দেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকতা না পাওয়া পর্যন্ত বিএনপিকে কাজ করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
শুক্রবার (১৩ ডিসেম্বর) বিকেলে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে রাজধানীর রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বিএনপি আয়োজিত এক আলোচনা সভায় এ মন্তব্য করেন তিনি।
মির্জা ফখরুল বলেন, আপনাদের সামনে অনেক কাজ। অনেকে মনে করেছেন, হাসিনা পালিয়ে গেছে, কাজ শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু না। কিছুক্ষণ আগে আমাদের দলের সুলতান সালাউদ্দিন টুকু বলছিলেন, আমাদের এই আন্দোলন চলবে নির্বাচন পর্যন্ত। তবে এই নির্বাচনের পরে আরও বহু দিন আমাদের কাজ করতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা একটা গণতন্ত্রের সংস্কৃতিতে পরিণত করতে পারব, এটা একটা ব্যবস্থা হয়ে দাঁড়াবে, ওই জায়গাতে আমাকে পৌঁছাতে হবে। তাই আমাদের কাজ অনেক বেশি আছে।
নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান রেখে তিনি বলেন, যারা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন তাদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আসুন আজকে এই দিনে আমরা শপথ নিই, আমরা আমাদের গড়ে তুলব একটি উপযোগী রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে, গণতন্ত্রের একজন কর্মী হিসেবে, বিএনপির একজন কর্মী হিসেবে। সেই সঙ্গে আমাদের নেতা বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের কর্মী হিসেবে এবং আমাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সত্যিকার কর্মী হিসেবে যেন গড়ে তুলতে পারি।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, গণতন্ত্রের কথা আমরা বলছি, সেই গণতন্ত্র একটা কথার কথা নয়। এটা একটা কালচার-এটা একটা সংস্কৃতি। আপনি-আমি কীভাবে কথা বলব, আমি আমার প্রতিবেশীর সঙ্গে কেমন কথা বলব, আমার রাজনীতির প্রতিপক্ষের সঙ্গে কীভাবে কথা বলব- সেই বিষয়গুলো আমাদেরকে গণতন্ত্রের ভেতর দিয়ে শিখতে হবে। গণতন্ত্র মানে এই নয় যে, আওয়ামী লীগ করলে তাকে গলা কেটে ফেলো আর বিএনপি করলে তার মুণ্ড ছেদ করো- তাহলে সেটা কিন্তু গণতন্ত্র নয়। গণতন্ত্র হচ্ছে পরমত সহিষ্ণুতা। তোমার কথা বলার অধিকার আছে, আমার বিরুদ্ধেও কথা বলার অধিকার আছে- আমি সেটাকে রক্ষা করবো, এটাই হচ্ছে গণতন্ত্র।
সময়টা কঠিন উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই সময়টা সবচাইতে কঠিন সময়। আপনার একটা পদক্ষেপ যদি ভুল হয়- আপনি পেছনে পড়ে যাবেন, খাদে পড়ে যাবেন। যদি সঠিক পা দিতে পারেন, তাহলে আপনি সামনে এগিয়ে যাবেন। আমার অনুরোধ থাকবে-এই দিবসগুলো আপনারা অবহেলা করবেন না, জানার চেষ্টা করবেন। অনেকে জানেনই না, কী হয়েছিল? আমাদের দেশের সবচেয়ে বরেণ্য ব্যক্তিদের, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে ভালো শিক্ষকদের তুলে নিয়ে গিয়েছিল।
তিনি বলেন, এই যে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার আমাদের তুলে নিয়ে যেত, যেমন আমাদের গুম করে নিত; ঠিক ওইভাবে তাদের (শহীদ বুদ্ধিজীবীদের) তুলে নিয়ে গেছে। বাসা থেকে নেয়ার সময়ে জিজ্ঞাসা করেছিল- কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? এই কিছুক্ষণ পরে চলে আসবে তো, এভাবে নিয়ে গেছে। নেওয়ার পর আর ফিরে আসেনি। রায়েরবাজারে হাত-পা বাঁধা মরদেহ পাওয়া গেছে মহিলা-পুরুষ সকলের। এটা আমাদের মনে রাখতে হবে, বুদ্ধিজীবীদের কেন প্রাণটা দিতে হলো? তখনও এই আয়না ঘরের মতো ঘর ছিল। এই আয়নাঘরে কেন নিয়ে যাওয়া হয়েছে ছেলেদের- রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের? একটাই উদ্দেশ্য ছিল- তাদের ভয় পাইয়ে দেওয়া, তাদের শেষ করা, তাদের ধবংস করা। কেন? একজন ব্যক্তিকে ক্ষমতায় চিরস্থায়ী করা, হাসিনার ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে হবে- সেজন্য আয়নাঘরে নিয়ে যাওয়া হতো, তাই না?
একাত্তরে শহীদ বুদ্ধিজীবী এবং মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক শহীদ জিয়াউর রহমানসহ বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, এখন একটা প্রবণতা-জিনিস লক্ষ করা যাচ্ছে যে, একাত্তরকে একটু পেছনে রাখা। আমার মনে হয়, এটা আরেকটা ওই ষড়যন্ত্রের অংশ- দেশের মূল ইতিহাস থেকে জাতিকে দূরে সরিয়ে দেওয়া। যেমন ’৪৭ সালে পার্টিসেনকে অনেকে বলেন যে, এটা একটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিলো। এখন আবার একটা লক্ষ করছি, একাত্তর সালকে পেছনে রাখা। আমরা মনে করি, এটা ইতিহাস বিকৃতির শামিল। আজকে আমরা ’২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি, কিন্তু আমাদের মূল যে ইতিহাস- সেই ইতিহাসকে আমরা যেন বিকৃত না করি। এই বিষয়টা নিয়ে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। গত ১৫ বছর ধরে ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে- ঠিক তেমনি করে এখন যাতে ইতিহাস বিকৃত না হয়, সেজন্য সকলকে সজাগ থাকার জন্য অনুরোধ করছি।
অন্তর্বর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টার বক্তব্যের নিন্দা জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, একজন উপদেষ্টা যখন এই কথা বলেন যে, রাজনৈতিক দলগুলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ব্যর্থ করার জন্য কাজ করছে- এটা অত্যন্ত ঘোরতর অভিযোগ। আমি তীব্রভাবে এর নিন্দা জানাচ্ছি, প্রতিবাদ করছি। আমি মনে করি, এই ধরনের বক্তব্য তার প্রত্যাহার করা উচিত। দয়া করে রাজনৈতিক দলগুলোকে বা রাজনীতিকে আপনাদের প্রতিপক্ষ বানাবেন না। রাজনৈতিক দলগুলো আপনাদের সহযোগিতা করছে। এটা আপনাদের দায়িত্ব, সেখানে আপনি যদি বলেন যে, এটা ব্যর্থ করার জন্য কাজ করছে। আমরা হাজার বার বলেছি, আমাদের চেয়ারম্যান বলেছেন, আমরা বলেছি- এই সরকার ব্যর্থ হওয়া মানে জনগণ ব্যর্থ হয়ে যাবে, আমরা ব্যর্থ হয়ে যাবো। তাহলে এই রকম কথা কেন বলবেন আপনি?
লন্ডন থেকে গত বৃহস্পতিবার দেশে ফেরা মির্জা ফখরুল বলেন, প্রতিটি মুহূর্ত এখন আমাদের সতর্কতার সঙ্গে পা ফেলতে হবে। আমাদের প্রতিটি কথা, আমাদের মেপে কথা বলা দরকার। আমরা এমন কোনো কথা বলব না যে, সেটি আমাদের এই বিজয়কে নষ্ট করে দেয়, অর্জনকে বিনষ্ট করে দেয়। আমাদের দেশের ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালিয়ে গিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। ভারতে আশ্রয় নিয়ে সে দ্রুত কাজ করছে, সে এরইমধ্যে লন্ডনের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের নিয়ে ডিজিটালি একটা মিটিংও করেছে। দেখবেন যে, তারা (আওয়ামী লীগ) অনেক অপপ্রচার করছে, মিথ্যাচার করছে- যেগুলো বাংলাদেশের জন্য, এই বিপ্লবের জন্য অত্যন্ত উল্টো কথা। তাই আপনাদের গণতন্ত্রের পক্ষে, জনগণের পক্ষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভেতর দিয়ে, কথার মধ্য দিয়ে জবাব দিতে হবে। ফেসবুক, টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিএনপির নেতাকর্মীদের আরও বেশি সম্পৃক্ত হয়ে আওয়ামী লীগের মিথ্যাচার-অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
মির্জা ফখরুলের সভাপতিত্বে এবং প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান, সালাহউদ্দিন আহমেদ, সেলিমা রহমান, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মামুন আহমেদ প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
আর্কাইভ 
| ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪ 
