দেশে দ্রব্যমূল্যের উত্তাপ ক্রমেই বাড়ছে। এতে জীবনযাত্রার ব্যয়ভারও বেড়ে চলেছে। অথচ মানুষের আয় সেই আগের অবস্থাতেই স্থির। দীর্ঘদিন ধরে এই কম আয়ের বিপরীতে বাড়তি ব্যয়ের চাপ সামলাতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে এখন হয় ঋণ করতে হচ্ছে, নতুবা আগের জমানো সঞ্চয়ে হাত দিতে হচ্ছে। তবে এই প্রবণতা অল্প কয়েকজনের মধ্যেই এখন আর সীমাবদ্ধ থাকছে না। উপায়ান্তর না দেখে মানুষ এখন সঞ্চয়পত্র ভাঙার মিছিলে শামিল হয়েছে। এতে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণও কমে গেছে। সম্প্রতি সঞ্চয়পত্রে সুদহার অপরিবর্তিত রাখার বিপরীতে ব্যাংকের আমানত ও বিল বন্ডের বিনিয়োগে সুদহার বেড়ে যাওয়া, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে কড়াকড়ি আরোপসহ নানা কারণে মানুষ এখন নতুন করে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। উল্টো অব্যাহতভাবে সঞ্চয়পত্র ভাঙার প্রবণতা বাড়ায় গত অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) নিট বিক্রির পরিমাণ ঋণাত্মক হয়ে গেছে। অর্থাৎ এই সময়ে নতুন সঞ্চয়পত্র বিক্রির চেয়ে আগে কেনা সঞ্চয়পত্রের মূল পরিশোধ বেশি হয়েছে।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মে মাসে নিট বিক্রি ঋণাত্মক হয়েছে ৩ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা। আর গত অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে নিট বিক্রি ঋণাত্মকের পরিমাণ ১৭ হাজার ৭৪২ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়েও নিট বিক্রি ঋণাত্মক ধারায় ছিল। তবে ওই সময় এর পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ২৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় গত অর্থবছরের একই সময়ে সঞ্চয়পত্রে নিট বিক্রি কমেছে ৩৮৬ শতাংশ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১৮ হাজার কোটি টাকা। এর আগে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। যদিও অর্থবছর শেষে নিট বিক্রি হয়েছিল ঋণাত্মক প্রায় ৩ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ পুরো অর্থবছরে এ খাত থেকে সরকার এক টাকারও ঋণ নেয়নি। এই বিষয়টিকে মাথায় রেখে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা আরও কমানো হয়েছে।
আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্র থেকে ভাঙানো বাবদ (নির্দিষ্ট
মেয়াদ শেষে বা মেয়াদান্তের আগে) আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তাকে নিট বিক্রি বলা হয়। নিট বিক্রিকে সরকারের ধার বা ঋণ হিসেবে গণ্য করা হয় ।
এই প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এ বি এম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘কড়াকড়ি আরোপ করার কারণেই মূলত সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ভাটা পড়েছে। এ ছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষ খুব বেশি মুনাফা পাচ্ছে না। এটাও সঞ্চয়পত্র কমার বড় একটা কারণ। ঋণের বোঝা কমাতে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়া কমিয়ে দিয়েছে। একই সঙ্গে টিআইএন এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বাধ্যতামূলক করায় অনেকেই সঞ্চয়পত্রে আগের মতো বিনিয়োগ করতে পারছেন না। তার মতে, আগে কালো টাকাও সঞ্চয়পত্র খাতে বিনিয়োগ হতো। এখন সেটা হচ্ছে না। ফলে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে মন্দা দেখা দিয়েছে একই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, এখন মানুষ আর সঞ্চয়পত্র কিনছে না। এর তিনটি কারণ রয়েছে—প্রথমত, ৫ লাখ টাকার ওপরে সঞ্চয়পত্র কিনতে গেলে আয়কর রিটার্ন দিতে হচ্ছে; কিন্তু নানারকম ঝামেলার কারণে অনেকেই আয়কর রিটার্ন দিতে চান না। ফলে তারা এখান থেকে ধীরে ধীরে সরে আসছে। দ্বিতীয়ত, যাদের সঞ্চয়পত্র এক কোটি টাকার বেশি ছিল, সীমা নির্ধারণের কারণে এসব সঞ্চয়পত্রে মেয়াদ শেষে তারা আর নতুন করে কিনতে পারছেন না। তৃতীয়ত, মানুষের হাতে এখন টাকা কম আছে। বর্তমান মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষ আর আগের মতো সঞ্চয় করতে পারছে না। এসব কারণে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার কম ঋণ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনেক বেশি ঋণ নিচ্ছে, যা আরও বেশি ক্ষতিকর। কেননা, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে তা সরাসরি মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলে।