এবারের বর্ষায় ভয়াবহ বন্যার মতো বৃষ্টি না হলেও বারবার বন্যা আতঙ্কে থাকছেন তিস্তা নদীর কোলঘেঁষা বাসিন্দারা। বৃষ্টি শুরু হতে না হতেই বন্যা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে ওই এলাকায়। একই সঙ্গে উজানের ঢলের পানিতেও বিপৎসীমার ওপরে উঠছে তিস্তার পানি। হঠাৎ পানি বাড়লেও আবার কমে যাচ্ছে। তিস্তায় এমন পানি বাড়া-কমার খেলায় নদীর অববাহিকায় থাকা মানুষজনও বাড়িঘর ছেড়ে আসা-যাওয়ার মধ্যে পড়ছেন। বাড়ছে বিড়ম্বনা এবং আতঙ্কও।
নদী ও পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিস্তায় পানি বাড়া-কমা খেলার সঙ্গে মূলত তিস্তার তলদেশ ভরাটের একটা বড় অঙ্ক রয়েছে। তাদের দাবি, যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত হচ্ছে, তাতে নদীর তলদেশ ভিজিয়ে ওঠার কথা। সেখানে বিপৎসীমার ওপরে উঠছে পানি। এর মূল কারণ হচ্ছে, তিস্তা সারা বছরই ভরাট থাকা।
নদীপাড়ের বাসিন্দারা বলছেন, এখন আর নদীর গভীরতা নেই। নদীতে বালু আর বালু। একটু পানিতেই নদী উপছে বাড়িঘরে পানি উঠছে।
নদী গবেষক অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, বর্ষা মৌসুমে বন্যা ও উজানি ঢলে আসা বালু আর পলি পড়ে ধীরে ধীরে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নদীর গতিপথ বদল হয়ে সীমানা বাড়লেও গভীরতা কমছে।
তিনি বলেন, ২৩৫ বছরের এই নদীর কোনো পরিচর্যা হয়নি। বরং নদীর ক্ষতি হয়—এমন বহু প্রকল্প করা হয়েছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নদীর পরিচর্যা করা না গেলে আশীর্বাদী তিস্তা অভিশাপে পরিণত হবে।
তিনি বলেন, ভারতের সিকিম থেকে ১৭৮৭ সালে তিস্তা নদীর গতিপথ বদল হয়ে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার কালীগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে লালমনিরহাট, রংপুর, গাইবান্ধা ছুঁয়ে মিলিত হয় কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র নদে। ৩১৫ কিলোমিটারের এই নদীর ১১৫ কিমি বাংলাদেশ ভূখণ্ডে অবস্থিত। ২০১৪ সালে তিস্তার ভারতীয় অংশের গজলডোবায় বাঁধ দেয় তারা।
তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানী জানান, উজান থেকে শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রত্যাহার করায়, পানির অভাবে বাংলাদেশ অংশে তিস্তা মরে যায়, মরে গেছে। প্রকৃতি রুক্ষ হয়ে উঠেছে। বর্ষাকালে পানি ছেড়ে দেওয়ায় প্রবল পানির চাপে মূল গতিপথ বদলে তিস্তা প্রচণ্ডভাবে প্রবাহিত হতে থাকে।
তখন তিস্তার বাংলাদেশ অংশে এর প্রস্থ কোনো কোনো জায়গায় ৫ কিলোমিটারেরও বেশি হয়ে পড়ে। বন্যায় প্রতিবছর এই অঞ্চলের শত শত মানুষ বাড়িঘর, গাছপালা, আবাদি জমি হারিয়ে ভূমিহীন ও ছিন্নমূল হয়ে পড়ছে।
তিনি বলেন, ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে মন্ত্রিপর্যায়ের বৈঠকে তিস্তা নদীর পানির শতকরা ৩৬ শতাংশ পাবে বাংলাদেশ এবং ৩৯ শতাংশ ভারত। বাকি ২৫ শতাংশ নদীপ্রবাহের জন্য নদীতেই সংরক্ষিত রাখা হবে। কিন্তু কখন থেকে এবং কোথা থেকে এই পানি ভাগাভাগি করা হবে, সে বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা ছিল না ওই বৈঠকে।
তিস্তা সুরক্ষা কমিটির আহ্বায়ক নদী গবেষক অধ্যাপক মঞ্জুর আরিফ বলেন, মূল তিস্তা এত প্রশস্ত ছিল না। তিস্তা ভরাট হতে হতে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নদী নাব্য থাকলে প্রশস্ত হতো না। তিস্তাকে নাব্য রাখতে হবে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে খনন করে নদীর প্রাকৃতিক গঠন ও ধরন বজায় রাখতে হবে।
যখন শুকিয়ে যাচ্ছে অর্থাৎ শুষ্ক মৌসুমে প্রতিবেশী দেশ পানি আটকিয়ে রাখছে। প্রতিদিন, প্রতি মাস বা প্রতিবছর যে পরিমাণ পানি প্রবাহিত হওয়ার কথা, সেটি হচ্ছে না।
পানি উন্নয়ন বোর্ড রংপুর কার্যালয়ের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আহসান হাবিব বলেন, উজানের পাহাড়ি ঢল নামতে শুরু করলেও তিস্তাসহ বিভিন্ন নদনদীর পানি বাড়তে শুরু করে। পানির স্রোতের কারণে নিয়ম অনুযায়ী তিস্তা ব্যারাজের সবকটি (৪৪টি) জলকপাট খুলে দেওয়া হয়। সম্প্রতি কয়েকবার পানি বেড়েছে।
মন্তব্য করুন