তোফায়েল আহমেদ
প্রকাশ : ১০ জানুয়ারি ২০২৩, ১০:০৮ এএম
অনলাইন সংস্করণ

বিজয়ের পরিপূর্ণতা অর্জন

বিজয়ের পরিপূর্ণতা অর্জন

বাঙালি জাতির জীবনে ১০ জানুয়ারি অনন্য ঐতিহাসিক দিন। ১৯৭২-এর এই দিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলার মানুষ বিজয়ের পরিপূর্ণতা অর্জন করে। যদিও ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ হানাদারমুক্ত হয়। কিন্তু বাংলার মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি। যতক্ষণ মহান নেতা ফিরে না এসেছেন, ততক্ষণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারেনি। স্বাধীনতা পূর্ণতা পায়, যেদিন জাতির জনক স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে তার স্বপ্নের স্বাধীন সোনার বাংলায় ফিরে এসেছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের ফয়সালাবাদের প্রধান কারাগার লায়ালপুর জেলে রাখা হয়েছিল। আগস্টের মাঝামাঝি সামরিক আদালতে তার বিচার শুরু হয়। বিচারের রায় ছিল পূর্বনির্ধারিত। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের সময় ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন বিনা শাস্তিতে সে পার পাবে না। বিচারটা ছিল প্রহসনের। গোটা বিচার প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি আদালতে চুপচাপ বসে থাকতেন। বিচার প্রক্রিয়া চলাকালে তার পক্ষে নিয়োগ করা আইনজীবী জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘মুজিব নিজের পক্ষে কোনো অবস্থান নিতে চান কিনা।’ উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। আমাকে অথবা আমার জনগণকে বিচার করার কোনো অধিকার এদের নেই। আইনের দিক দিয়ে কোনো বৈধতা এই আদালতের নেই।’

(পাকিস্তানের কারাগারে শেখ মুজিবের বন্দীজীবন, আহমেদ সালিম) ’৭১-এর ৩ ডিসেম্বর, প্রহসনমূলক বিচারের রায়ে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে বঙ্গবন্ধুর ফাঁসির দণ্ড হয়। পরে তাকে লায়ালপুর থেকে স্থানান্তর করা হয় মিয়ানওয়ালি জেলে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘তার কারাকক্ষের পাশে কবর খোঁড়া হয়।’ আহমেদ সালিম লিখেছেন, ‘জেলের ডেপুটি সুপার ফজলদাদ একদিন ব্যারাকে এসে আটজন বন্দিকে বাছাই করলেন। এদের দিয়ে ৮ ফুট লম্বা, ৪ ফুট প্রশস্ত ও ৪ ফুট গভীর গর্ত খোঁড়া হলো।

উপস্থিত সবাই বুঝতে পারলেন সেই রাতেই শেখ মুজিবকে ফাঁসি দেওয়া হবে। ৯টার মধ্যে কবর খোঁড়া সম্পন্ন হলো। কিন্তু সেই রাতে কিছু ঘটল না। ফাঁসি দেওয়ার নির্ধারিত দিন জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করে শেখ মুজিবকে ফাঁসি না দেওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, ‘যদি মুজিবকে ফাঁসি দেওয়া হয় তবে বাঙালির ক্রোধের লক্ষ্য হবে পূর্বাঞ্চলে মোতায়েনকৃত পাকিস্তানি বাহিনীর সর্বোচ্চ অফিসার থেকে সর্বনিম্ন সৈনিক পর্যন্ত সবাই। ভুট্টোর উপদেশ অনুসারে ইয়াহিয়া খান মুজিবের ফাঁসি স্থগিত রাখেন। কয়েকদিনের জন্য কবর ভরাট করা হয়। ১৫ দিন পর একইভাবে গর্ত খোঁড়ার হুকুম আসে। এবারও শেখ মুজিবের ফাঁসি দেওয়া হলো না। এমনি প্রক্রিয়া তিনবার ঘটেছিল এবং তিনবারই তার ফাঁসি পিছিয়ে দেওয়া হয়।’

(প্রাগুক্ত) ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয়ী হলে, ইয়াহিয়া খান সেই আদেশ বাস্তবায়ন করতে পারেননি। পাকিস্তানের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের পর ইয়াহিয়া খানকে অপসারণ করে ভুট্টো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন। ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর কাছে আবেদন করেছিলেন, ‘আমার একটি স্বপ্ন অপূর্ণ রয়ে গেছে, সেটি হলো শেখ মুজিবকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো, আমাকে সেই সুযোগ দেওয়া হোক।’ যে কারণে ভুট্টো মিয়ানওয়ালি কারাগারের জেল সুপার হাবিব আলির কাছে বার্তা পাঠান এবং বঙ্গবন্ধুকে মিয়ানওয়ালি কারাগার থেকে চশমা ব্যারাজে হাবিব আলির বাসভবনে নিয়ে রাখা হয়। এরপর ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অনুনয়-বিনয় করে পাকিস্তানের সঙ্গে একটি সম্পর্ক রাখার জন্য অনুরোধ করেন। বঙ্গবন্ধু ঘৃণাভরে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।

ভারতের আকাশসীমা পাকিস্তানের জন্য নিষিদ্ধ থাকায় বঙ্গবন্ধুর অভিপ্রায়ে তাকে মুক্তি দিয়ে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিতে রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা বজায় রেখে ৮ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার তাকে লন্ডন পৌঁছে দেয়। দ্রুতগতিতে খবরটি ছড়িয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধুকে বরণ করতে ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, তারা বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দেবে। বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে আনুষ্ঠানিকভাবে বরণ করে ব্রিটিশ সরকার। বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে ব্রিটেনের ক্ল্যারিজেস হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। হোটেলে পৌঁছার কিছুক্ষণের মধ্যে তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা লেবার পার্টির হ্যারল্ড উইলসন (পরে প্রধানমন্ত্রী) বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। হ্যারল্ড উইলসন প্রথম কোনো রাজনৈতিক নেতা যিনি করমর্দনের জন্য বঙ্গবন্ধুর দিকে হাত বাড়িয়ে প্রথম উচ্চারণ করেন ‘গুড মর্নিং মিস্টার প্রেসিডেন্ট’। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনায় বাংলাদেশের স্বীকৃতি প্রদানের ব্যাপারে ব্রিটেনের অনুসৃত নীতি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে কনজারভেটিভরা কোনো সিদ্ধান্ত নিলে আমরা পূর্ণ সমর্থন জানাব।’

উল্লেখ্য যে, দেশ স্বাধীনের পর ’৭২-এর ৪ ফেব্রুয়ারি প্রথম পশ্চিমা দেশ হিসেবে ব্রিটেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। বিকেলে বঙ্গবন্ধু ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে যান। সেখানে বঙ্গবন্ধুকে বরণ করেন কনজারভেটিভ পার্টির নেতা প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ। আন্তরিক পরিবেশে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এডওয়ার্ড হিথ বলেন, ‘আপনাকে কী সহযোগিতা করতে পারি বলুন।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি দ্রুত দেশে ফিরতে চাইছি।’ এডওয়ার্ড হিথ ত্বরিতগতিতে ব্যবস্থা নেন। বৈঠক চলাকালেই নিশ্চিত হয় যে, ব্রিটিশ রাজকীয় কমেট জেট বিমানে বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা দেবেন জাতির জনক। বৈঠক শেষে বিদায় নিয়ে বঙ্গবন্ধু যখন গাড়িতে উঠবেন তখন প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ সৌজন্য প্রদর্শন করে গাড়ির দরজা খুলে দেন। কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য কোনো ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এমন সম্মান পূর্বে দেখাননি। এ ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী হিথের সমালোচনা হয়। তিনি সেসব সমালোচনার জবাবে বলেছিলেন, ‘আমি যাকে সম্মান প্রদর্শন করেছি তিনি একটি জাতির মুক্তিদাতা মহান বীর। তাকে এই সম্মান প্রদর্শন করতে পেরে বরং আমরাই সম্মানিত হয়েছি।’ জাতির জনক শুধু বাঙালির বন্ধু নন, তিনি ছিলেন বিশ্বের নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের শ্রেষ্ঠ বন্ধু তথা বিশ্ববন্ধু। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ তাকে এভাবেই সম্বোধন করতেন।

৯ জানুয়ারি লন্ডনে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু একটি বিবৃতি প্রদান করেন। ‘জয় বাংলা’ রণধ্বনি উচ্চারণের মধ্য দিয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলার মুক্তিসংগ্রামে স্বাধীনতার অপরিসীম ও অনাবিল আনন্দ অনুভব করছি। এ মুক্তিসংগ্রামের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। আমার জনগণ যখন আমাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেছে, তখন আমি রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে একটি নির্জন ও পরিত্যক্ত সেলে বন্দিজীবন কাটাচ্ছি। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে সমর্থন ও সহযোগিতা দানের জন্য ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, ফ্রান্স ও ব্রিটেনকে আমি ধন্যবাদ জানাই। স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এখন একটি বাস্তব সত্য। এ দেশকে বিশ্বের স্বীকৃতি দিতে হবে। বাংলাদেশ অবিলম্বে জাতিসংঘের সদস্য পদের জন্য অনুরোধ জানাবে।’ পরিশেষে তিনি বলেন, ‘আমি আর একমুহূর্ত এখানে থাকতে রাজি নই। আমি আমার জনগণের কাছে ফিরে যেতে চাই।’ বিবৃতির শেষে সাংবাদিকরা বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনি যে আপনার বাংলাদেশে ফিরে যাবেন সেই দেশ তো এখন ধ্বংসস্তূপ?’ তখন জাতির জনক উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমার বাংলার মানুষ যদি থাকে, বাংলার মাটি যদি থাকে, একদিন এই ধ্বংসস্তূপ থেকেই আমি আমার বাংলাদেশকে ক্ষুধামুক্ত দারিদ্র্যমুক্ত শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করব।’

লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কালবেলায় সংবাদ প্রকাশ / স্বাধীনতা দিবসের নামে চাঁদা দাবি করায় ইউএনওর ২ স্টাফ বদলি

স্কুটারে বসেই অফিস করছেন তিনি, ভিডিও ভাইরাল

মোস্তাফিজদের ম্যাচ দেখায় নতুন রেকর্ড

এখনো যুদ্ধ করার ক্ষমতা রাখে ফিলিস্তিনিরা

‘বিএনপি নেতাদের কথা শুনলে জিয়াউর রহমানও লজ্জা পেয়ে যেতেন’

কুমিল্লায় গত ১১ মাসে শতাধিক মামলায় গ্রেপ্তার ৪৬৭

বৃষ্টি হলেই সড়ক হয়ে যায় পুকুর, জনদুর্ভোগ চরমে

ব্রিটিশ গণমাধ্যমের তালিকা / পেলে-ম্যারাডোনা নয় সর্বকালের সেরা মেসি

আইপিইউ সম্মেলন শেষে দেশে ফিরলেন স্পিকার

৫ হাজার মূল্যের বাতি ২৭০০০ টাকায় কিনেছে রেল!

১০

মেট্রোরেলের ওপর দিয়ে যাওয়া ইন্টারনেট-ডিসের তার অপসারণের নির্দেশ

১১

২০০ বছরের পুরোনো ‘গায়েবি’ মসজিদের গুপ্ত তথ্য

১২

বিএনপির নেগেটিভ রাজনীতি মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে : ওবায়দুল কাদের

১৩

জজশিপের কর্মচারীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে দুদিনের কর্মশালা অনুষ্ঠিত

১৪

সিরিয়ায় ইসরায়েলি বিমান হামলা, নিহত ৩৬ সেনা

১৫

জাভির পর কে হবেন বার্সা কোচ!

১৬

১ ঘণ্টায় শেষ রেলের ১৪ হাজার টিকিট

১৭

বিজিএপিএমইএর নির্বাচনের প্যানেল ঘোষণা

১৮

গুগলে ৪ বিষয়ে এড়িয়ে না গেলে বিপদ

১৯

নাটোরে স্কুলছাত্রের রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার, ৪ বন্ধু আটক

২০
*/ ?>
X