন অনুযায়ী একই পদে তিন বছর দায়িত্ব পালন না করলে পদোন্নতিযোগ্য হওয়ার কথা নয়।
পদোন্নতির তালিকায় থাকা অন্য জুনিয়র পার্সার আশিকুর রহমান আশিক বিদেশি ওষুধ চোরাচালান করে ঢাকায় একাধিকবার ধরা পড়েন। এতে শাস্তি হিসেবে তাকে সাসপেন্ড করা হয়েছিল। শাহিনুল ইসলাম তৌহিদের বিরুদ্ধে ফ্লাইটে দায়িত্বে অবহেলার গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।
বিমানের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তৌহিদ ফ্লাইটে দায়িত্ব পালনের সময়ে বিমানের স্লাইড (জরুরি অবতরণের সময়ে ব্যবহৃত বিশেষ ধরনের সিঁড়ি) ফেলে দেন। এতে বিমানের বড় অঙ্কের আর্থিক ক্ষতি হয়। তা ছাড়া তার বিরুদ্ধেও কাস্টমস কেস রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, পদোন্নতির তালিকায় থাকা মিনহাজ উদ্দিন মিনহাজ, ফারুকুল আলম শাহরিয়ার ও গাউস উদ্দিন আহমেদ গাউসের বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা অভিযোগ। আতাউর রহমান উত্তম, কবিরুল হক খান ও ফখরুল হাসান ফাহিমও পাচার করে একাধিকবার কাস্টমস সদস্যদের হাতে ধরা পড়ে চাকরিচ্যুত হন। কামরুল ইসলাম বিপনের বিরুদ্ধে রয়েছে শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ। তিনি ইতালিতে সঠিক সময়ে ফ্লাইটে উপস্থিত না হওয়ায় ওই ফ্লাইট বিলম্ব হয়। এতে তিনি চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন। মোস্তফা আবদুল্লাহ আল মামুন মুকিদের বিরুদ্ধেও কাস্টমস কেস রয়েছে। ফ্লাইটে মোবাইল ফোনসেট চুরির অভিযোগে তার তিনটি ইনক্রিমেন্ট কর্তন করেছিল কর্তৃপক্ষ। হাফিজুল ইসলাম হাফিজ বেলজিয়ামের পাসপোর্টধারী। জাহিদ হোসেন রাফসানের বিরুদ্ধেও পাচারের অভিযোগ রয়েছে। এজন্য তিনি চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন। এ ছাড়া পদোন্নতির তালিকায় থাকা সেলিম হোসেন রবি ফ্লাইটে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জাপানে একটি আবাসিক হোটেলে হাউসকিপিং তরুণীর শ্লীলতাহানি করেন। ওই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মামলা হয় এবং শাস্তির মুখে পড়েছিলেন।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে এই কেবিন ক্রুদের দেখভাল করে থাকে প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহক সেবা পরিদপ্তর। অভিযুক্ত ও অপরাধ করে চাকরিচ্যুতদের পদোন্নতি দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ওই পরিদপ্তরের পরিচালক (যুগ্ম সচিব) হায়াত-উদ-দৌলা খান কালবেলাকে জানান, গ্রাহক সেবা পরিদপ্তর স্টুয়ার্ড বা পার্সারদের প্রাত্যহিক ব্যবস্থাপনার কাজ করে থাকে। তাদের পদোন্নতি বিষয়টি প্রশাসন ও মানবসম্পদ পরিদপ্তর দেখভাল করে থাকে।
গুরুতর অপরাধে শাস্তি পাওয়াদের পদোন্নতি দেওয়ার প্রক্রিয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের প্রশাসন ও মানবসম্পদ পরিদপ্তরের পরিচালক (যুগ্ম সচিব) মো. মতিউল ইসলাম চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, পদোন্নতি দেওয়ার আগে বিষয়গুলো পরীক্ষা করা হয়। একজন কর্মচারী অপরাধ করলে তার অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী শাস্তি দেওয়া হয়। এই শাস্তির প্রভাব কতদিন পর্যন্ত থাকবে, তা রুলসে বলা আছে।
তিনি বলেন, শাস্তির পর সেই সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরে সংশ্লিষ্ট কর্মচারী প্রমোশনের জন্য উপযুক্ত হলো কি না, এ বিষয়গুলো যাচাইয়ের জন্য কনসার্ন বিভাগ থেকে এনওসি নেওয়া হয়। এরপর মূলত প্রমোশন প্রক্রিয়া শুরু হয়।
পাচারের মতো অপরাধে জড়িয়ে এই কেবিন ক্রুদের মাধ্যমে বিমানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে এবং ফের তাদেরই পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে—এমন প্রশ্নে পরিচালক বলেন, এগুলো অবশ্যই কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করে এবং সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়।
অবশ্য এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, এমনটা হয়ে থাকলে বিমান একটা দুর্নীতি সহায়ক অবস্থা নিচ্ছে। এটা করা হলে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া এবং উৎসাহিত করার পাশাপাশি চোরাচালানের মতো অপরাধে যাদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে, তাদের পুনর্বহাল করে পদোন্নতি দেওয়ার মাধ্যমে এই ধরনের লোকজনকে সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে। বিমান রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে এ ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকবে বলে প্রত্যাশা থাকলেও তা করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
যারা এই সিদ্ধান্ত নিলেন তাদেরও দায় এড়ানোর সুযোগ নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, অপরাধ করে শাস্তি পাওয়ার পরও যারা পদোন্নতি পাচ্ছেন, এর পেছনে অন্য কোনো বিষয় কাজ করেছে কি না, কোন বিবেচানায় তারা এই পদোন্নতি পাচ্ছেন—তা খতিয়ে দেখে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
বিমানের একাধিক কেবিন ক্রুর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বহরে থাকা উড়োজাহাজগুলোর মধ্যে বোয়িং-৭৭৭ মডেলের উড়োজাহাজে বিমানবালা বা ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এই মডেলের উড়োজাহাজের ফ্লাইটে একজন চিফ পার্সার, একজন ফ্লাইট পার্সার, একজন জুনিয়র পার্সার এবং ৭ থেকে ৮ জন স্টুয়ার্ড বা স্টুয়ার্ডেস দায়িত্ব পালন করে থাকেন। বোয়িং-৭৮৭ ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজেও একইভাবে ১০ জন, বোয়িং-৭৩৭ মডেলের উড়োজাহাজে একজন ফ্লাইট পার্সারের নেতৃত্বে ৪ থেকে ৬ জন দায়িত্ব পালন করে থাকেন। অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে ড্যাশ-৮ মডেলের উড়োজাহাজে একজন জুনিয়র পার্সার ও একজন স্টুয়ার্ড বা স্টুয়ার্ডেস দায়িত্ব পালন করেন। সেক্ষেত্রে বিমানের ফ্লাইট বিবেচনায় স্টুয়ার্ড বা স্টুয়ার্ডেসের ঘাটতি থাকলেও ফ্লাইট পার্সার ও চিফ পার্সার পদে ঘাটতি নেই।
বিমানের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, প্রয়োজনের তুলনায় এমনিতেই ফ্লাইট পার্সার হিসেবে দ্বিগুণের বেশি কর্মী রয়েছেন। একই পদে ফের পদোন্নতি দিলে অতিরিক্ত বেতন-ভাতা বাবদ বিমানের অর্থ অপচয় ছাড়া আর কোনো কাজে আসবে না। পদোন্নতিপ্রাপ্তদের বসিয়ে রেখেই বেতন-ভাতা দিতে হবে। পাশাপাশি শাস্তিভোগীদের পদোন্নতি দিয়ে পুরস্কৃত করলে অন্যরাও একই অপরাধ করতে উৎসাহী হতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শাস্তি ভোগ করা এই জুনিয়র পার্সাররা বিমানের ঊর্ধ্বতন এক শ্রেণির প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের এতটাই আস্থাভাজন যে, ফ্লাইট পার্সার পদের সিনিয়রদের বাদ দিয়ে বিভিন্ন ফ্লাইটে তাদের ওই পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়। যদিও চাকরির পরিচয়পত্রে তাদের পদ জুনিয়র পার্সার এবং ফ্লাইট জিডিতেও একই পদ উল্লেখ থাকে তাদের। কিন্তু ফ্লাইট শুরু হলে ফাইনাল ক্রু পজিশনে (এফসিপি) তাদের নাম ফ্লাইট পার্সার হিসেবে উল্লেখ থাকে।