মোঃ রিফাত-উর-রহমান
প্রকাশ : ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৩:২৫ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

বাংলাদেশে প্রত্নস্থলভিত্তিক হোমস্টে পর্যটনের সম্ভাবনা

বাংলাদেশে প্রত্নস্থলভিত্তিক হোমস্টে পর্যটনের সম্ভাবনা। ছবি : সৌজন্য
বাংলাদেশে প্রত্নস্থলভিত্তিক হোমস্টে পর্যটনের সম্ভাবনা। ছবি : সৌজন্য

পৃথিবীর অনেক দেশ তাদের সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক ঐতিহ্যগুলোকে পর্যটকদের কাছে উপস্থাপনের জন্য বিভিন্ন ধরনের পর্যটন চালু রেখেছে। এরমধ্যে খুব জনপ্রিয় এবং গ্রহণযোগ্য পর্যটন ব্যবস্থা হলো হোমস্টে পর্যটন। হোমস্টে হলো টেকসই পর্যটনের একটি কার্যকর রূপ যেখানে পর্যটকরা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং প্রাকৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারে। বাংলাদেশ আয়তনে ছোট হলেও বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সমৃদ্ধ একটি দেশ। বঙ্গীয় উপত্যকার গাঙ্গেয়-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদী এবং সেগুলোর শাখা-প্রশাখা অত্যন্ত গতিশীল এবং তাদের গতিপথ ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে, যা দেশকে বহুমাত্রিক করে তুলেছে।

যদিও দেশটি অনেক খাতে পিছিয়ে আছে, তথাপি গত কয়েক দশকে এটি ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে, বিশেষ করে ২০১৪ সালে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পর ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে, বাংলাদেশকে একটি নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে, বিশেষ করে যেহেতু দেশের পর্যটনশিল্প এখনও টেকসই পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে বিকশিত হতে পারেনি এবং টেকসই পর্যটন এসডিজির অন্যতম লক্ষ্য, যদি এটি পরিকল্পনা অনুযায়ী সংগঠিত করা না যায়, তবে বাংলাদেশের জন্য এসডিজি লক্ষ্য পূরণ বেশ কঠিন হয়ে যাবে।

বাংলাদেশে গ্রামভিত্তিক কৃষি পেশা অব্যাহত থাকলেও, প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে এই অঞ্চলে একটি সমৃদ্ধ নগর সংস্কৃতি গড়ে ওঠে যার মধ্যে উয়ারী-বটেশ্বর (৪৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) এবং মহাস্থানগড় (৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়াও, বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক এদেশের পাঁচ শতাধিক প্রত্নস্থল সংরক্ষিত হয়েছে, যার মধ্যে সোমপুর মহাবিহার এবং বাগেরহাট মসজিদ শহরের স্থাপনাসমূহ ইউনেস্কো-স্বীকৃত বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।

বাংলাদেশ একটি অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়ায় দেখা গেছে দেশের অধিকাংশ প্রত্নস্থলের আশপাশে স্থানীয়রা বাস করে থাকেন এবং স্থানীয়দের প্রত্নস্থলের জন্য হুমকি হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে, স্থানীয়দের প্রত্নস্থল ব্যবস্থাপনার অন্যতম প্রধান অংশীজন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ ছাড়াও, বিশ্ব পর্যটন সংস্থা (ডব্লিউটিও, পর্যটনে স্থানীয়দের অন্তর্ভুক্ত করার ওপর অধিকতর গুরুত্বারোপ করেছে। সুতরাং, বাংলাদেশের প্রত্নস্থলের আশপাশে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে কীভাবে টেকসই পর্যটন পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা যায় সে বিষয়ে একটি কার্যকর ও টেকসই পরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশের জলবায়ু সাধারণভাবে ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ু নামে পরিচিত। জলবায়ুগতভাবে মানুষের বসবাসের জন্য উপযোগী এই অঞ্চলটি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বদ্বীপ হিসেবে পরিগণিত। অনুকূল পরিবৈশিক প্রেক্ষিতের কারনে হয়তো বহুকাল ধরে এই অঞ্চলে মানুষ বসতি স্থাপন করে আসছে। এই ধারণাগুলো কিছুটা পাওয়া যায় এদেশের প্রত্নস্থলগুলো থেকে। যদিও, শুধু নগরভিত্তিক অভিজাত সম্প্রদায়ের অতীতের ইতিহাস বিনির্মিত হয়েছে, তথাপি এটি অনুমেয়, এদেশের গ্রামীণ সমাজ-সংস্কৃতির গভীরতর ধারাটি পুরোপুরি নদীকেন্দ্রিক ছিল। বঙ্গীয় উপত্যকার গাঙ্গেয়-ব্রহ্মপূত্র-মেঘনা অববাহিকায় গড়ে ওঠা এই ভূমিতে হাজার বছর ধরে চলমান বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি রয়েছে।

হোমস্টে পর্যটন বর্তমানে অনেক দেশে প্রচলিত, এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতেও হোমস্টে পর্যটন ইতোমধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যতার পাশাপাশি সমৃদ্ধ প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও কেন আমরা সেগুলো বৈশ্বিক পর্যটকদের কাছে তুলে ধরতে পারছি না? যেহেতু এটি রাজস্ব আয়ের একটি অত্যন্ত লাভজনক উৎস, তাই বাংলাদেশের প্রত্নস্থলগুলোকে যথাযথভাবে সংরক্ষণের মাধ্যমে স্থানীয়দের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করে কীভাবে একটি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় তার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে গভীরতর গবেষণা পরিচালনা করা প্রয়োজন। যেহেতু হোমস্টে পর্যটন বিকশিত হলে স্থানীয়দের অর্থ রোজগারের পথ উন্মুক্ত হবে এবং অর্থ উপার্জনের পথ প্রশস্ত হলে স্থানীয়রা নিজ উদ্যোগে এ দেশের প্রত্নস্থলসমূহকে সযত্নে সংরক্ষণ করায় আগ্রহী হবেন।

কিছুদিন আগে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের নিয়ে মহাস্থানগড়ের প্রত্নস্থলভিত্তিক একটি সমীক্ষা পরিচালনা করতে গিয়ে আমরা ভীষণভাবে হতাশ হয়েছি। প্রায় দুই হাজার তিনশত বছরের পুরোনো একটি সমৃদ্ধ নগরকেন্দ্রকে কতটা অবহেলা আর অযত্নে আমরা ফেলে রেখেছি। প্রশিক্ষিত কোনো পর্যটক গাইড নেই সেখানে। গোকুল মেধের সামনে অনেক ভ্যানচালক রয়েছে। যারা সকলেই অপেশাদার গাইড হিসেবে কাজ করেন।

আবু বকর নামক একজন ভ্যানচালকের সঙ্গে পরিচয়ের পরে বুঝলাম মহাস্থানগড়ের সঙ্গে তার হৃদয়ের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। বকর ভাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করার সুযোগ না পেলেও কাজ করতে করতে প্রত্নতত্ত্বকে ভালোবেসে ফেলেছেন। তিনি আমাদের নতুন কয়েকটি সাইট ঘুরে দেখালেন। যে কোনো প্রত্নবস্তু দেখামাত্র তিনি সেটি সম্পর্কে ধারণা দিতে পারেন। আরও অবাক করার বিষয় হলো, বকর ভাইয়ের স্ত্রী এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও মহাস্থানগড়ে আগত পর্যটকদের নিয়ে অনেক চমৎকার কিছু সুপারিশ জানালেন। আনুমানিক পঁয়ষট্টি বছর বয়সী বকর ভাই প্রায় চল্লিশ বছর ধরে মহাস্থানগড়ে ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। তিনি স্ত্রী ও চার সন্তানসহ মহাস্থানগড় জাদুঘরের পেছনের গ্রামে বাস করেন। ভ্যান চালানোর পাশাপাশি বকর ভাই দিনমজুর হিসেবে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে খণ্ডকালীন কাজ করেন।

তিন প্রজন্ম ধরে সেই বাড়িতে থাকার ফলে বকর ভাইয়ের অভিজ্ঞতাগুলো আমাদের গবেষণার উদ্দেশ্য পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, বিশেষত তিনি তার অভিজ্ঞতার আলোকে একজন দক্ষ গাইড হিসেবে মহাস্থানগড়ের বিবরণ আমাদের ব্যাখ্যা করেছিলেন। কোন ধরণের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াও নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি প্রত্নতত্ত্ব সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেছেন এবং আশ্চর্যের বিষয় যিনি কখনও স্কুলে যাননি সেই তিনি মহাস্থানগড় সম্পর্কে একজন শিক্ষাবিদের থেকে কম ধারণা রাখেন না। সবচেয়ে বড় কথা, মহাস্থানগড় রক্ষার বিষয়ে তার ধারণা আমাদের আশার আলো দেখিয়েছে।

ভ্যানচালক বকর ভাই বিশ্বাস করেন যে একটি প্রত্নস্থান রক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো স্থানীয়দের সক্রিয় অংশগ্রহণ। কারণ দীর্ঘদিন ধরে প্রত্নস্থলের পাশে বসবাসের কারণে প্রত্নস্থলের সঙ্গে স্থানীয়দের গভীরতর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তবে বেশিরভাগক্ষেত্রে প্রত্নস্থান রক্ষার নামে স্থানীয়দের সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করা হয়ে থাকে। তার অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি দর্শনার্থীদের জন্য মহাস্থানগড়ে অপর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাবও অনুভব করেন। সেক্ষেত্রে, তিনি পরামর্শ দেন যে স্থানীয়দের অন্তর্ভুক্ত করে প্রত্নস্থলগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করে হোমস্টে পর্যটনের জন্য কার্যকর ও টেকশই পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার।

এ ছাড়া দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শত শত প্রত্নস্থল। তবে, এটিও অনস্বীকার্য, বাংলাদেশ একটি অতি জনবহুল দেশ। ইচ্ছে করলেই একটি প্রত্নস্থল সংরক্ষণের নামে স্থানীয়দের উচ্ছেদ করা সম্ভব নয়। তাহলে প্রত্নস্থল সংরক্ষণ হবে কীভাবে? এক্ষেত্রে, আমাদের প্রস্তাব হলো, যে কোনো প্রত্নস্থল সংরক্ষণের ক্ষেত্রে স্থানীয়দের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয়দের মধ্যে সেই বোধটুকু সঞ্চারিত করতে হবে যে এই প্রত্নস্থলগুলোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন তারাও। প্রত্নস্থল সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ইউনেস্কো নীতিমালা, ভেনিস সনদ, নারা চার্টার ইত্যাদি অনেক আন্তর্জাতিক আইন রয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনগুলো প্রয়োগের পূর্বে নিজের দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিত গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ঘনবসতিপূর্ণ এই দেশে সবকিছু আইন দিয়ে বাস্তবায়ন করা অনেক দুরূহ একটি বিষয়। প্রয়োজন হলে, প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণ নীতিমালা সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করুন। পরিত্যক্ত প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণের নামে ‘লিভিং হেরিটেজ’ –কে কোনোভাবেই ধ্বংস করা সমীচীন হবে না।

রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা আমার তত্ত্বাবধানে সিরাজগঞ্জ জেলার ক্ষিরতলা গ্রামে গত ছয় বছর ধরে গবেষণা পরিচালনা করে আসছে। গ্রামটি মূলত আদিবাসী অধ্যুষিত এবং একইসাথে গ্রামটির বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে প্রত্নস্থলের ধ্বংসাবশেষ। অতীত এবং বর্তমান সংস্কৃতির সম্মিলনে গ্রামটিকে বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে। প্রখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক আবুল কালাম মোহাম্মদ জাকারিয়া বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ গ্রন্থে দেশের অন্যান্য প্রত্নস্থলের পাশাপাশি ক্ষিরতলা গ্রামের প্রত্নস্থানের বিষয়েও আলোকপাত করেছিলেন। তার পরিচালিত জরিপে তিনি পঞ্চাশটি প্রাচীন ঢিবির কথা উল্লেখ করেছেন। যদিও দুর্ভাগ্যবশত বর্তমানে একটি ঢিবির কিছু অংশ যা স্থানীয়দের কাছে বিরাট রাজার ঢিবি নামে পরিচিত এবং অন্যান্য কয়েকটি ঢিবির ক্ষুদ্র অংশ এখনও টিকে আছে।

আমাদের পরিচালিত সমীক্ষায় প্রতিটি ঢিবি থেকে আমরা প্রত্নবস্তুর ধ্বংসাবশেষ, বিশেষ করে প্রাচীন ইট, ইটের টুকরা, মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ এবং পোড়ামাটির ফলক সংগ্রহ করে গবেষণা অব্যাহত রেখেছি। এ ছাড়াও গ্রামটিতে বেশ কয়েকটি বড় পুকুর রয়েছে। পুকুরগুলোর ধারে প্রত্নবস্তুর অস্তিত্ব এখনও বিদ্যমান।

ক্ষিরতলার প্রত্নস্থলগুলোর কাছাকাছি মাহাতো, শিং, তেলি, পাহান, ওঁরাও, এবং সাঁওতাল জনগোষ্ঠী বাস করেন। দীর্ঘকাল ধরে প্রত্নস্থলগুলোর কাছে বাস করার কারনে প্রত্নস্থলের সাথে তাদের আন্তসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিনির্মিত হয়েছে প্রত্নস্থলভিত্তিক বাচনিক ইতিহাস। আদিবাসীরা আর্থিকভাবে বেশ অস্বচ্ছল। প্রতিটি আদিবাসী গোত্রের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যতা রয়েছে। সহরায়, কারাম, ফাগুয়া উৎসবগুলো অনেক আনন্দের সাথে তারা উদযাপন করে থাকে। এ ছাড়াও, তাদের ঝুমুর নৃত্যের মাধ্যমে নারী-পুরুষের সংহতিপূর্ণ সম্পর্কের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। আমরা যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে গ্রামটিতে যাওয়া আসা করছি তাই স্থানীয় আদিবাসীদের সাথে আমাদের অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। স্থানীয় স্কুলের প্রধান শিক্ষক জোনিল মানাতো, শিক্ষক রামকুমার মাহাতো, শ্যামল মাহাতো, কুর্মালি ভাষার গবেষক উজ্জ্বল মাহাতো প্রমুখদের সাথে আমাদের এতো গভীর সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে যে এই গ্রামে গেলে আমাদের আর রাত্রিযাপনের জন্য আলাদা করে ভাবতে হয় না। গবেষণার জন্য জোনিল মাহাতো তার স্কুল ঘরে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দেন।

এভাবেই আমরা প্রত্নস্থল শনাক্ত করার পাশাপাশি স্থানীয় আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে জাতিতাত্ত্বিক সমীক্ষা পরিচালনা শুরু করেছি। একপর্যায়ে আমরা লক্ষ্য করেছি এই গ্রামের প্রসূতি নারীদের অনেকেই সিজারিয়ান পদ্ধতি অনুসরণ না করে প্রথাগত পদ্ধতিতে শিশুজন্মদান করে থাকেন। যদিও, বর্তমানে সেই পদ্ধতিগুলোও হারিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় ধাত্রীদের সাথে আলোচনাপূর্বক আমরা জানতে পেরেছি এসব লোকায়ত জ্ঞানগুলোকে তারা বহুকাল ধরে চর্চা করে আসছেন। জন্ম, বিয়ে মৃত্যুভিত্তিক ক্ষিরতলার আদিবাসীদের আচার-রীতি-নীতি নিয়ে আমাদের গবেষক দল এখনও গবেষণা অব্যাহত রেখেছে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে খুব কম গ্রাম রয়েছে যেখানে একইসাথে অতীত ও বর্তমানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বৈচিত্রতা বিদ্যমান। এদিক দিয়ে ক্ষিরতলা একটি অনন্য গ্রাম। ক্ষিরতলার আদিবাসীরা আর্থিকভাবে অসচ্ছল হলেও অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ। প্রায় প্রতিমাসেই তাদের নিজস্ব উৎসব রয়েছে। এই বিষয়গুলো হতে পারে হোমস্টে পর্যটন বিকাশের অন্যতম বিবেচ্য বিষয়। পর্যটকদের কাছে প্রত্নস্থল এবং আদিবাসীদের ঐতিহ্যগুলোকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে পারলে ক্ষিরতলা গ্রামকেন্দ্রিক একটি হোমস্টে পর্যটন শিল্পের বিকাশের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং আদিবাসীদের আর্থিক প্রণোদনা দিতে পারলে ক্ষিরতলা হবে পর্যটকদের আকর্ষণের অন্যতম প্রধান গন্তব্য।

আমরা যেহেতু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পর্যটক গাইড সম্পর্কিত পৃথক বিষয় সম্পর্কে পাঠদান করি না, তাই আমরা জানিনা প্রত্নস্থলভিত্তিক হোমস্টে পর্যটনশিল্প গড়ে তোলার জন্য সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কীভাবে আকর্ষণ করতে হয়! অথচ এদেশে এখন অর্ধ শতাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। আমাদের মনে রাখা দরকার টেকশই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে পর্যটন একটি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর। তাহলে আমরা কেন প্রত্নস্থানভিত্তিক হোমস্টে পর্যটন ব্যবস্থাপনায় মনোযোগী হচ্ছি না? এই সেক্টরে প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বব্যাপী অতিথিপরায়ণ জাতি হিসেবে পরিচিত; যদিও, দেশের আয়তন ছোট এবং দারিদ্র্যের হার বেশি, তবুও এদেশের মানুষ অতিথি আপ্যায়ন করতে কখনোই দ্বিধা করে না। প্রত্নস্থলভিত্তিক হোমস্টে পর্যটনশিল্প বিকাশের জন্য এটি হতে পারে একটি কার্যকর উপাদান। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এদেশ স্বাধীনতা পরবর্তী গত তেপ্পান্ন বছরে অনেকক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। এখন বংলাদেশকে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। তাই, এসডিজির কাঠামো অনুযায়ী প্রতিটি সেক্টরে সমান সাফল্য অর্জন করা অপরিহার্য। টেকসই পর্যটন, দারিদ্র্যতা হ্রাস, লিঙ্গীয় সমতা ইত্যাদি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশকে অবশ্যই একটি নতুন এবং টেকসই পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।

যেহেতু বাংলাদেশে প্রত্নস্থলভিত্তিক টেকসই এবং পরিকল্পিত হোমস্টে পর্যটন বিকাশের অপার সম্ভাবনা রয়েছে, তাই এই সেক্টরকে ঘিরে নীতি-নির্ধারকদের নতুন পরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। আর এই পরিকল্পনা সঠিকভাবে প্রয়োগ করা গেলে বাংলাদেশ হয়ে উঠবে হোমস্টে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় একটি গন্তব্য।

মো. রিফাত-উর-রহমান : সভাপতি, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

দিনাজপুরে দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড

শিক্ষার্থীদের জন্য রাস্তা সংস্কারে ছাত্রদল

পাঠ্যপুস্তক সংশোধন কমিটিতে ইসলামি বিশেষজ্ঞ না থাকায় উদ্বেগ 

আজারবাইজানের আকাশ কাঁপাবে পাকিস্তানি জেএফ-১৭

পাঠ্যপুস্তক সংশোধন কমিটি নিয়ে আহমাদুল্লাহর কড়া বার্তা

তেঁতুলিয়ায় ১৭৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড

ওয়াশিংটনে কাদের গনি চৌধুরী / রাষ্ট্র পরিচালনায় পরিবর্তন আনতে না পারলে বিপ্লবের কাঙ্ক্ষিত ফল মিলবে না

শিষ্যের এমন বিদায়ে ‘দুঃখ ভারাক্রান্ত’ দুই গুরু

নাটোরে প্রাণ অ্যাগ্রো কারখানা বন্ধ ঘোষণা

আ. লীগকে নিষিদ্ধ করা হবে কি না জানালেন নাহিদ

১০

ভারতীয় গণমাধ্যমেও সাকিবের অবসর

১১

ধেয়ে আসছে হারিকেন ‘হেলেন’, ভয়ংকর ঢেউয়ের সতর্কবার্তা

১২

‘আফ্রিকান’ কাসাভা চাষে তাক লাগালেন পঞ্চগড়ের মোস্তফা কামাল

১৩

পালিয়ে গিয়েও ফেসবুকে সরব কুমিল্লার সাবেক মেয়র

১৪

৬০ বছরে এই প্রথম!

১৫

আজ জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দেবেন ড. ইউনূস

১৬

কুমিল্লায় ‘ঘরে ঘরে’ ছড়িয়ে পড়ছে চর্মরোগ

১৭

আওয়ামী লীগের নেতাদের টাকা দিয়ে কিনতেন জুম্মান

১৮

কানপুরে টস হেরে ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশ

১৯

২০০ বছর পরও আবু সাঈদ-মুগ্ধদের স্মরণ করবে মানুষ : মাহমুদুর রহমান

২০
X