নিজের কনটেন্টে জুয়া ও বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপন প্রচারে প্রতি পর্বের জন্য লাখ টাকা নিতেন টিকটকার প্রত্যয় হিরন। তারপর সেই বিজ্ঞাপন প্রচার করা হতো টিকটক, ফেসবুক ও ইউটিউবের মতো জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এসব কনটেন্টে হিরনের সঙ্গে অভিনয়ে থাকতেন রায়হান সরকার বিশাল। জুয়া ও বেটিং কোম্পানির সঙ্গে এদের যোগাযোগ করিয়ে দিতেন এই চক্রের আরেক সদস্য আবদুল হামিদ। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) এক অভিযানে গ্রেপ্তার হয়ে এই তিনজন এখন কারাগারে বন্দি।
অনলাইনভিত্তিক অন্তত তিনটি জুয়া ও বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপন প্রচার করতেন প্রত্যয় হিরন ও তার সহযোগীরা। এদের সবার বয়স ২২ বছর বা এর আশপাশে। বিজ্ঞাপনের কাজে টিকটক, ইউটিউব ও ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করত এই চক্র। এসব প্ল্যাটফর্মের অন্তত আটটি লিঙ্ক পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। চক্রের মূল প্ল্যাটফর্মের নাম ‘দি আজাইরা লিমিটেড’। ইউটিউবে এই চ্যানেলের মূল নিয়ন্ত্রক প্রত্যয় হিরন।
গোয়েন্দা পুলিশের অনুসন্ধানী দল বলছে, এসব প্ল্যাটফর্মের জন্য ‘ওয়েব সিরিজ’ ধরনের কনটেন্ট তৈরি করতেন প্রত্যয় ও তার সহ-অভিনেতা বিশাল। তেমন একটি ওয়েব সিরিজ ‘বদমাইশ পোলাপাইন সিজন-৪’। এই ওয়েব সিরিজে অভিনয়ের মাধ্যমে জুয়া ও বেটিং সাইটের প্রচারণা চালাতেন প্রত্যয় ও বিশাল। পাশাপাশি সরাসরি বিজ্ঞাপন প্রচার এবং কনটেন্টের ‘ডেসক্রিপশন বক্স’-এ জুয়া ও বেটিং সাইটের লিঙ্ক প্রকাশের মাধ্যমেও বিজ্ঞাপন প্রচার করত এই চক্র।
আর এই কাজে তাদের সহযোগিতা করতেন হামিদ। একটি প্রতিবেশী দেশ থেকে নিয়ন্ত্রিত এসব জুয়া ও বেটিং সাইটের এজেন্টদের বাংলাদেশ প্রতিনিধি হিসেবে উভয় পক্ষের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করতেন হামিদ। বিজ্ঞাপন প্রচারের স্ক্রিনশট এই এজেন্টদের ‘হোয়াটসঅ্যাপ বা টেলিগ্রামের’ মাধ্যমে পাঠালেই প্রত্যয় পেয়ে যেতেন তার ভাগের অর্থ।
এমন এক একটি কনটেন্টের জন্য প্রতি পর্বে বিজ্ঞাপনপ্রতি সর্বনিম্ন ৭০ হাজার থেকে এক লাখ ১০ হাজার টাকা করে নিতেন প্রত্যয়। আর হামিদ পেতেন প্রায় ১০ হাজার টাকা। গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, হামিদ দেশের এমন আরও বেশ কয়েকজন টিকটকার ও ইউটিউবারের সঙ্গে জুয়া ও বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপন প্রচার নিয়ে কাজ করে আসছেন।
শেষ পর্যন্ত আইনের জালে আটকা পড়তে হয় এই চক্রকে। গেল ১৬ ফেব্রুয়ারি ডিএমপির ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগের টিম লিডার অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (এডিসি) মহিদুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন একটি দল অভিযান চালিয়ে নারায়ণগঞ্জের দুটি ও ডিএমপির রমনা থাকা থেকে এই তিন আসামিকে গ্রেপ্তার করে। অভিযানের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন একই বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ তারেক বিন রশিদ এবং এডিসি জুনায়েদ সরকার। গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে তিনটি করে মোবাইল ও সিম, একটি করে ট্যাব ও হার্ডডিস্ক জব্দ করে পুলিশ। এ বিষয়ে ডিএমপির রমনা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তারদের এরই মধ্যে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে বলে ডিবির একটি সূত্র দৈনিক কালবেলাকে নিশ্চিত করেছে।
ডিবি পুলিশ জানায়, আসামিরা ইন্টারনেট মাধ্যমে ‘বিখ্যাত’ হওয়ায় তাদের মাধ্যমে জুয়া ও বেটিংয়ের প্রচারণার ফলে তাদের অনুসারীদের একটি বড় অংশ এসব অবৈধ জুয়া ও বেটিংয়ে আসক্ত হচ্ছেন। বাংলাদেশে এসব অবৈধ সাইট পরিচালনা ও প্রসারে যারা ভূমিকা রাখছেন, তাদের বিষয়ে নজরদারি রাখা এবং গভীর তদন্ত করা হচ্ছে বলে ডিবির সাইবার ক্রাইম বিভাগের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়।
এদিকে জুয়া ও বেটিং সাইটের প্রচারে যেসব প্ল্যাটফর্ম ব্যবহৃত হয়েছে এবং বিজ্ঞাপনসংবলিত যেসব কনটেন্ট রয়েছে, সেগুলোকে মামলার আলামত হিসেবে বিবেচনা করছে তদন্তকারী দল।
এ বিষয়ে ডিসি মোহাম্মদ তারেক বিন রশিদ দৈনিক কালবেলাকে বলেন, এই লিঙ্কগুলো মামলার এক ধরনের আলামত। কাজেই সেগুলোকে এখনই ‘ডিলিট’ করা যাবে না। এগুলোর ডিজিটাল ফরেনসিক শেষে যথাযথ প্রক্রিয়ায় এসব লিঙ্ক বন্ধ করা হবে।