পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে হেরে প্রধানমন্ত্রী মিশেল বার্নিয়ের ক্ষমতা হারানোর পর নতুন রাজনৈতিক সংকটে পড়েছে ইউরোপের প্রভাবশালী দেশ ফ্রান্স। সম্প্রতি বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করে সামাজিক নিরাপত্তা বাজেট পাস করার ফলে সৃষ্ট বির্তকের জেরে তার বিপক্ষে গত বুধবার পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে অনাস্থা ভোট হয়। এতে হেরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রিত্ব হারান বার্নিয়ে। ১৯৬২ সালের পর দেশটিতে এই প্রথম অনাস্থা প্রস্তাবে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ঘটনা ঘটল। রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফ্রান্সের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি জানান দিচ্ছে যে, বার্নিয়ের জায়গায় নতুন যে-ই আসুক না কেন, একই সমস্যার মুখোমুখি হবেন এবং ব্যর্থ হবেন। ফলে শিগগির ফ্রান্সের এ রাজনৈতিক সংকট কাটছে না। এদিকে ফ্রান্সের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আরও সংকটময় পরিস্থিতিতে পড়ছে ইউরোপ যার প্রভাব বিশ্বজুড়ে পড়তে পারে। খবর বিবিসির। স্থানীয় সময় গত বুধবার ৫৭৭ সদস্যের নিম্নকক্ষে অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষে ছিলেন ৩৩১ জন আইনপ্রণেতা। পার্লামেন্টের স্পিকার ইয়ায়েল ব্রাউন-পিভেট জানান, শিগগিরই বার্নিয়েকে প্রেসিডেন্টের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে পার্লামেন্ট বিলুপ্ত ঘোষণা করতে হবে। সম্প্রতি মন্ত্রীদের ভোট ছাড়াই বিতর্কিত বাজেট বিল পাস করেন বার্নিয়ে। ওই বাজেটে ৬ হাজার কোটি ইউরো ঘাটতি কমানোর লক্ষ্যে কর বাড়ানো এবং ব্যয় কমানোর পরিকল্পনা করা হয়। এই বাজেটকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ অভিহিত করে বিরোধী দল ও বামপন্থি দলগুলো সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেয়। বাজেটের ওপর পরিচালিত এক জরিপে ৬৭ শতাংশ মানুষ এর বিরোধিতা করেন। তার পরও বিশেষ ক্ষমতাবলে বার্নিয়ে বাজেট বিলটি পাস করেন। এর আগে গত সেপ্টেম্বরে মিশেল বার্নিয়েকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দেন প্রেসিডেন্ট মাখোঁ। ব্রেক্সিট বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রধান মধ্যস্থতাকারী ছিলেন ৭৩ বছর বয়সী এই রাজনীতিবিদ। ফ্রান্স এবং ইইউর বিভিন্ন পদে দীর্ঘ সময় ধরে দায়িত্ব পালন করেন ডানপন্থি রিপাবলিকান (এলআর) দলের সদস্য বার্নিয়ে। এলিসি প্রাসাদ জানিয়েছে, সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় টেলিভিশনে ভাষণ দেবেন। নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের ক্ষেত্রেও কিছুটা তাড়াহুড়ো করতে হবে মাখোঁকে। কারণ, সপ্তাহ শেষে প্যারিসে নটরডেম ক্যাথেড্রালের উদ্বোধন আয়োজনে আসবেন নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফ্রান্সের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি জানান দিচ্ছে যে, বার্নিয়ের জায়গায় নতুন যে-ই আসুক না কেন, একই সমস্যার মুখোমুখি হবেন এবং ব্যর্থ হবেন। সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবেন না তারা এবং সরকারি ব্যয় কমানোর নতুন উদ্যোগের গ্রহণযোগ্যতা পাবেন না। আরও অনাস্থা প্রস্তাব আসা এবং সরকারের পতন হওয়ার শঙ্কা জানান তারা। অর্থাৎ শিগগিরই কাটছে না ফ্রান্সের এ রাজনৈতিক সংকট। এদিকে ফ্রান্সের সরকারের এই পতন ইউরোপের রাজনীতির ওপর ফেলেছে উদ্বেগের ছায়া। ফ্রান্সের এই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা শুধু ফরাসি জনগণ নয়, বরং গোটা বিশ্বের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঐতিহ্যগতভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ‘ইঞ্জিন’ হিসেবে পরিচিত ফ্রান্স ও জার্মানি। ফরাসি রাজনীতির এই পরিস্থিতি স্বাভাবিকভাবে ইইউর কার্যক্ষমতায় গভীর প্রভাব ফেলবে। অন্যদিকে জার্মানির জোট সরকার ভেঙে আগামী ফেব্রুয়ারিতে দেশটিতে সাধারণ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এ দেশটিও অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে অস্থির অবস্থায় আছে। চালিকাশক্তির এই নড়বড়ে অবস্থায় দীর্ঘ সময় ধরে রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়তে থাকা ইউক্রেনের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি ইইউ কতটা সময় ধরে রক্ষা করতে পারবে, তা এখন ভাবনা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিজেদের শক্তিশালী অবস্থান বুঝাতে ইউক্রেনের পক্ষে অবিচল অবস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ইউরোপ। অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রশাসনে আসার পর ইউরোপের অবস্থা আরও টালমাটাল হয়ে যাবে। শুরু থেকেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে মার্কিন অংশগ্রহণের বিপক্ষে ট্রাম্প। ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি এবং প্রতিরক্ষা ব্যয় নিয়ে অসন্তোষ রাজনৈতিক বাস্তবতায় রূপ নিতে পারে। ফ্রান্স ও জার্মানির বেহাল রাজনৈতিক অবস্থার মধ্যে ইইউর ভার বহনের জন্য শক্ত অবস্থানে নেই কেউই। ইউরো জোনের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি এবং ইউরোপের অন্যতম প্রধান সামরিক শক্তি ফ্রান্স। দেশটির বর্তমান বাজেট ঘাটতি ইইউর মানদণ্ডকে অতিক্রম করছে। ইউরোপের বাকি অংশেও উদ্বেগ তৈরি করছে দেশটির সরকারি ঋণের উচ্চ হার। এ অবস্থায় ফ্রান্সের রাজনৈতিক অস্থিরতা সমাধানে প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করলেও পার্লামেন্টের অচলাবস্থার পরিবর্তন করতে পারবেন না। এই সংকটময় পরিস্থিতি শুধু ফ্রান্স নয়, বরং ইইউর বৈশ্বিক নেতৃত্বের অবস্থান নড়বড়ে করে দিচ্ছে। ইইউর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ছে, যা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এক বড় উদ্বেগের বিষয়।
মন্তব্য করুন