উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে চা বিক্রি হওয়ায় লোকসান গুনতে হচ্ছে বাগান মালিকদের। এ কারণে দেশে ১৬৮টি চা-বাগানের মধ্যে বেশিরভাগ শ্রমিক-কর্মচারীর বেতন বকেয়া রয়েছে। বাগান মালিকদের অভিযোগ, সিন্ডিকেটের কারণে চা নিলামে কম দামে বিক্রি হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে চা শিল্প একসময় পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে।
জানা যায়, মৌলভীবাজার জেলায় ৯২টি চা বাগান রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ফুলতলা চা-বাগান মালিকপক্ষ বন্ধ করে দিয়েছে। শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি ও পরিচালনার খরচ বহন করতে না পেরে বাগানটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া সিলেটের কালাগুল, ছড়াগাঙ্গ ও বরজান চা-বাগান সাময়িক বন্ধ রাখা হয়েছে। উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে চা বিক্রি হওয়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। ব্যাংক ঋণের জন্য আবেদন করেও তা পাচ্ছেন না বলেও অভিযোগ বাগান মালিকদের। তারা জানান, পিঠ দেয়ালে লেগে গেছে। বেশিরভাগ বাগান ভর্তুকি দিয়ে পরিচালনা করতে হচ্ছে। অনেক বাগান বন্ধ হয়ে যাবে। চা শিল্প রক্ষার জন্য সরকারি প্রণোদনা প্রয়োজন। আমরা ব্যাংক ঋণ না পেলে কীভাবে বাগান চালাব।
চা বোর্ড সূত্র জানায়, ২০২৪ সালে হতো ৯৩ মিলিয়ন কেজি, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১০ শতাংশ কম। চলতি বছর দেশের সব চা-বাগানে উৎপাদনের মোট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১০৩ মিলিয়ন কেজি।
মৌলভীবাজারের চা-শ্রমিকরা বলেন, প্রায় প্রতিটি বাগানে আমাদের মজুরি বকেয়া। বাগানের যে অবস্থা, সবাই বলাবলি করছে, সেগুলো শিগগির বন্ধ করে দেওয়া হবে। আমরা বকেয়া মজুরি চাই। পাশাপাশি বাগান মালিকদের সরকারিভাবে সহযোগিতা দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।
বাংলাদেশ টি এস্টেট স্টাফ অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক আমিনুর রহমান বলেন, নতুন বছরে কয়েকটি বাগানে চা উৎপাদন শুরু হলেও বেশিরভাগই বন্ধ হওয়ার উপক্রম। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, চা শিল্প যে দিন দিন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে কেউ কথা বলছে না।
বেশিরভাগ বাগানেই লোকসানে। মালিকরা সবকিছু গুটিয়ে চলে যাচ্ছেন। অনেক দেশেই চা উৎপাদন আমাদের চেয়ে কম, তবু ক্রেতারা কমদামে চা কিনতে পারছে। আর আমাদের দেশে হয় উল্টো। বাগান মালিকরা নামমাত্র দামে বিক্রি করলেও দেশের মানুষ বেশি দামে কিনে খেতে বাধ্য হচ্ছেন।
চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল বলেন, চা শিল্প শেষ হয়ে যাচ্ছে। মালিকপক্ষ আমাদের সঙ্গে চা উৎপাদন খরচ ও বিক্রি নিয়ে মৌখিক আলোচনা করলেও কাগজেকলমে কিছু বলছে না। চায়ের উৎপাদন খরচ অনেক বেশি, নিলামে বিক্রির দাম রাখা হয় খুবই কম। প্রতি কেজি ন্যূনতম ৩০০ টাকা বিক্রি করা হলে চা শিল্প ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাবে। বাজার সিন্ডিকেটের কারণেই চা নিলামে কম দামে বিক্রি হচ্ছে। শমশেরনগর চা-বাগানের ব্যবস্থাপক মো. জাকির হুসেন বলেন, চায়ের উৎপাদন বেড়েছে, তবে চায়ের কোয়ালিটি আগের মতোই। এ জন্য চা উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে বিক্রি হচ্ছে।
সরকারি মালিকানাধীন এনটিসি চা-বাগানের ধলাই ভ্যালির ডিজিএম শফিকুর রহমান মুন্না বলেন, শুনেছি, কয়েকটি চা-বাগান বন্ধ রয়েছে। মজুরি দিতে পারছেন না বাগানমালিকরা। আমাদের শ্রমিকদেরও মজুরি পাওনা আছে।
শ্রীগোবিন্দপুর চা-বাগানের মালিক ও ন্যাশনাল টি কোম্পানির পরিচালক মো. মহসীন মিয়া মধু বলেন, ‘চা শিল্প এখন আগের মতো নেই। এই শিল্পকে বাঁচানোর জন্য সরকারি সহযোগিতা খুব বেশি প্রয়োজন। আমরা ভালো চা তৈরি করছি, তবে দাম পাচ্ছি না। বড় একটা সিন্ডিকেট চায়ের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। আমাদের থেকে কম দামে কিনে বাজারে বেশি দামে বিক্রি করছে।
চা বোর্ডের সচিব মোহাম্মদ মিনহাজুর রহমান বলেন, ‘চা শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয় নিয়ে সম্প্রতি সভা হয়েছে। কিছু বাগানমালিক কৃষি ব্যাংক থেকে লোন চেয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করব। কয়েকটি কারণে চা শিল্পের মালিকদের লোকসানে পড়তে হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, যখন শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো হয়েছে, তখন থেকে বেশ কিছু বাগান এই মজুরি দিতে সক্ষম ছিল না। এ ছাড়া উৎপাদন মূল্যের চেয়ে নিলামে বিক্রি মূল কম হওয়া। বাগান মালিকদের সুবিধার জন্য এরই মধ্যে কিছু বিষয় বাতিল করার জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করা হয়েছে।
মন্তব্য করুন