চলতি অর্থবছরে শুরু থেকেই বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে ছিল ধীরগতি। উন্নয়ন প্রকল্পে ধীরগতির কারণে ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছিল এডিপি বাস্তবায়ন হার। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির প্রকল্পগুলোতে দেখা দেয় মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধির শঙ্কা। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে ধীরগতিসহ নানা কারণে সৃষ্টি হয় এমন পরিস্থিতি। এ ছাড়া অপ্রয়োজনীয় উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থ ছাড় কমিয়ে দেওয়ার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে। তবে, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় স্থবির হয়ে পড়া উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে কিছুটা সচল হয়েছে।
প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থ ছাড় বৃদ্ধির কারণে অর্থবছরের মাঝপথে গতি ফিরেছে এডিপি বাস্তবায়নে। যদিও আগের তুলনায় এখনো অনেকটাই পিছিয়ে বাস্তবায়ন হার। গত ৫ অর্থবছরের মধ্যে এবার বাস্তবায়ন হার সবচেয়ে কম। তবে সর্বশেষ মাস ডিসেম্বরে বাস্তবায়নে হার বাড়ায় অনেকটাই স্বাভাবিক ধারায় ফিরেছে এডিপি। এই ধারা অব্যাহত থাকলে বাকি সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন সমাপ্তির দিকে দ্রুত এগোবে বলে প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের। এদিকে, বরাবরের মতোই পিছিয়ে রয়েছে স্বাস্থ্যসহ কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সর্বশেষ এডিপির অগ্রগতি প্রতিবেদন বিশ্লেষণে এমন তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল মঙ্গলবার চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর পর্যন্ত এডিপি বাস্তবায়নের অগ্রগতি প্রতিবেদন প্রকাশ করে আইএমইডি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বরাদ্দের হিসাবে কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ বাদে বেশিরভাগই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারছে না।
তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের এডিপিতে উন্নয়ন প্রকল্প রয়েছে মোট ১ হাজার ৩৫৩টি। সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারের অর্থায়ন ১ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা এবং বৈদেশিক ঋণ ১ লাখ কোটি এবং সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন ১৩ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা। গত ৬ মাসে মোট বরাদ্দের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ হয়েছে মাত্র ৫০ হাজার ২ কোটি টাকা। ফলে আগামী ছয় মাসে খরচের টার্গেট ২ লাখ ২৮ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে বরাদ্দের মাত্র ১৭ দশমিক ৯৭ শতাংশ। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ২২ দশমিক ৪৮ শতাংশ। আগের বছর (২০২২-২৩) ছিল ২৩.৫৩ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২৪ দশমিক ০৬ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে একই সময়ে ২৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছিল।
তবে শেষ দুই মাসে গতি পেয়েছে এডিপি বাস্তবায়নে। সর্বশেষ ডিসেম্বরে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ হয়েছে ১৫ হাজার ৭৮৭ কোটি ৭৯ লাখ টাকা বা মোট এডিপির ৫ দশমিক ৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের ডিসেম্বরে এডিপি বাস্তবায়ন হার ছিল ৫ দশমিক ৪২ শতাংশ এবং খরচ হয়েছিল ১৪ হাজার ৮৮২ কোটি ৩১ লাখ টাকা। সেই হিসাবে এবার অগ্রগতি বেশি হয়েছে।
এদিকে, এখন থেকে অর্থবছরের বাকি সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন দ্রুততর হবে বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। সর্বশেষ একনেক বৈঠক-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে এডিপি বাস্তবায়ন নিয়ে উপদেষ্টা বলেন, চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এডিপি বাস্তবায়ন করেছি ৪৪ হাজার কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে হয়েছিল ৬২ হাজার কোটি টাকা।
উপদেষ্টা আরও বলেন, বেশ কিছু প্রকল্প এখন আসছে, যেগুলো নতুন প্রকল্প। আগেরগুলো অনেক যাচাই-বাচাই করতে হচ্ছিল, ফেরত পাঠাতে হচ্ছিল, আবার সংশোধন করতে হচ্ছিল। এই প্রথম আমাদের নিজেদের নতুন প্রকল্পগুলো আসা শুরু করেছে, বিশেষ করে স্থানীয় পর্যায়ের। এই একনেকের মিটিংয়ে অনেক দ্রুত এবং বেশি প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে।
অগ্রগতি প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বরাবরের মতোই এবারও কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। অর্থবছরের ৬ মাস পেরিয়ে গেলেও ৫ শতাংশও এডিপি বাস্তবায়ন করতে পারেনি ৯টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। এর মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বরাবরের মতো স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ, পররাষ্ট্র ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ। এই তিন বিভাগ গত ৬ মাসে ১ শতাংশও এডিপি বাস্তবায়ন করতে পারেন।
এডিপি বাস্তবায়নে ৫ শতাংশের নিচে রয়েছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, জননিরাপত্তা বিভাগ, সুরক্ষা সেবা বিভাগ, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় সংসদ সচিবালয়। এ ছাড়া ১০ শতাংশের নিচে রয়েছে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়, সেতু বিভাগ, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং নির্বাচন কমিশন সচিবালয়।
শতাংশের হিসাবে এডিপি বাস্তবায়নে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, ৬ মাসে তারা তাদের বরাদ্দের ৫৬ দশমিক ৮৫ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়ন করেছে। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ, এই সময়ে তারা এডিপি বাস্তবায়ন করেছে ৪১ দশমিক ৮১ শতাংশ। আর খরচের হিসাবে এগিয়ে রয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। বিভাগটি ৬ মাসে খরচ করেছে ১০ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা, যা বরাদ্দের ৩০.৫৮ শতাংশ, দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা স্থানীয় সরকার বিভাগ খরচ করেছে ৯ হাজার ৪৭১ কোটি টাকা।