চিররঞ্জন সরকার
প্রকাশ : ২৪ অক্টোবর ২০২২, ০৯:৪৮ এএম
অনলাইন সংস্করণ

কালীপূজার আখ্যান

কালীপূজার আখ্যান

কেউ কেউ বলেন, গায়ের রং কালো বলে মায়ের নাম কালী। আবার অনেকের মতে, সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তিন কালের আবর্তনচক্রে ঘুরছে। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। এই তিন কালের নিয়ন্তা মহাকাল শিব; কিন্তু মা কালী এই তিন কালের ঊর্ধ্বে। তিনি কালকে জয় করেছেন। কালকে জয় করেছেন বলেই তিনি কালী। আদ্যা-শক্তিস্বরূপিণী

ভারতবর্ষে সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অসংখ্য দেবদেবী কীভাবে শেষ পর্যন্ত গিয়ে এক ভগবানের কাছে সমর্পিত হলেন, সে এক বিশাল আখ্যান। ভগবান কিন্তু ‘এক’, তবে তার প্রধান তিন রূপ। ব্রহ্মা, বিষ্ণু আর শিব। ব্রহ্মা সৃষ্টিকর্তা, বিষ্ণু রক্ষাকর্তা, শিব ধ্বংসকর্তা।

সৃষ্টি-স্থিতি-লয় এই তিনজনকে ঘিরে। সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার আরেক নাম বিশ্বকর্মা। তার নিজের জন্ম নিয়েও নানা কাহিনি। বলা হয়, ‘ব্রহ্মার জন্ম বিষ্ণুর নাভিপদ্মে- প্রলয়জলে অনন্ত শয্যায় সমাসীন থাকেন ভগবান বিষ্ণু আর বিষ্ণুর নাভিপদ্মে উপবিষ্ট থাকেন ব্রহ্মা। বিষ্ণুর নাভিপদ্মে জন্ম বলেই ব্রহ্মা পদ্মযোনি।’

মনু সংহিতায় আছে—‘মহা সলিলে ভাসমান হিরন্ময় অন্ডের অভ্যন্তরে জগৎস্রষ্টার জন্ম।’ আবার এরকম ভাষ্যও আছে যে, ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে প্রতিযোগিতা ছিল। বিষ্ণু ব্রহ্মার উদরে প্রবেশ করে ‘ত্রিলোক দর্শন’ করার পর ব্রহ্মা বিষ্ণুর উদরে প্রবেশ করেন ‘অনন্তলোক’ দর্শনের জন্য।

একপর্যায়ে বিষ্ণু ব্রহ্মার বের হওয়ার সব রাস্তা বন্ধ করে দেওয়ার ফলে ব্রহ্মা তার নাভি দিয়ে বের হন। হিন্দুদের দেবদেবী নিয়ে এমনি নানা কাহিনি প্রচলিত। তবে সব হিন্দুর দেবদেবী এক নয়। স্থান-কাল-পাত্রভেদে দেব-দেবীর গল্প এবং রূপও পরিবর্তিত হয়। একেক এলাকায় একেক দেবতার প্রভাব। কোথাও দুর্গা প্রধান, কোথাও কালী, কোথাও রাম দেবতা তো কোথাও রাবণ।

পৌরাণিক বিশ্বাসমতে, দেবদেবীরা স্বর্গে থাকেন, সেখানেও দেখা যায় মর্ত্যের মতো একইরকম ক্ষমতার সংঘাত, ষড়যন্ত্র, মান-অভিমান। শাপ আর বরের অবিরাম ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। পশুপাখি তো বটেই; সূর্য, বাতাস, ঝড়, সমুদ্র, নদী—সব ভিন্ন ভিন্ন জীবন্ত চরিত্র এখানে। গঙ্গা খুব ক্ষমতাধর দেবী। গঙ্গার তিন রূপ—স্বর্গে মন্দাকিনী, মর্ত্যে গঙ্গা, পাতালে ভগবতী।

কালী বা কালিকা হলেন হিন্দুদের একজন শক্তিশালী দেবী। তার অন্য নাম শ্যামা বা আদ্যাশক্তি। প্রধানত শাক্ত ধর্মাবলম্বীরা কালীপূজা করেন। শাক্তরা কালীকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আদি কারণ মনে করে। বাঙালি হিন্দু সমাজে দেবী কালীর মাতৃরূপের পূজা বিশেষ জনপ্রিয়।

কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে অনুষ্ঠিত সাংবার্ষিক দীপান্বিতা কালীপূজা বিশেষ জনপ্রিয়। এদিন আলোকসজ্জা ও আতশবাজি উৎসবের মধ্য দিয়ে রাতব্যাপী কালীপূজা অনুষ্ঠিত হয়। মা কালী সম্পর্কে ছোটবেলায় অনেক গল্প শুনতাম। বড়রা বলত, মা কালী নাকি অসুর দমন করার জন্য খড়গ হাতে অবতরণ করেছিলেন। অসুরদের আচরণে ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি একের পর এক অসুর দমন করতে থাকেন। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য মা সব কিছু ধ্বংস করে দিচ্ছেন।

মা যে যুদ্ধ করতে করতে বস্ত্রহীন হয়ে পড়েছেন, তাও খেয়াল করেননি। অসুর দমন করে তাদের মুণ্ডু দিয়ে মালা গড়ে মা সেই মালা নিজের গলায় পরলেন। তার ক্রোধে পৃথিবী ধ্বংসপ্রায়। দেবতারা দেখলেন এ মহাবিপদ। মাকে শান্ত করতে না পারলে যে আর বিশ্বব্রহ্মাণ্ড রক্ষা করা যায় না।

তাই তারা ছুটে গেলেন কালীপতী ভোলানাথ শিবের কাছে। সব কথা শুনে ভোলানাথের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। তিনি তৎক্ষণাৎ ছুটে যান কালীর খোঁজে। গিয়ে দেখেন তার স্ত্রী বিবসনা হয়ে গলায় মুণ্ডুমালা ঝুলিয়ে রক্তাক্ত খড়গহাতে যুদ্ধে লিপ্ত। এই দেখে মহাযোগেশ্বর বাহ্যিক জ্ঞান হারিয়ে ভূমিতে লুটিয়ে পড়লেন। মা কালী তখনো যুদ্ধে লিপ্ত।

অসুর দমন করতে করতে মা এগিয়ে যাচ্ছেন। এমন সময় হঠাৎ তার পা গিয়ে পড়ল ভূমিশায়িত শিবের ওপর। অমনি মা জিহ্বা কামড়ে ধরলেন। সেই থেকে যুগ যুগ ধরে মা কালীর এই রূপেরই পূজা করছি আমরা!

কেউ কেউ বলেন, গায়ের রং কালো বলে মায়ের নাম কালী। আবার অনেকের মতে, সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তিন কালের আবর্তনচক্রে ঘুরছে। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। এই তিন কালের নিয়ন্তা মহাকাল শিব; কিন্তু মা কালী এই তিন কালের ঊর্ধ্বে। তিনি কালকে জয় করেছেন। কালকে জয় করেছেন বলেই তিনি কালী। আদ্যা-শক্তিস্বরূপিণী। তবে কালীর যে রূপ, তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে।

স্বয়ং রামপ্রসাদ তার গানের মধ্যে কিন্তু প্রশ্ন করে বসেছিলেন, ‘বসন পর মা’ বা ‘শিব কেন তোর পদতলে, মুণ্ডুমালা কেন গলে’। আজও কালীপূজার সময় পান্নালাল ভট্টাচার্যের গলায় তার এ আকুতি আমরা শুনতে পাই। আমাদের পুলিশ ও গোয়েন্দারা যেমন যে কোনো অপরাধ ও হত্যার ব্যাপারে একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করান, ধর্মগুরুরাও ঠিক তেমনি সব প্রশ্নেরই উত্তর দিয়ে রেখেছেন।

অনেকের কাছে কালীর প্রচলিত রূপ ভয়াল হলেও এরও ব্যাখ্যা রয়েছে। কালী নগ্নরূপী। এর কারণ কী? কারণ মা সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে আবৃত করে রেখেছেন। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এমন কিছু নেই যার দ্বারা মাকে আবৃত করা সম্ভব। তাই তো মা অনাবৃতা।

আরেক মত অনুযায়ী, মা কালী কালের প্রতীক। কাল শূন্যের অনুরূপ ও আচ্ছাদনবিহীন, তাই কালীও দিগম্বর! মা কালী খড়গ হাতে এসেছেন আমাদের ভেতরের অশুভ শক্তিকে দমন করতে। প্রয়োজনে মা আঘাত করেন। আঘাত করেন আমাদের ভেতরকার রজগুণকে। তাই তো মায়ের খড়গ রজগুণের প্রতীক রক্তাক্ত লাল রঙে রঞ্জিত। সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় হলো অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ এই তিন কালের তিনটি ছন্দ। অর্থাৎ সকলকেই কালের গর্ভে নিমজ্জিত হতে হবে।

সংহারিণী কালী অন্তিমে সকল প্রাণীকেই আপন আধ্যাত্ম সত্তাভিমুখে সংহরণ বা আকর্ষণ করে নেন, তাই তার গলায় মুণ্ডুমালা। ভূত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সর্বকালের ঊর্ধ্বে মা কালীর স্থান। আর এই কালের নিয়ন্তা হচ্ছেন মহাকাল শিব। এ থেকে এটাই স্পষ্ট যে মহাকাল শিবের ঊর্ধ্বে মা কালীর স্থান।

তাইতো মহাকালীর পায়ের নিচে শায়িত মহাকাল! এ ছাড়া কালী মহাদেবের শক্তি, সুতরাং শিবের দেহ থেকে শক্তি পৃথক হয়ে বেরিয়ে এলে শিব শক্তিহীন হয়ে শবের মতো পড়ে থাকেন। অর্থাৎ, শিবের প্রভাব শক্তিযুক্ত থাকলেই; নয়তো তাহার নড়াচড়ার শক্তিও থাকে না। শাস্ত্রে কালীকে দুর্গার ললাট থেকে উৎপন্না বলা হয়েছে। কালী আসলে দুর্গার রূপান্তর বিশেষ। ক্রোধাবস্থাপন্না শক্তিকেই কালী বলা হয়েছে।

মানুষের মধ্যে যেমন আচার-আচরণ, স্বভাব-চরিত্রের ভিন্নতা রয়েছে, দেবদেবীর ক্ষেত্রেও তাই। কালী-সংক্রান্ত সবকিছুই যেমন ভয়ানক, তেমনি আবার কৃষ্ণ-সংক্রান্ত সবকিছুই আনন্দপ্রদ। কালীর বাসস্থান ভয়ানক শ্মশান, কৃষ্ণের বাসস্থান মনোহর বৃন্দাবন। কালীর হাতে ভয়ানক খড়গ, কৃষ্ণের হাতে মনোহর বাঁশি। কালীর শরীর রক্তমাখা, কৃষ্ণের শরীর চন্দনশোভিত। কালী গম্ভীর গর্জন করেন, কৃষ্ণ মিষ্টি মিষ্টি কথা বলেন। কালী যুদ্ধে মেতে থাকেন, কৃষ্ণ নাচগান করেন।

কালীর গলায় মুণ্ডুমালা, কৃষ্ণের গলায় ফুলের হার। সংক্ষেপে বললে, কালীর ভয়ানক বেশ, কৃষ্ণের মূর্তি মনোহর। কালীর উপাসকরা নানারকম প্রাণী বলি দেয়, কৃষ্ণের উপাসনায় বলি নিষিদ্ধ। কালীপূজার কাল অমাবস্যা তিথি ও ঘনঘোর অন্ধকার রাত। মৃতদেহের ওপর বসে, শ্মশানে তার সাধনা করতে হয়।

পূজার বাদ্যযন্ত্র ঢাক ও উপহারের ফুল টকটকে লালরঙের জবা। তান্ত্রিকেরা আবার পঞ্চ-মকার দিয়ে ভয়ানক সাধনপ্রণালির বিধানও দিয়েছেন। মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুন—এই ‘পঞ্চ-মকারের’ প্রায় প্রত্যেকই বাইরে থেকে দেখলে এক এক ভয়ানক সাধনপ্রণালি। বাইরে থেকে এই কথা বলার তাৎপর্য এই যে, ওই ‘পঞ্চ-মকারের’ আধ্যাত্মিক ভাব অত্যন্ত নির্মল ও উচ্চ।

লোকনাথ বসু তার ‘হিন্দুধর্ম মর্ম’ নামক বইয়ে পঞ্চ-মকার সম্পর্কে বলেছেন যে, মদ্য বলতে পানীয় মদ বোঝায় না, তা ব্রহ্মরন্ধ্র থেকে ক্ষরিত অমৃতধারা বা ব্রহ্মানন্দ; মাংস মানে দেহের মাংস নয়, তা হলো জিভের সংযম; মৎস্য বলতে মাছ বোঝায় না, তা হলো শ্বাসনিরোধ (প্রাণায়ম); মুদ্রা মানে টাকাপয়সা নয়, বরং আত্মাতে যে পরমাত্মা মুদ্রিত হয়ে আছেন, সেই তত্ত্বজ্ঞান এবং মৈথুন বলতে যৌনসংগম বোঝায় না, তা হলো জীবাত্মাতে পরমাত্মার বিরাজ।

কালীপূজাই বলি কিংবা অন্য যে পূজাই বলি না কেন, এসব পূজা ও দেবদেবীর আখ্যানের মূলে রয়েছে অশুভের বিরুদ্ধে শুভশক্তির লড়াই বা বিকাশ। সেদিক থেকে ধর্ম পালন বা সবাইকে নিয়ে অশুভের বিরুদ্ধে লড়াই—তা কিন্তু নিরন্তর চলছেই। এই লড়াই যেন শেষ হওয়ার নয়!

লেখক : কলামিস্ট ও উন্নয়নকর্মী

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মোংলায় বাল্কহেড ডুবির ঘটনায় নিখোঁজ ব্যক্তির লাশ উদ্ধার

সমাজসেবা অধিদপ্তরে ৩৪৮ জনের বিশাল নিয়োগ 

দেশকে রাহু মুক্ত করতেই বিএনপির আন্দোলন : গয়েশ্বর

মুক্তিযোদ্ধার ছদ্মাবরণে জিয়াউর রহমান ছিলেন পাকিস্তানের চর : পররাষ্ট্রমন্ত্রী 

ফেনীতে পৃথক স্থানে সড়কে ঝড়ল ২ প্রাণ

রাতেই ৯ জেলায় ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের পূর্বাভাস

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে কোলে নিয়ে কাবা দেখালেন নিরাপত্তাকর্মী

রেকর্ড গড়তে ১৩ সেকেন্ডে এক লিটার লেবুর শরবত পান

অনিয়মের অভিযোগে বন্ধ ৮২ লাখ টাকার সড়ক

এমভি আবদুল্লাহর নাবিকদের জন্য দুম্বা আনছে জলদস্যুরা!

১০

পরিসংখ্যান ব্যুরোতে ৭১৪ জনের পুনর্বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, থাকছে না বয়সের ছাড় 

১১

চট্টগ্রামে পোশাক কারখানায় আগুন

১২

বিডিজেএ'র সভাপতি মাসুম, সম্পাদক মাহবুব সৈকত

১৩

অন্তর্বাস না পরায় নারীকে বিমান থেকে নামিয়ে দেওয়ার হুমকি

১৪

ত্বক ঝকঝকে রাখবে তরমুজ

১৫

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বাজারে নেই কার্যত তদারকি

১৬

আঘাতের চিহ্ন পিঠে নিয়ে ভেসে এলো মৃত জোড়া কচ্ছপ

১৭

জাতীয় দিবসে হাসপাতালে আলোকসজ্জা না করায় শোকজ

১৮

১৫ হাজার টিকিটের জন্য ঘণ্টায় ২ কোটিবার চেষ্টা

১৯

চাচার ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ভাতিজা নিহত

২০
*/ ?>
X