মধ্যরাত এলেই ব্যস্ততা উবে যায় ঢাকার। নীড়ে ঘুমানো পাখির মতো চুপসে যেতে শুরু করে মানুষ। আর তখনই বেতার তরঙ্গে হাজির হন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী কথাবন্ধু লগ্ন। রেডিও ধ্বনির ফ্রিকোয়েন্সিতে গল্প, গান ও তথ্যভিত্তিক বিনোদনে মাতিয়ে রাখেন নির্ঘুম শ্রোতাদের। তবে এর বাইরে আরও অনেক জগতে বিচরণ আতিক মেসবাহ লগ্নের—সেসব জানাচ্ছেন হাসান তানভীর।
ক্যাম্পাসের বন্ধুরা ভালোবেসে নাম দিয়েছে মধ্যরাতের কথাবন্ধু। আর আরজে হিসেবে লগ্নের যাত্রা শুরু একটি কমিউনিটি রেডিও থেকে। ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে কাজ করার পর এখন আছেন রেডিও ধ্বনিতে। ‘বোহেমিয়ানদের গল্প’, ‘ক্যাফেইনেটেড উইথ লগ্ন’ অনুষ্ঠানগুলো লগ্নকে পরিচিত করেছে, জয় করেছে শ্রোতার মন। বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় প্রচারিত ‘অজানা মলাট’ও কম জনপ্রিয় নয়। ‘ভয়েস ফ্যাক্টরি বাংলাদেশ’ নামের একটা ভয়েসওভারভিত্তিক প্রতিষ্ঠানেও কাজ করছেন লগ্ন।
ক্যাম্পাসে প্রিয় মুখ লগ্ন। আবৃত্তি, লেখালেখির পাশাপাশি কাজ করছেন দেশের সংবাদভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল ডিবিসি নিউজে। বিশ্ববিদ্যালয়ে উৎসুক তরুণদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন শুদ্ধ বাংলা চর্চার সংগঠন ‘গহিন’। ক্যাম্পাসের বাইরে কাজ করছেন ফোকাস মিডিয়া একাডেমি নামে বাচিক শিল্পভিত্তিক প্রতিষ্ঠানেও। সক্রিয় আছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আবৃত্তি সংসদ, ডিবেটিং সোসাইটির মতো সংগঠনগুলোয়। সুযোগ পেলেই অনুজ-অগ্রজদের নিয়ে বসে পড়েন কবিতাচর্চায়।
সব পরিচয়ের বাইরে ‘আরজে লগ্ন’ পরিচয় তাকে দিয়েছে আলাদা খ্যাতি। এটাই তিনি বেশি উপভোগ করেন। লগ্ন বলেন, ‘ক্যাম্পাসে গেলেই অনেকে আরজে লগ্ন নামে ডাকে। আমিও সাড়া দিই। অনেকেই অনুষ্ঠানের বিষয়ে নানান প্রশ্ন করেন। বিশেষ করে পড়া আর পেশা কীভাবে একসঙ্গে চলছে, সেটা নিয়েও আগ্রহ সবার। কীভাবে আরজে হওয়া যায়—এ প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি বেশি। অনুজরা পরামর্শ চায়। আমিও দিই।’
লগ্ন ভালোবাসেন গল্প বলতে। নিজের চারপাশ আর বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে গল্প কুড়িয়ে নেন। অন্যকে গল্প শোনাতে গিয়ে নিজের জীবনেও এসেছে নানান গল্প। এরকমই একটি গল্প শোনালেন তিনি, ‘আগে মাঝরাতে অনুষ্ঠান করতাম। প্রেম-ভালোবাসার রোমান্টিজমে শান দিতাম। বেশিরভাগ শ্রোতাই তরুণ। ওরা ওদের মনের সব কথা অকপটে আমাকে বলত। গত ডিসেম্বরে ইনবক্সে একটা মেইল পাই। পড়ালেখা নিয়ে চরম বিষাদগ্রস্ত এক তরুণ আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়ে কথাগুলো লিখেছে। ওর থেকে ফোন নাম্বার চেয়ে নিয়ে ফোন দিয়ে বোঝাই। পরে ওর সিদ্ধান্ত বদলাতে সক্ষম হই। তার সঙ্গে যোগাযোগও আছে। ও এ বছর একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে।’
ক্যাম্পাসের বন্ধুমহলে লগ্ন বিনয়ী ও মিশুক। সময় পেলে দেদার চলে আড্ডা। জমে গল্পের আসর। ভালো ছবিও তোলেন লগ্ন। ফটোগ্রাফার হিসেবে আছে আলাদা কদর। বিভিন্ন আয়োজনে ডাক পড়ে। লগ্ন বলেন, ‘ছবি তুলতে পছন্দ করি। অন্যের ছবির ক্যাপশনে নিজের নাম দেখতে ভালোলাগে। এ জন্য অবশ্য বান্ধবীমহলেও আলাদা খ্যাতি আছে (হাসি)।’
শব্দের সঙ্গে লগ্নের সখ্য বহুদিনের। কখনো গল্প-কবিতা আকারে পত্রিকায়, কখনো মাইক্রোফোন হাতে। তার লেখা ছড়া-কবিতা, ফিচার ও কলাম প্রকাশিত হয়েছে দেশের প্রথমসারির অনেক দৈনিকে। কাজ করছেন সাহিত্য সাময়িকী ‘বর্ণপ্রপাতে’। নিজ সম্পাদনায় বের করেছেন বেশ কয়েকটি সংখ্যা। এর পাশাপাশি আবার গ্রাফিক ডিজাইনেও দক্ষ এ অলরাউন্ডার তরুণ।
লেখালেখির পাশাপাশি ছোটবেলা থেকেই বিতর্ক ও আবৃত্তিতে পটু ছিলেন লগ্ন। এ চর্চার পথ আরও সহজ হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর। শুরুর দিকে বিতর্ক পুরোদমে চালালেও এখন ব্যস্ততার চাপে তা কমিয়ে দিয়েছেন। তবে নিয়মিত চলছে আবৃত্তি। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবৃত্তি সংসদের হয়েও কাজ করছেন। আবার আবৃত্তি নির্মাণ, আবহ সংগীত, সাজসজ্জার কাজও করছেন।
লগ্ন ভালো উপস্থাপকও। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ডাক পড়ে তার। উপস্থাপনার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছেন। সুযোগ পেলেই মুক্তাকাশের নিচে বসে কথা বলার চর্চা করেন। দেশসেরা উপস্থাপকদের আমন্ত্রণ জানিয়ে সবাই মিলে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। এ বিষয়ে লগ্ন বলেন, ‘গহিনের মাধ্যমে সবার মধ্যে ভাষা নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে চাই। বাংলা ভাষার সুস্থ ও সুষ্ঠু চর্চা হোক। আমরা তরুণরা এগোলেই সব সম্ভব।’
মন্তব্য করুন