চলতি বছরের মে মাসে প্রবাসী বাঙালিরা দেশে ২২৫ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। অন্যান্য মাসের তুলনায় রেমিট্যান্স কিছুটা বাড়লেও জনশক্তি রপ্তানির তুলনায় তা প্রত্যাশিত হয়নি। কারণ সম্প্রতি ডলারের দর এক লাফে ৭ টাকা বাড়ানো হয়েছে। যার মূল উপকারভোগী হচ্ছেন প্রবাসীরা। তার সঙ্গে পাচ্ছেন আড়াই শতাংশ প্রণোদনা। সব মিলিয়ে প্রবাসীরা বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠালে এখন পাচ্ছেন ১১৯ টাকা ৫০ পয়সা, যা হুন্ডির প্রায় কাছাকাছি। তার পরও কাঙ্ক্ষিত হারে রেমিট্যান্স আসছে না।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) ও রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের বিদেশি জনশক্তির পরিমাণ ১ কোটি ৩০ লাখ। এসব জনশক্তি গড়ে প্রতি মাসে ৩০ হাজার টাকা করে পাঠানোর কথা। সে হিসেবে প্রতিমাসে দেশে রেমিট্যান্স হওয়ার কথা ৩৩৩ কোটি ডলার। যদিও গত মে মাসে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র ২২৫ কোটি ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের মে মাসে প্রবাসী আয় ২২৫ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় ২৬ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা। আগের মাস এপ্রিলে রেমিট্যান্স এসেছিল ২০৪ কোটি ডলার। সে হিসেবে মাসের ব্যবধানে রেমিট্যান্স বেড়েছে ১০ দশমিক ২৯ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৬৯ কোটি ডলার। সে হিসেবে বছরের ব্যবধানে রেমিট্যান্স বেড়েছে ৩৩ দশমিক ১৩ শতাংশ।
ব্যাংকাররা বলছেন, চলতি জুন মাসে ঈদুল আজহা অনুষ্ঠিত হবে। তাই প্রবাসীরা পরিবারের কোরবানির প্রস্তুতি হিসেবে এই মাসে রেমিট্যান্স বেশি পাঠিয়েছেন। একই সঙ্গে ডলারের দর বেড়ে যাওয়ায় প্রবাসী আয় বাড়তে পারে।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মী গেছেন ২ লাখ ২৬ হাজার ৮৩৭ জন। আর ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রবাসে রেকর্ড ১৩ লাখ ৫ হাজার ৪৫৩ জন কর্মী বিভিন্ন দেশে কাজের জন্য গেছেন। কিন্তু সেই অনুপাতে দেশের প্রবাসী আয় বাড়েনি। বর্তমানে সব মিলিয়ে দেশের বিদেশে অবস্থানকারী প্রবাসীর সংখ্যা ১ কোটি ৬৩ লাখ ২ হাজার ৩৬০ জন। যদিও রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো মনে করে বিদেশের মাটিতে প্রবাসী বাংলাদেশির পরিমাণ ১ কোটি ৩০ লাখ। সে হিসেবে মে মাসে একজন প্রবাসী গড়ে টাকা পাঠিয়েছেন ২০ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। অথচ, অর্থের পরিমাণ গড়ে ৩০ হাজারের বেশি হওয়ার কথা।
খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকিং চ্যানেলে বিভিন্ন ঝামেলা ও বেশি লাভের আসায় প্রবাসীরা হুন্ডিতে টাকা পাঠান। এক্ষেত্রে হুন্ডি এজেন্ট গ্রাহকের বাড়িতে টাকা পৌঁছে দিচ্ছেন। এতে প্রত্যাশা অনুযায়ী বাড়ছে না দেশের বিদেশি মুদ্রার অন্যতম প্রধান উৎস রেমিট্যান্স।
জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, বিএমইটি জনশক্তি রপ্তানির যেই তথ্য দিয়েছে, সেটি সঠিক নয়। এটা ১ কোটি ৩০ লাখের মতো হতে পারে। তবে এটা ঠিক যে, বাংলাদেশের বৈধপথে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স আসে, তার সমপরিমাণ থেকেও অনেক বেশি হুন্ডি বা অন্যান্য মাধ্যমে আসে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে রেমিট্যান্স কম দেখা যাচ্ছে। তবে যেভাবেই আসুক না কেন, এটা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, বিদেশের মাটিতে বর্তমানে যেই পরিমাণ প্রবাসী বাংলাদেশি আছেন, সেই পরিমাণে রেমিট্যান্স আসছে না। হুন্ডি ও অর্থ পাচার যদি ছয় মাসের জন্য বন্ধ করা যায়, তাহলে দেশের ডলার সংকট অনেকটাই কেটে যাবে।
পরিস্থিতি সম্পর্কে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর কালবেলাকে বলেন, অর্থ পাচারের কারণে দেশের রেমিট্যান্স কাঙ্ক্ষিত হারে বাড়ছে না। মধ্যপ্রাচ্য থেকেই অর্থ পাচারকারীরা রেমিট্যান্সের ডলার কিনে নিচ্ছে। আর বাংলাদেশে তা টাকায় পরিশোধ করছে। তাই রেমিট্যান্স বাড়াতে হলে হুন্ডির তৎপরতা থামাতে হবে। এ ছাড়া আমাদের এখান থেকে যেসব জনশক্তি যায়, তাদের অধিকাংশই অদক্ষ। এজন্য তারা বিদেশে গিয়ে সেভাবে অর্থ উপার্জন করতে পারে না। তবে আমাদের রেমিট্যান্সের যে হার, অর্থ পাচার থামানো গেলে তা অন্তত দ্বিগুণ বেড়ে যাবে।