গাইবান্ধার বালাশীঘাট থেকে জামালপুরের বাহাদুরাবাদ ঘাট নৌরুটে লঞ্চ-ফেরি সার্ভিসের জন্য উভয় পাশে টার্মিনাল নির্মাণ করে কর্তৃপক্ষ। ১৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত টার্মিনাল দুটি এখন অযথা পড়ে আছে। নাব্য সংকটে লঞ্চ-ফেরি চলাচল সম্ভব নয় বলে ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।
দুই যুগ আগে উত্তর জনপদ থেকে ঢাকায় যাওয়ার জন্য ফুলছড়ির তিস্তামুখ ঘাট থেকে জামালপুরের বাহাদুরাবাদ ঘাট ফেরিতে পার হয়ে রেলপথে ঢাকা যাওয়ার প্রধান রুট ছিল। কালের বিবর্তনে নদীভাঙনে নদীর গতি-প্রকৃতি পরিবর্তন ও নাব্য সংকটে তিস্তামুখ ঘাটটি বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৩৮ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে ঢাকার সঙ্গে দেশের উত্তরাঞ্চলের রেল যোগাযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি উপজেলার তিস্তামুখ ঘাট ও জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জের বাহাদুরাবাদ ঘাটে যমুনা নদীতে রেল ফেরি সার্ভিস চালু করা হয়। ১৯৯০ সালের পর যমুনা নদীর নাব্য সংকটের কারণে ফেরিঘাটটি তিস্তামুখ ঘাট থেকে স্থানান্তর করা হয় ব্রহ্মপুত্র নদের বালাশীঘাটে। এ পথ চালু করতে ত্রিমোহনী হয়ে বালাশী পর্যন্ত সংযোগ নতুন রেললাইন নির্মাণ করে ফেরি চালু করলেও নাব্য সংকটে তা বেশিদিন চালু রাখা সম্ভব হয়নি। ফলে ২০০০ সালে এই রুটটি বন্ধ ঘোষণা করে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
জেলার মানুষের প্রাণের দাবি, বালাশী থেকে বাহাদুরাবাদ পর্যন্ত সেতু অথবা টানেল নির্মাণ। এই দাবিতে ব্রহ্মপুত্র সেতু বাস্তবায়ন কমিটির ব্যানারে ২ থেকে ৩টি সমাজিক আন্দোলন সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছিল। সেই দাবি উপেক্ষা করে বিআইডব্লিউটিএর বিশেষজ্ঞ টিম নানা পরীক্ষা ও সম্ভাব্যতা যাচাই করে বালাশীঘাট ও বাহাদুরাবাদ ঘাট নৌরুটে ফেরি সার্ভিসের জন্য গ্রহণ করে। ২০১৭ সালে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ১২৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। পরে দুদফায় প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে ১৪৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা দাঁড়ায়।
নৌরুট সচল রাখতে উভয় পাশে দুটি টার্মিনাল নির্মাণ করে কর্তৃপক্ষ। এত ব্যয়বহুল প্রকল্প সম্পন্ন করেও ২৬ কিলোমিটার বিশাল দূরত্বের এই পথ নাব্য সংকটসহ বিভিন্ন সমস্যা দেখিয়ে ফেরি চলাচলের অনুযোগী বলে ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। এতকিছুর পরও যাতায়াতের ভোগান্তির শেষ নেই এ পথের যাত্রীদের।
সরেজমিন বালাশীঘাট টার্মিনাল ঘুরে দেখা যায়, টোল আদায়ের বুথ, বাস টার্মিনাল, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ব্যারাক, পাইলট বিশ্রামাগার, অফিস, মসজিদ, খাবারের হোটেল, আনসার ব্যারাকসহ নান্দনিক সব স্থাপনা। আকর্ষণীয় অবকাঠামোগুলো জনমানবহীন হয়ে পড়ে আছে। পাহারা দেওয়ার জন্য কয়েকজন আনসার সদস্য ছাড়া আর কেউ নেই।
ফুলছড়ি উপজেলার অ্যারেন্ডাবাড়ীর চরের বাসিন্দা মৎস্যজীবী ভবতোষ বলেন, ‘হামাক কেউ মানুষ মনে করে না। চকচকা বিল্ডিংগুলো করল নাকি বড় বড় নৌকা-লঞ্চ চইলবার জন্য। কটি বাহে কিছু তো দেখম না। কয়েকদিন আগে নদীত দেখলাম কয়টা ছোট ছোট ফেরি, এখন ফির শুনতেছি সেগুলো চলবার নয়।’
জামালপুরের বদিউজ্জামান বলেন, ‘টার্মিনাল নির্মাণ হলো। আমরা ভাবছিলাম আমাদের কষ্ট কমলো। কষ্ট তো আর কমলো না, বেড়ে গেল দ্বিগুণ, আমার বয়স হয়ে গেছে বাবা, বালুর চরে আর হাঁটতে পারি না। অনেকদিন পরে মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে গেছিলাম, বেঁচে থাকতে আর যেতে পারব কিনা, জানি না।’
গাইবান্ধা জেলা বার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও নাগরিক মঞ্চের আহ্বায়ক সিরাজুল ইসলাম বাবু বলেন, এ রুটে লঞ্চ-ফেরি চলাচলের জন্য দীর্ঘদিন থেকে আন্দোলন করে আসছি। নাব্য সংকটের দোহাই দিয়ে লঞ্চ চলাচল করা সম্ভব নয় বলে এখন দাবি করছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ। কোনো কিছু যাচাই-বাছাই না করেই যারা এটা করছে, তারা দায়িত্বশীল কাজ করেন নি। আমরা গাইবান্ধাবাসীসহ আট জেলার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলাম। উন্নয়নের নামে আমাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। কাজ করার পর যেটি সাধারণ জনগণের কাজে আসে না, সেটি জনস্বার্থবিরোধী বলে মনে করি।
বালাশীঘাটে ব্রহ্মপুত্র সেতু আন্দোলনের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট আশরাফ আলী বলেন, নদী ড্রেজিং ও টার্মিনাল নির্মাণের নামে যারা জনগণের ১৪৫ কোটি টাকা ব্যয় করিয়ে রাষ্ট্রের ক্ষতি করেছে, তাদের বিচার হওয়া উচিত।