রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ ২০১৮ সাল থেকে সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ উপজেলার ধামাইনগর ইউনিয়নের ক্ষিরতলা গ্রামের সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিত নিয়ে গবেষণা করছে। এই গ্রামটি বেছে নেওয়ার কারণ হলো আমাদের বিভাগের বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থীরা গতানুগতিক পাঠ্যক্রমের পাশাপাশি যেন মাঠভিত্তিক হাতে-কলমে প্রায়োগিক শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ পায় এবং পড়াশোনার পাশাপাশি গবেষণামুখী হয়ে নিজেকে গড়ে তোলার ক্ষেত্র তৈরি করতে সক্ষম হয়। এজন্য আমি রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. শাহ্ আজমের প্রতিও কৃতজ্ঞ, যিনি আমাদের বিভাগকে প্রায়োগিক গবেষণায় উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত করেছেন। ফলশ্রুতিতে, বিভাগটি গত পাঁচ বছর ধরে এই ক্ষিরতলার আর্থসামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিত নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করার সুযোগ পেয়েছে।
বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম নিঃসন্দেহে বৈচিত্র্যময়। তবে, ক্ষিরতলার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো গ্রামটিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে পরিত্যক্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধ্বংসাবশেষ অর্থাৎ প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান। অন্যদিকে, গ্রামটি মূলত বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী অধ্যুষিত। মাহাতো, শিং, পাহান, সাঁওতাল জনগোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে ক্ষিরতলায় বাস করে আসছেন যেটাকে আমরা ‘বর্তমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ বলছি।
আমাদের গ্রামগুলোতে একইসাথে প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য এবং নৃতাত্ত্বিক বৈচিত্র্যতা পাওয়া কিছুটা দুষ্কর। এক্ষেত্রে, ক্ষিরতলার মৌলিক বিশেষত্ত্ব রয়েছে। গ্রামটির একপাশে রয়েছে বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রাচীন নগর পুন্ড্রনগর এবং অন্যপাশে রয়েছে সর্ববৃহৎ নবরত্ন মন্দির হাটিকুমরুল নবরত্ন মন্দির। পাশাপাশি পরিবৈশিকভাবে করতোয়া এবং বাঙালি নদীর তীরবর্তী স্থানে এই তিনটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অবস্থান। যদিও, ক্ষিরতলা গ্রামের করতোয়া নদীর শাখাটি বর্তমানে মৃত, স্থানীয়ভাবে যেটাকে মরা করতোয়া বলা হয়ে থাকে।
প্রায় পাঁচ বছরব্যাপী পরিচালিত অনুসন্ধানের মাধ্যমে আমরা এখন পর্যন্ত ক্ষিরতলায় চৌদ্দটি প্রত্নস্থল শনাক্ত করেছি। এরমধ্যে একটি প্রত্নস্থল ‘বিরাট রাজার ঢিবি’ নামে পরিচিত। শুধু এই প্রত্নস্থলটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কর্তৃক সংরক্ষিত। এটি মূলত একটি বড় ঢিবি, যার অভ্যন্তরে প্রাচীন ইট দ্বারা নির্মিত কাঠামো এখনও দৃশ্যমান। এ ছাড়া, অন্যান্য প্রত্নস্থলগুলোর বেশিরভাগই ইতোমধ্যে ধ্বংসের সম্মুখীন। প্রত্নস্থলগুলো থেকে ইট, মৃৎপাত্র, পোড়ামাটির ফলক পাওয়া গেছে। প্রখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক আবুল কালাম মো. জাকারিয়া ‘বাঙলাদেশের প্রত্নসম্পদ’ গ্রন্থে ক্ষিরতলায় পঞ্চাশটি ঢিবির কথা উল্লেখ করেছেন (১৯৬০)।
যেহেতু, আমরা সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিত অনুসন্ধানের লক্ষ্যে কাজ করছি, তাই প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের পাশাপাশি স্থানীয়দের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলোকেও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করেছি। ঐতিহ্যবাহী কারাম, সহরায়, ফাগুয়া উৎসব ছাড়াও ক্ষিরতলার আদিবাসীদের রয়েছে বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এখনও আদিবাসীরা নানা ধরনের পার্বণের মধ্যে দিয়ে তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছেন। উল্লেখ্য, আমাদের গবেষণা টিমের সাথে স্থানীয় আদিবাসীদের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠার কারণে আমরা প্রায়ই গবেষণা চলাকালীন আদিবাসীদের বাড়িতেই রাত্রিযাপন করি।
আদিবাসীদের মধ্যে আদি কিংবা স্থানিক জ্ঞানচর্চার বিষয়গুলোও আমাদের গবেষণায় উৎসাহী করেছে। বর্তমান বাংলাদেশে শিশুজন্মদানের ক্ষেত্রে সিজারিয়ান পদ্ধতির ব্যাপক প্রয়োগ থাকলেও বেশকিছু আদিবাসী নারী প্রথাগত পদ্ধতি অনুসরণ করে শিশুজন্মদান করে থাকেন। এক্ষেত্রে, স্থানীয় ধাত্রীর সাথে কথা বলে জানা গেছে তিনি দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় এবং কার্যকর পদ্ধতি বিশেষত প্রসূতিকে শুয়ে এবং প্রয়োজন সাপেক্ষে বসে, হাঁটুগেড়ে কিংবা দাঁড়িয়েও শিশুজন্মদানের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। বর্তমান পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশেই এসব পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।
ক্ষিরতলার আদিবাসীদের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো বৃক্ষকেন্দ্রিক পার্বণ, বিশেষ করে কারাম গাছকে কেন্দ্র করে তাদের যে উৎসব প্রচলিত সেটির একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত রয়েছে। এ ছাড়াও গোয়ালপুজা, পুষনা উৎসব, ঝুমুর নাচ নামক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে পালন করে থাকে ক্ষিরতলার আদিবাসীরা।
প্রতিটি আদিবাসীর রয়েছে ভাষাগত বৈচিত্র্যতা। কয়েক দশক আগে যদিও এক গোত্রের সাথে অন্য গোত্রের বিয়ে হতো না। তবে, ইদানীংকালে সেটির পরিবর্তন ঘটেছে। সবচেয়ে বড় সংকট হলো আদিবাসীরা বেশিরভাগই অত্যন্ত দরিদ্র। যদিও, পুরুষের পাশাপাশি আদিবাসী নারীরা কৃষিজমিতে কাজ করে থাকেন। তথাপি, তাদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার হার কম থাকার কারণে তাদের অর্থ উপার্জনের সুযোগ কম। অনেক নারী বাসায় গৃহপালিত পশুপালন করেন। কিন্তু, সমস্যা হলো ‘যৌতুক প্রথা’। আমরা বয়স্ক আদিবাসীদের সাথে কথা বলে জেনেছি কয়েক দশক আগে বিয়ের সময় কনেকে ‘কনেপণ’ দিতে হতো। কিন্তু, বর্তমানে কনেপণের পরিবর্তে বরকে অনেক টাকার অর্থ এবং সাথে অন্যান্য উপকরণ যৌতুক হিসেবে দিতে হয়। ফলে, নারীরা কর্মঠ হলেও পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যবাদী আচরণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
আর একটি সংকট হলো, এরশাদ সরকারের আমলে নব্বইয়ের দশকে গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের কারণে আদিবাসী পল্লীতে মূলধারার জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দেয়া হয়েছিল। ফলে, আদবাসীদের আচার-অনুষ্ঠানের অনেক কিছুই তারা এখন আর পালন করতে পারেন না। যেমন : উৎসবে ‘হাড়িয়া’ নামক যে পানীয় পান করার প্রচলন ছিল সামাজিক আগ্রাসনের কারণে সেটি পান করতে তারা কিছুটা বাধার সম্মুখীন হয়ে থাকেন।
বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে পর্যটনশিল্পের বিকাশে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ওপর গুরুত্বারোপ করা হলেও এখন পর্যন্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যভিত্তিক পর্যটন শিল্প গড়ে তোলার জন্য টেকশই পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়নি। অথচ ক্ষিরতলার মতো আরও অনেক বৈচিত্র্যময় ও সমৃদ্ধ ঐতিহ্যবাহী গ্রাম রয়েছে যেগুলোকে ঘিরে বৃহৎ পরিসরে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যভিত্তিক পর্যটনশিল্পের বিকাশ ঘটানোর সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীগুলোকে যাতায়াতের উপযোগী করে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যভিত্তিক পর্যটন গড়ে তোলার জন্য পরিকল্পিত অবকাঠামো গড়ে তুলতে পারলে এই দেশটি পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হতে পারবে। তবে, এজন্য প্রয়োজন গভীরতর গবেষণা। যেহেতু, বাংলাদেশের মানুষ অতিথিপরায়ণ জাতি হিসেবে পরিচিত। তাই, পর্যটনশিল্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামকটি আমাদের কৃষ্টিতে বিদ্যমান। শুধু, সামগ্রিক সচেতনতা, নিরাপত্তা এবং টেকশই পরিকল্পনা প্রণয়ন ও সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে একদিকে গবেষণার পরিধি বিস্তৃত হবে এবং অন্যদিকে পর্যটনের মাধ্যমে আর্থিক উপার্জনের নতুন পথ উন্মোচিত হবে।
পরিমেয় এবং অপরিমেয় সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে গুরুত্বের সাথে দেখার আর একটি কারণ হলো, যেহেতু, ইতোমধ্যে আমরা সাফল্যের সাথে মিলেনিয়াম ডেভলপমেন্ট লক্ষ্য পূরণে সমর্থ হয়েছি এবং বর্তমানে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকশই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের (এসডিজি) পথে হাঁটছি। তাই, এসডিজি অর্জন করতে হলে অবশ্যই দারিদ্র্যতা নিরসন ও নারী-পুরুষের সাম্যতা নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষিরতলার আদিবাসী নারীদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের ট্যুরিস্ট গাইডের সুযোগ করে দেওয়া, পর্যটক যেন স্বল্প খরচে স্থানীয়দের বাড়িতে রাত্রিযাপন করতে পারে সে ব্যবস্থা করা, স্থানীয় বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলোকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ ও পর্যটকদের সামনে উপস্থাপনের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন, যাতায়াতের জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং সর্বোপরি পর্যটনের নামে যেন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হুমকীর সম্মুখীন না হয় সেদিকে মনোযোগ দিয়ে একটি টেকশই পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।
গত ২৩ মার্চ বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি আয়োজিত সারথি রিসার্চ গ্রান্টস লেকচারে আমার গবেষণায় এসব বিষয় উপস্থাপিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞ প্যানেল আমার এই ধারণাটির প্রশংসা করেছেন এবং তাদের অনেকেই আমার সাথে যৌথভাবে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, ক্ষিরতলার মতো বৈচিত্র্যময় গ্রামভিত্তিক টেকশই পর্যটনশিল্প গড়ে তোলার জন্য আমাদের নীতি-নির্ধারকরা দারিদ্রাতা নিরসনে এবং স্থানীয়দের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি কার্যকর ও টেকসই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যভিত্তিক পর্যটনশিল্পের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করবে।
মো. রিফাত-উর-রহমান : চেয়ারম্যান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন