সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
প্রকাশ : ২২ ডিসেম্বর ২০২২, ১১:২৭ এএম
অনলাইন সংস্করণ

লেখকরা সমাজ বিপ্লবকে সাহায্য করে বৈকি

লেখকরা সমাজ বিপ্লবকে সাহায্য করে বৈকি

বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে, রাজনৈতিক আবহাওয়া ততই উষ্ণ হয়ে উঠেছে। এবং অস্বাভাবিক রকমের সব ঘটনাও ঘটছে। যেমন যানবাহন ধর্মঘট। ধর্মঘট সাধারণত সরকারবিরোধীরাই ঘটায়; এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ঘটাচ্ছে সরকারপক্ষীয়রাই। বিএনপি সমাবেশ ডাকা শুরু করেছে এবং সমাবেশের ঠিক দুদিন আগে যানবাহন মালিকরা ধর্মঘট ডাকছেন এবং সমাবেশ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ধর্মঘটও গুটিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ধর্মঘট মানেই তো স্বাভাবিক জীবনকে ব্যাহত করা, সরকারের তখন দায় থাকে ধর্মঘট ভাঙবার। এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে সরকার বেশ অসহায়, সরকার বলছে, ‘আমরা কী করব, ধর্মঘট তো করছে যানবাহনের মালিক ও শ্রমিকরা।’ মালিক ও শ্রমিকরা কিন্তু বলতে পারছে না কেন তারা ধর্মঘট করছে। কারণ, তারা তো জানে সত্য প্রকাশ করলে ক্ষতি হবে। বিষণ্ন মনে তারা ধর্মঘটজনিত ছোট ক্ষতিকে মেনে নিচ্ছে বড় ক্ষতিকে প্রতিহত করার প্রয়োজনে।

ওদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা দিয়েছেন যে, এবার খেলা হবে জোরদার। ঘোষণা দিয়েই একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেছেন মনে হয়। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি বলা শুরু করেছে খেলা হবে কী করে, খেলার মাঠটা কোথায়? মাঠ তো সরকারি দলের দখলে। তারা আরও বলছে, মাঠ খোলা না থাকলে, অর্থাৎ নির্বাচনের সময় বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকলে, সরকারের ‘নিয়ন্ত্রণাধীন’ নির্বাচনের পথ তারা মাড়াবেই না। আওয়ামী লীগ নেতা ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, খেলার কথাটা পশ্চিমবঙ্গের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলেছিলেন এবং মানুষ কথাটাকে অপছন্দ করেনি। তা যাই বলুন, পার্থক্য তো রয়েই গেল। মমতা তো লড়ছিলেন বামপন্থিদের বিরুদ্ধে, ক্ষমতা রক্ষায় তারই নিকটাত্মীয় বিজেপির বিরুদ্ধে এখন লড়ছেন, বিজেপি কেন্দ্রীয় শাসনের কর্তা এবং সে-কারণে প্রবল প্রতিপক্ষ। আওয়ামী লীগ খেলবে কার বিরুদ্ধে, বিএনপিকে যদি মাঠে না-ই পাওয়া যায়? খালি মাঠে গোল দেওয়া? সে খেলা কি জমবে?

Link a Story

আ.লীগ সরকার দেশকে অসাম্প্রদায়িক হিসেবে গড়ে তুলছে : প্রধানমন্ত্রী

জনগণের দিক থেকে অবশ্য একটা শঙ্কা থেকেই যায়। সেটা হলো, খেলা যদি শেষ পর্যন্ত হয়ও, তবে সেটা তো হবে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং গ্রহণযোগ্য যে খেলা, ফুটবল খেলা, সেটার মতোই। খেলবে দুই দল, কিন্তু ফুটবলটি আসবে কোথা থেকে? জনগণই কি ফুটবল হয়ে যাবে? খেলোয়াড়দের প্রতিদ্বন্দ্বিতার?

সে যাই হোক, নির্বাচন যদি সর্বাধিক পরিমাণে অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য হয় তাহলেও কি সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে মেহনতি মানুষের কপাল ফিরবে? তারা কি ভালোভাবে বাঁচতে পারবে? কই, ইতিহাস তো তেমন সাক্ষ্য দেয় না। খুব গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিহাস-সৃষ্টিকারী একটা নির্বাচন হয়েছিল ১৯৪৬-এ; তাতে মেহনতিদের ভাগ্য বদলাবে কি, উল্টো খারাপই হয়েছে। এরপর ১৯৭০-এর নির্বাচন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, পূর্ববঙ্গকে স্বাধীন করে দিয়েছে। কিন্তু গণহত্যা কি ঘটেনি এবং মেহনতিদের দুর্দশা কি ঘুচেছে? তাহলে? নির্বাচন যে বুর্জোয়াদের খেলা, তা ফুটবল হোক, কি ক্রিকেটই হোক বা অন্য কিছু হোক, তাতে কোনো সন্দেহ নেই; ওই খেলায় মেহনতিরা কিছু উত্তেজনা পেতে পারে, এমনকি বুর্জোয়াদের ভাবসাব দেখে মেহনতিরা এমনও ভাবতে পারে যে, বুর্জোয়াদের নয়, মেহনতিদের হাতেই ক্ষমতা এসে গেছে কে জিতবে তা ঠিক করে দেওয়ার, কিন্তু সে আনন্দ নিতান্তই সাময়িক। অচিরেই বুঝবে তারা যে তাদের কপাল আগের মতোই ফাটা। জোড়া লাগেনি আদৌ।

জোড়া কি লাগবে অভ্যুত্থানে? অভ্যুত্থানও তো হয়েছে। ঊনসত্তরে হয়েছে; হয়েছে নব্বইয়ে। কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা তো বদলায়নি। বরং আরও পোক্ত ও গভীর হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে কেবল অভ্যুত্থানেও কুলাবে না; অভ্যুত্থান হওয়া চাই সামাজিক বিপ্লবের লক্ষ্যে। তার আভাস আপাতত দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু ওই বিপ্লব ছাড়া যে মুক্তির উপায় নেই সেটা স্বীকৃত সত্য।

এরই মধ্যে আমরা ‘উন্নতি’ করতে থাকব; যদিও তাতে সুখ আসবে না। মানুষ বেকার হবে। বেকার মানুষ ক্ষুধার্ত থাকবে আর ক্ষুধা মানুষকে বেআইনি তথা অপরাধী করে তুলবে। ধরা যাক কেউ চুরি করতে গেছে, সেই ‘চোর’ কিন্তু পুলিশকেই বরং মিত্র ভাববে, জনতাকে নয়। যেমনটা কদিন আগে বরিশালের একটি বাজারে এক মুদির দোকানে ঘটেছে। রাতের বেলা তালা ভেঙে লোকটা ঢুকেছিল দোকানের ভেতরে, কোনটা ছেড়ে কোনটা নেবে ঠিক করতে করতে এবং চোরাই মাল গোছাতে গোছাতে দেখে ভোর হয়ে এসেছে। ভয়ে দিশেহারা হয়ে সে তখন ৯৯৯-তে পুলিশকে ফোন করেছে; এসে যেন তাকে উদ্ধার করে। চোরের আতঙ্ক পুলিশকে যতটা নয়, জনতাকে ততোধিক। অতিঅদ্ভুত জগতের মতো ব্যাপার-স্যাপার। ধারণা করা অসংগত নয় যে, আরও অধিক পরিমাণে দেখা যাবে, উন্নতি মানুষকে নানাভাবে অমানুষ করে তুলছে। অতিশয় উন্নত এই ঢাকা শহরে এমনকি মানুষের একেবারে প্রাথমিক প্রয়োজনগুলোও মিটছে না। মলমূত্র ত্যাগের জন্য টয়লেট পর্যন্ত নেই। কদিন আগে বিশ্ব টয়লেট দিবস উদযাপিত হয়েছে; সে উপলক্ষে খোঁজ নিয়ে নাকি জানা গেছে, ১ কোটি ৭১ লাখ মানুষের বসবাস যেখানে, সেই ঢাকা শহরে পাবলিক টয়লেট রয়েছে মাত্র ১০৩টি। পৌর কর্তৃপক্ষ হয়তো মনে করে যে এই শহরে মানুষ বাস করে না, বাস করেন ফেরেশতারা। আবার পদ্মা সেতু হয়েছে ঠিকই, তাতে মানুষের যে বিস্তর সুবিধা তাও জানা কথা, কিন্তু রাষ্ট্র ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার তো কোনো প্রকার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটেনি, ফলে ঢাকার লোক যে ওই সেতুপথে মফস্বলে গিয়ে বসবাস শুরু করবে এমন ভরসা বৃথা, মফস্বলের লোকেরাই বরং ঢাকায় আরও অধিক সংখ্যায় আসবে, এমনই শঙ্কা। আর এমনও শুনব আমরা, গ্রামে সোয়া চার কোটি টাকা খরচ করে যে সেতু তৈরি করা হয়েছে তাতে উঠতে বাঁশের সাঁকো লাগে, যেমনটা দেখা গেছে ঢাকার কাছেই, ধামরাইতে। শুনতে হবে যে, ঢাকার শুক্রাবাদ এলাকাতে একজন বিউটিশিয়ানকে হোম সার্ভিসে বোনের নাম করে সাভার থেকে ডেকে এনে তিনজন যুবক মিলে ধর্ষণ করেছে, জানব ওই যুবকরা একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। বেকার যুবকরা অবশ্যই আরও অধিক সংখ্যায় মাদকাসক্ত হবে। হতাশার লালনভূমি থেকে জঙ্গি তৎপরতা যে বৃদ্ধি পাবে না এমনটা আশা করা নিতান্ত অসংগত; এবং সড়কে মৃত্যুমিছিল আরও দীর্ঘ হয়ে উঠবে।

Link a Story

ইভিএমের বরাদ্দ না পেলে ব্যালটে নির্বাচন হবে : সিইসি

উন্নতির আঘাতে মানবিক সম্পর্কগুলো সব ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। বড় হয়ে উঠছে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব। পারিবারিক দ্বন্দ্ব রূপ নিচ্ছে গৃহযুদ্ধের। রাজনৈতিক গৃহযুদ্ধের কথা আমরা অনেক সময়েই শুনে থাকি। যেমন একাত্তরের যুদ্ধকে বাইরের জগতের অনেক মহল থেকে চিহ্নিত করা হয়েছিল পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ গৃহযুদ্ধ বলে—বলা হচ্ছিল যে গৃহযুদ্ধ বেধেছে শাসিত পূর্ববঙ্গের সঙ্গে শাসনকারী পশ্চিম পাকিস্তানের। গৃহযুদ্ধ নয়, ওটি ছিল মুক্তিযুদ্ধ। মানুষের মুক্তির জন্য যুদ্ধ আগামী দিনেও সব গৃহযুদ্ধকে পরিণত করা দরকার হবে ওই মুক্তিযুদ্ধে। কোনো এক দেশে নয়, সব দেশে, পৃথিবীব্যাপী। যুদ্ধটা হবে পুঁজির বিরুদ্ধে শ্রমের; শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের। এই যুদ্ধে পুঁজির ও শোষকদের পরাজয়ের ওপরই নির্ভর করছে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ। শত্রুপক্ষের পরাজয় যদি ঘটে তবেই মানুষ তার স্বাভাবিকতা ফেরত পাবে; মানবিক সম্পর্কগুলো জোরদার হয়ে উঠবে। তার আগে নয়।

তবে বাস্তবতার উন্মোচনও সমাজ পরিবর্তনের পক্ষে কাজ করে বৈকি। খুব ভালোভাবেই কাজ করে। আমরা কি ফরাসি বিপ্লবের কথা ভাবতে পারি সে সময়ে লেখকদের রচনার কথা বাদ দিয়ে? রুশ বিপ্লব কি সম্ভব হতো যদি টলস্টয়, দস্তয়ভস্কি ও লেনিন, এমনকি ট্রটস্কি যদি না লিখতেন? লেখকরাও তাদের লেখায় সমাজ বিপ্লবকে সাহায্য করেছে বৈকি

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

দলের বিদায়ে কানসেলোর পরিবারের মৃত্যু কামনা বার্সা সমর্থকদের

যে ভুল হিসাব-নিকাশে ডুবছে ইরান-ইসরায়েল

দুই জেলায় হিটস্ট্রোকে ৩ জনের মৃত্যু

মাদ্রাসার কাছে বিক্রি হলো সিনেমা হল

ভালোবাসার অর্থনীতি

বিভিন্ন পদে জনবল নিয়োগ দেবে ঢাকা বিআরটি

ড্রেনে বোতল-পলিথিন না ফেলতে যুবকদের সচেতনতা

শসার মণ ১শ টাকা, লোকসানে চাষিরা

বাজেটে ইন্টেরিয়র সেক্টর: আমাদের প্রত্যাশা

শিল্পী ধ্রুব এষকে বিএসএমইউতে ভর্তি

১০

এফএ কাপের সেমিফাইনালে হলান্ডের খেলা নিয়ে সংশয়

১১

চলতি মৌসুমে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যশোরে

১২

নিত্যপণ্যের তুলনায় তামাকপণ্য সস্তা, দাম বাড়ানোর দাবি

১৩

মোটরসাইকেল সড়কের বড় উপদ্রব : ওবায়দুল কাদের

১৪

ভোলায় পুকুরে ডুবে ভাই-বোনের মৃত্যু

১৫

দেশের বাজারে কমলো সোনার দাম

১৬

এসএসসি পাসে বিভিন্ন পদে চাকরি দেবে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়

১৭

তুরস্কের সঙ্গে আলোচনায় বসতে যাচ্ছেন হামাস প্রধান

১৮

ড্রিমলাইনারের কারিগরি বিষয়ে বোয়িংয়ের সঙ্গে কথা বলতে বিমানকে মন্ত্রীর নির্দেশ

১৯

নব্য বাকশাল কায়েম করেছে সরকার: মির্জা ফখরুল

২০
*/ ?>
X