১৯ নভেম্বর, ২০২৩, অতর্কিত সামরিক আক্রমণ চালিয়ে ইসরায়েলি বাণিজ্যিক জাহাজ ‘দ্যা গ্যালাক্সি লিডার’ কব্জা করে ইয়েমেনি হুথি সামরিক গোষ্ঠী। এই আক্রমণের কিছুদিন পূর্বে, অর্থাৎ ৩১ অক্টোবর, ২০২৩, গাজা উপত্যকার হাসপাতালে ইসরায়েলের বোমা হামলার প্রতিবাদে ইসরায়েলের দক্ষিণ সমুদ্রবন্দর- ইলাতে মিসাইল ও ড্রোন হামলা চালায় হুথি বিদ্রোহীরা। ইসরায়েলে হামাস ও হিজবুল্লাহর সামরিক আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গতি পোষণ করে হামাসের প্রধান আব্দুল মালেক আল হুথি বলেন, যতদিন না ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি আগ্রাসন সমাপ্ত হবে, লোহিত সাগর ও বাব-এল মান্দেব প্রণালি সংলগ্ন অঞ্চলে ইসরায়েলি মালিকানা ও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিটি জাহাজে হুথিদের হামলা বজায় থাকবে।
লোহিত সাগরে হুতিদের এই সামরিক উপস্থিতি ও বিভিন্ন আধুনিক সমরাস্ত্র ও কৌশলের সাহায্যে বাণিজ্যিক জাহাজে আক্রমণ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও জ্বালানি সরবারহে চরমভাবে আঘাত হানছে। ভূ-রাজনৈতিক, ভূ-কৌশলগত এবং ভূ-অর্থনৈতিক প্রভৃতি কারণে লোহিত সাগর সংলগ্ন অঞ্চল আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এডেন উপসাগর হয়ে বাব-এল-মান্দেব প্রণালি পেরিয়ে লোহিত সাগর, এরপর সুয়েজ খাল ব্যবহার করে ভূমধ্যসাগর, এভাবেই ইউরোপ ও আমেরিকার সঙ্গে এশিয়া অঞ্চলের বেশিরভাগ রপ্তানি বা আমদানি পরিচালিত হয়। অতএব, এই প্রবন্ধে আমরা লোহিত সাগরে সাম্প্রতিক হুথি আক্রমণকে ঘিরে যে আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে তার প্রকৃতি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবো। পাশাপাশি, এই আক্রমণের আঞ্চলিক প্রভাব কি হতে পারে এবং আন্তর্জাতিক জ্বালানি ও বাণিজ্য সরবরাহ ও প্রসারে এই আক্রমণ কতটা প্রকটিত হতে পারে এবং এই অঞ্চলের বৃহত্তম অংশীদার-যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা হুথি আক্রমণের প্রতিক্রিয়া কীভাবে জানাচ্ছে ইত্যাদি বিষয়গুলো জানার চেষ্টা করবো।
হুথিদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিচয়ে প্রধান ভূমিকা পালন করে ধর্ম। হুথিরা শিয়া ইসলামের জা’য়েদি ধারার অনুসারী। জা’য়েদি শিয়ারা তিন ইমামে (হযরত আলী রাঃ, হযরত হাসান রাঃ এবং হযরত হোসেন রাঃ) বিশ্বাসী হওয়ায়, ধর্মীয় আদর্শের ক্ষেত্রে ইরানের শিয়া ইসলাম থেকে হুথিরা যতটা না পৃথক, তারা সুন্নি ইসলামের ততটা নিকটবর্তী। প্রায় হাজার বছর ধরে এই শিয়া মতাদর্শের ভিত্তিতে ইয়েমেনের রাজনৈতিক পরিমণ্ডল পরিচালিত হয়েছে। তবে, ১৯৬০ এর দশকে গামাল আব্দুল নাসেরের অধীনে প্রশিক্ষিত একদল ইয়েমেনি সৈন্য শিয়া সমর্থিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং ইয়েমেনে সুন্নি সমর্থিত সরকার প্রতিষ্ঠা করেন যা ইয়েমেনকে রাজনৈতিকভাবে দুটি ভাগে বিভক্ত করে।
নব্বইয়ের দশকে দুই ইয়ামেন একত্রিত হলেও এই পার্থক্য চলমান থাকে, কারণ নতুন ইয়েমেনের অধিকাংশ নাগরিক প্রাচীন জা’য়েদি ধর্মীয় আদর্শ অনুসারে রাষ্ট্র শাসনের পক্ষে আন্দোলন শুরু করেন যার নেতৃত্বে ছিলেন ইয়েমেনের হুথি পরিবারের প্রধান হুসাইন আল হুথি। আন্দোলনকে প্রশমিত করতে ইয়েমেনের সুন্নি সমর্থিত সরকার গণগ্রেপ্তার, গুম, হত্যা ইত্যাদির মতো কঠোর পন্থা হাতে নেন যা হুথিদের সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে বাধ্য করে। হুসাইন আল হুথির মৃত্যুর পর তার ভাই মালেক আল হুথি যুদ্ধের পরিধি বৃদ্ধি করেন এবং ইয়েমেনের রাজধানী সানা দখল করে নেন। ফলে, সৌদি আরব সৌদি-ইয়েমেন সীমান্ত সুরক্ষার অজুহাতে হুথিদের ওপর বোমা হামলা শুরু করে। এই সময় হুথিরা ইরানের সামরিক বলয়ে যুক্ত হয়ে ইরান থেকে আধুনিক সমরকৌশল, যুদ্ধাস্ত্র ও আর্থিক সুবিধা পেতে থাকে যা হুথিকে সাধারণ গেরিলা বাহিনী থেকে একটি আধুনিক ও কৌশলী সামরিক বাহিনীতে পরিণত করে। ফলে, সৌদি আরব নিজেদের বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক স্বার্থের বিবেচনায় জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় হুথিদের সঙ্গে একটি শান্তি চুক্তির প্রস্তাব দেন যার কাজ এখনো চলমান রয়েছে।
আক্লেড নামক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে, ২০১৫ সাল থেকে লোহিত সাগরে প্রায় পঞ্চাশটি আক্রমণ বা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে যার অধিকাংশই হুথি সামরিক আক্রমণ। ইয়েমেনি গৃহযুদ্ধ ও ইরান থেকে পাওয়া সামরিক কৌশলের আলোকে হুথিরা অনেক আগ থেকেই লোহিত সাগরের ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিক গুরুত্ব আন্দাজ করতে পেরেছিলো। ইউরোপ ও আমেরিকার সঙ্গে এশিয়ার সংযোগে সবচেয়ে সহজ, দ্রুত ও নিরাপদ পথ এই লোহিত সাগর। ফলে, এই জলাপথে রাজনৈতিক প্রয়োজনে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে হুথিরা সামরিক আক্রমণ চালিয়েছে। এই আক্রমণে সামরিক কৌশল ও অস্ত্রের ব্যবহার সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে। যেমন : কৌশল হিসেবে হুতিরা ভূমি কেন্দ্রিক আক্রমণ পরিকল্পনা থেকে আধুনিক কপ্লেক্স সামরিক যুদ্ধ কৌশলকে বেছে নেয়, আবার অস্ত্র হিসেবে হুতিরা ক্রমান্বয়ে মাইন, জাহাজ বিধ্বংসী মিসাইল, ড্রোন, সাবমেরিন ইত্যাদি আধুনিক অস্ত্রের ব্যবহার করা শুরু করে।
এ ছাড়াও, সাম্প্রতিক লোহিত সাগরে হুথিদের সামরিক উপস্থিতিও কয়েকটি পর্যায়ে ঘটেছে। যেমন : প্রথমে হুথিরা ইসরায়েলের দক্ষিণ সমুদ্রবন্দর ইলাতকে লক্ষ্য করে মিসাইল ও ড্রোন হামলা চালানোর চেষ্টা করে যা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের আধুনিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ব্যর্থ হয়। এই পর্যায়ে ব্যর্থ হয়ে হুথিরা লোহিত সাগর ব্যবহারকারী ইসরায়েলি মালিকানা ও ইসরায়েলের বন্দরের উদ্দেশ্য যাওয়া জাহাজগুলোকে জব্দ করা শুরু করে যা বাণিজ্যিক জাহাজ কোম্পানির মালিকদের মধ্যে লোহিত সাগর ব্যবহার করার ক্ষেত্রে ভীতি ও অনিরাপত্তা তৈরি করে। দ্বিতীয় পর্যায়ের এই সফলতায় অনুপ্রাণিত হয়ে হুথিরা ঘোষণা দেন ইসরায়েলের সাথে বাণিজ্য করে এমন যেকোনো দেশের বাণিজ্য জাহাজ হুথিরা জব্দ করবে। এই ঘোষণার পর বড় বাণিজ্য জাহাজের অনেকেই লোহিত সাগর ব্যবহার না করে বাণিজ্যের স্বার্থে আফ্রিকার দীর্ঘ বেবা অন্তঃরীপ পাড়ি দিতে শুরু করে যা স্বাভাবিকভাবে আন্তর্জাতিক সরবরাহ ব্যবস্থায় আঘাত হানে এবং জ্বালানি ও পণ্যের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। এবং সর্বশেষ পর্যায়ে হুথিরা আরও একধাপ এগিয়ে যায়, অর্থাৎ, হুথিরা লোহিত সাগরে ইসরায়েলের পাশাপাশি যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজ চলাচলে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
লোহিত সাগরে হুতিরা কেন এত বড় পরিসরে সামরিক আক্রমণ চালালো বা এখনো চলমান আছে তার সম্ভাব্য কিছু কারণ অবশ্যই রয়েছে। প্রথমে যদি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের তত্ত্ব রিয়েলিজমের চশমায় এই আক্রমণকে দেখি তখন হুথিরা যে ইয়েমেনের ডি-ফ্যাক্টো বা প্রকৃত রাষ্ট্রীয় সত্ত্বায় রূপ নিয়েছে তা চোখে ভেসে উঠবে। হুথিরা নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থকে ইয়েমেনের জাতীয় স্বার্থ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করছে। ফলে, মধ্যপ্রাচ্যের যে নৈরাজ্যপূর্ণ ব্যবস্থা সেখানে নিজেদের বা ইয়েমেনের রাজনৈতিক স্বার্থ বা নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করতে হুথিরা সামরিক শক্তি বৃদ্ধি ও প্রদর্শন করছে। আবার, নিও-রিয়েলিজম বা কাঠামোগত রিয়েলিজমের ভাষায় হুথিদের লোহিত সাগরে সামরিক শক্তি প্রদর্শনকে আন্তর্জাতিক নৈরাজ্যপূর্ণ ব্যবস্থার প্রভাব হিসেবে উল্লেখ করা যায়।
এখানে হুথি যে ইয়েমেনকে প্রতিনিধিত্ব করছে বলে দাবি করে সে-ও এই সিস্টেমের অংশ যে নৈরাজ্য থেকে নিজের স্বার্থ বা নিরাপত্তা রক্ষায় সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে এবং মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় শক্তিসাম্যের অংশ হতে ইরানের সঙ্গে মৈত্রী করে, কারণ এই শক্তি ভারসাম্যই সিস্টেমের প্রতিটি দেশকে তাদের কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক স্বার্থ অর্জনে সহায়তা করতে পারে। আবার যদি ডেটারেন্স বা প্রশমিতকরণ তত্ত্বের আলোকে দেখতে চাই যেখানে শাস্তি প্রদান বা পুরস্কৃত করার লোভে শক্রর সামরিক আক্রমণ বা পদক্ষেপকে প্রশমিত করা যায়। হুথিদের লোহিত সাগরে এই সামরিক আক্রমণের অন্যতম লক্ষ্য তাদের শত্রু ইসরায়েলের আগ্রাসন বন্ধ করা এবং যুক্তরাষ্ট্রকে তার আঞ্চলিক স্বার্থের বিবেচনায় ইসরায়েলকে যাবতীয় সাহায্য দেওয়া থেকে দূরে রাখা।
তাত্ত্বিক আলোচনার বাহিরেও হুথিদের লোহিত সাগরে আক্রমণের বেশ কিছু কারণ উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রথমত, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা লোহিত সাগরে হুথিদের সামরিক আক্রমণের তৎক্ষণাৎ কারণ হিসেবে গাজায় একটি হাসপাতালে ইসরায়েলের বোমা হামলাকে দেখিয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের দেয়া তথ্যমতে, প্রায় ৪-৫ শত ফিলিস্তিন নাগরিক সেই হামলায় নিহত হন এবং অসংখ্য আহত হন। এই হামলার পর হুথি প্রধান আব্দুল মালেক আল হুথি ইসরায়েলের ভূখণ্ড লক্ষ্য করে মিসাইল ও ড্রোন হামলা চালান এবং হামাস ও হিজবুল্লার সঙ্গে যুক্ত হয়ে সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার হুমকি দেন।
দ্বিতীয়ত, আরও একটি কারণ হতে পারে ইয়েমেনের অভ্যন্তরে হুথিদের প্রতি ইয়েমেনিদের ক্ষোভ থেকে ইয়েমেনের দৃষ্টি ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের আগ্রাসনের দিকে ফেরানো। অর্থাৎ, হুথিরা রাজধানী দখল করে ইয়েমেনিদের বিভিন্ন উন্নয়নের আশ্বাস দিয়েছিল বিশেষত অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত। কিন্তু গৃহযুদ্ধের ফলে সে আশ্বাস আর বাস্তবে রূপ নিতে নেয়নি, এমনকি বিভিন্ন পর্যায় থেকে হুথিদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয় যা হুথিরা কঠোর হস্তে দমন করে। ফলে দেশজুড়ে হুথিদের বিপরীতে জনমনে যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়, লোহিত সাগরের ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সামরিক অবস্থান সেই ক্ষোভের বদলে হুথিদের প্রতি সমর্থন এনে দেয়। হুথিদের ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে ইসরায়েল ও পশ্চিমাদের বিপরীতে এই সামরিক শক্তি প্রয়োগ ইয়েমেনীয় ছাড়াও গোটা অঞ্চলের মুসলিমদের সমর্থন পায়।
তৃতীয়ত, সাম্প্রতিক লোহিত সাগরে হুথিদের সামরিক আক্রমণে সৌদি আরব কোন পক্ষ অবলম্বন করেনি। এর কয়েকটি কারণ রয়েছে। যদিও গৃহযুদ্ধের কালে পশ্চিমা ও গালফভুক্ত সৌদি মিত্রদের সাহায্যে সৌদি আরব হুথিদের পরাজিত করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু বর্তমান হুতি আক্রমণের প্রেক্ষাপট ভিন্ন- অর্থাৎ, ফিলিস্তিন প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে এই আক্রমণ হচ্ছে। ফলে, সৌদি আরব তার ২০৩০ আঞ্চলিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে, তার জ্বালানি সরবরাহ নিরাপদ রাখতে, হুতিদের সাথে শান্তি চুক্তিটি সফলভাবে বাস্তবায়নে এবং হুথির বিপরীতে গিয়ে গোটা মুসলিম বিশ্বের রোষানলে পড়ার থেকে বাঁচতে সম্প্রতি হুথি আক্রমণে চুপ থাকছে। আর হুথিদের কাছে সৌদি আরবের এই দুর্বলতাগুলো সুযোগে রূপান্তরিত হয়েছে।
চতুর্থত, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে হুথির আদর্শগত বিরোধও এই সামরিক আক্রমণের অন্যতম কারণ। ‘আমেরিকার মৃত্যু হোক, ইসরায়েলের মৃত্যু হোক, ইহুদিদের জন্য সকল অভিশাপ এবং ইসলামের বিজয় সুনিশ্চিত’- এই স্লোগানকে পুঁজি করে ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে হুথিরা সৌদি সমর্থিত ইয়েমেনী সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। এই স্লোগান বা আদর্শকে পুঁজি করে হুথিরা যুক্তরাষ্ট্রকে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে উল্লেখ করেছে যা স্থানীয়দের মধ্যে হুথিদের জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে। লোহিত সাগরে হুথি আক্রমণ এই আদর্শগত বিরোধ হুথিকে আরও বেশি করে সংঘাতে জড়াতে সাহায্য করবে।
পঞ্চমত, এবং সর্বশেষ- লোহিত সাগরে হুথি আক্রমণের আরও একটি কারণ হতে পারে ইরানের বলয়ে নিজের অবস্থানকে আরও স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী করা। অর্থাৎ, যদিও হামাস, হিজবুল্লার মত হুথি নিজেও ইরানের বলয়ের অংশ কিন্তু ইরানের দেখানো পথ অনুসারে হিজবুল্লাহ বা ইরাকি রেসিস্ট্যান্ট আর্মি (আইআরএ) –যেভাবে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমতা বজায় রেখে চলে, হুথি বা হামাস সেভাবে চলে না। সাম্প্রতিক লৌহিত সাগরে হুথিদের আক্রমণ এবং যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যকেও সরাসরি হুমকি দেওয়া থেকে বুঝা যায় হুথিরা নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে প্রয়োজনে ইরানকেও এড়িয়ে যেতে পারে।
লোহিত সাগরে হুথি আক্রমণের প্রভাব ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বৈশ্বিক জ্বালানি চাহিদার একটি বড় অংশ এই আক্রমণের ফলে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। যেমন : ২০২৩ সালে বৈশ্বিক তেল বাণিজ্যের প্রায় ১২ শতাংশ ও এলএনজি বাণিজ্যের প্রায় ৮ শতাংশ লোহিত সাগর ব্যবহার করে হয়েছে। নেদারল্যান্ড, ইতালি, ফ্রান্সের মত খনিজ তেল ও এলএনজি নির্ভর দেশগুলো তাদের জ্বালানি আমদানির জন্য এই পথ ব্যবহার করে থাকে। এনার্জি ইন্টেলিজেন্স গবেষণা গ্রুপের তথ্যমতে, হুথি আক্রমণের ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলারের বড় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং এর পরিমাণ ক্রমান্বয়ে আরও বৃদ্ধি পেতে পারে।
অন্যদিকে, পশ্চিমের সঙ্গে এশিয়ার প্রায় ৪০ শতাংশ বাণিজ্যই এই লোহিত সাগরের পথ ব্যবহার করে হয়ে থাকে। ফলে, বড় বাণিজ্যিক জাহাজ যদি এই সহজ ও দ্রুত পথটি ব্যবহার না করে, নিরাপত্তার স্বার্থে আফ্রিকা হয়ে দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রা করে, তবে একদিকে পণ্য সরবরাহ অনেক বিলম্বিত হবে যাতে দক্ষিণের উৎপাদক বা রপ্তানিকারক দেশগুলো বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হবে। অন্যদিকে বৈশ্বিক বাজারে পরিবহণ খরচ বৃদ্ধির কারণে পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাবে। তবে, ইসরায়েলের আর্থিক ক্ষতি অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম হবে, কারণ হুথি আক্রমণে এশিয়ার সঙ্গে ইসরায়েলের বাণিজ্য হ্রাস পেলেও, পশ্চিমের সঙ্গে ভূ-মধ্যসাগরের মাধ্যমে বাণিজ্য স্বাভাবিকই থাকবে। এ ছাড়াও, হুথিদের সামরিক আক্রমণের প্রভাব ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধে কতটা পড়বে, আসলে কি এই সংঘাত আঞ্চলিক সংঘাতে রূপ নিবে ইত্যাদি নির্ভর করবে কয়েকটি বিষয়ের উপর। যথাঃ (ক) হুথিদের এই সামরিক আক্রমণের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের সীমা কতটুকু, (খ) ইসরায়েল ও পশ্চিমা শক্তির বিপরীতে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার সামরিক সক্ষমতা হুথিদের কতটুকু এবং (গ) লোহিত সাগরের আঞ্চলিক শক্তিগুলো হুথি আক্রমণকে কতটুকু রাজনৈতিক গুরুত্ব দিয়ে দেখবে তার ওপর।
লোহিত সাগরে হুথি আক্রমণের কড়া জবাব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত পশ্চিমা শক্তি। জর্ডানে হুথি মিসাইলের আঘাতে তিন মার্কিন সৈন্য নিহত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সচিব ললোয়েড অস্টিন বলেন, লোহিত সাগর সংলগ্ন অঞ্চলের ইরানের আশীর্বাদপুষ্ট সামরিক শক্তি- হুথির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে যুক্তরাষ্ট্র। ফলস্বরূপ, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সমন্বিতভাবে ইয়েমেনের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ হুথি স্থাপনায় বোমা হামলা চালায়। এ ছাড়াও, ইসরায়েলকে সঙ্গে নিয়ে লোহিত সাগরে হুথিদের ছোড়া অধিকাংশ মিসাইল ও ড্রোন ভূপাতিত করে যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়া কয়েকটি হুথি নৌযান টার্গেট করে আক্রমণ চালায় যাতে দশের অধিক হুথি সেনা নিহত হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিক্রিয়ার কড়া সমালোচনা করে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ও বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষায়, যুক্তরাষ্ট্রের এহেন সামরিক প্রতিক্রিয়া কার্যত লোহিত সাগর কেন্দ্রিক সংঘাতকে আঞ্চলিক সংঘাতে পরিণত করতে পারে যা মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের জন্য, বিশেষত সিরিয়া ও ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটিকে লক্ষ্য করে ইতোমধ্যেই বিভিন্ন সামরিক দল যেমন ইরাকি রেসিস্টান্ট আর্মি হামলা চালিয়েছে। এছাড়াও, যুক্তরাষ্ট্রের এই সামরিক আক্রমণ ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্বকে আরও প্রসার ঘটাতে পারে। ফলে, এই অঞ্চলে চীন, তুরস্ক ও রাশিয়ার মত শক্তিদের অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে যা যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অবস্থার জন্য হুমকিস্বরূপ। এছাড়াও, যুক্তরাষ্ট্র অপারেশন প্রোস্পারিটি গার্ডিয়ান শিরোনামে হুথিদের বিভিন্ন স্থাপনায় বোমা হামলা চালালেও, লোহিত সাগরে হুথিদের সামরিক উপস্থিতির কোনো হ্রাস ঘটাতে পারেননি। কারণ, দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের অভিজ্ঞতায় হুথিরা শিখেছে কীভাবে ভয়ানক বোমা হামলার মধ্যেও টিকে থাকতে হয় এবং পাশাপাশি নিজের স্বার্থ আদায় করতে হয়। সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হুথিদের কৌশলগত দিক থেকে বিবেচনা করা।
পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের এই সত্যটিও উপলব্ধি করা উচিত ইরানের সহযোগিতায় মধ্যপ্রাচ্যে হুথিদের মত অনেক সামরিক গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটেছে যারা আফগানিস্তানের ন্যায় মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রত্যাহারকে নিজেদের রাজনৈতিক বিজয় হিসেবে গ্রহণ করবে এবং ভবিষ্যৎ যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি সরবরাহ ও কৌশলগত অবস্থানের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। সর্বোপরি, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল নীতিকে পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন, অন্তত বাইডেন সরকার এখন সে বিষয়টাই ভাবছে। কারণ, ইসরায়েলের এই সামরিক আগ্রাসনকে সমর্থন দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে শুধু মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক নিরাপত্তায় নিজেকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে, যুক্তরাষ্ট্রসহ তার পশ্চিমা মিত্রের রাজনৈতিক ও জনমনে যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েলপন্থি অন্ধ বৈদেশিক নীতির সমালোচনা তৈরি হচ্ছে যা হয়ত ২০২৪-এর আমেরিকার নির্বাচনী প্রচার প্রচারণায় নতুনভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
বদিরুজ্জামান : রিসার্চ অফিসার, বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট (বিইআই)
মন্তব্য করুন