রেফারি অ্যান্থনি টেইলরকে কটূক্তির পর হোসে মরিনহোর শাস্তি অবধারিতই ছিল। সবার ধারণা ইউরোপিয়ান ফুটবল সংস্থা (উয়েফা) দ্রুতই শাস্তি ঘোষণা করে। ক্রিকেটের নানা ঘটনায় কেন বিধি মাফিক এভাবে শাস্তি হয় না?
অতীতে নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে উপরের প্রশ্নটা বিভিন্ন সময় উঠেছে, হারমানপ্রিত কৌরকাণ্ডে আরও একবার উঠল। বলাই বাহুল্য, বিশ্ব ফুটবল সংস্থা (ফিফা) কিংবা উয়েফার মতো মহাদেশীয় সংস্থাগুলো ডিসিপ্লিনারি ইস্যুতে সাধারণত একই নীতি বা বিধান অনুসরণ করে। এক্ষেত্রে কোনো মোড়ল কিংবা কুতুব বিবেচ্য নয়। ফুটবল ও ক্রিকেটের সৌন্দর্যের বৈপরীত্য বোধ করি এ জায়গাতেই।
সেভিয়ার কাছে ইউরোপা লিগ ফাইনাল হারের পর মরিনহো ম্যাচ ভেন্যু পুসকাস অ্যারেনার পার্কিংয়ে রেফারির উদ্দেশ্যে কটু মন্তব্য করেছিলেন। স্ব-ঘোষিত ‘স্পেশাল ওয়ান’-এর দাবি ছিল, ‘ম্যাচে আমার দলকে পেনাল্টি থেকে বঞ্চিত করেছেন অ্যান্থনি টেইলর।’ যে কারণে বুদাপেস্ট বিমানবন্দরে এ ইংলিশ রেফারি ও তার পরিবারকে লাঞ্ছিত করে এএস রোমার একদল উগ্র সমর্থক। শাস্তি হিসেবে কোচ মরিনহোকে চার ম্যাচ নিষিদ্ধ করা হয়। এখানেই থামেনি উয়েফা। এএস রোমা ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতায় পরবর্তী অ্যাওয়ে ম্যাচের টিকিট বিক্রি করতে পারবে না। জরিমানাও গুনতে হবে প্রায় ৬৬ লাখ টাকা। টিকিট বিক্রির নিষেধাজ্ঞার ফলে ক্লাবটি কয়েক কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়বে। হারমানপ্রিত যেভাবে আম্পায়ারদের অপদস্থ করলেন, রেফারি অ্যান্থনি টেইলরের ক্ষেত্রেও যদি একই কাণ্ড ঘটতো—কী তুলকালামটাই না বাধাতো উয়েফা! কিন্তু এ ঘটনায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) কী করছে?
আরও পড়ুন : হারমানপ্রীত দুই ম্যাচ নিষিদ্ধ
বাংলাদেশি ক্রিকেটভক্তদের একাংশের কাছে কাছে বিরাট কোহলি কাঠখোট্টা, কুরুচিপূর্ণ ব্যক্তি! বিভিন্ন ঘটনা-পরবর্তী সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমর্থকদের প্রতিক্রিয়া সে কথাই বলছে। বিগত দিনে একাধিক ম্যাচে বাংলাদেশের বিপক্ষে অঙ্গভঙ্গি ও অভিব্যক্তির কারণেই এ ক্রিকেটারের প্রতি বাংলাদেশি সমর্থকদের একাংশের এমন মনোভাব। বিষয়টিকে বিশ্লেষণী দৃষ্টিতে দেখলে কিন্তু আপত্তিকর কিছু খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিরাট কোহলি মাঠে সাধারণত খেলার মধ্যে বুঁদ হয়ে থাকেন। আপনি যখন গভীর মনোযোগে কোন বিষয় নিয়ে পড়ে থাকবেন, তখন বিষয়টির নানা বাঁকে আপনার প্রতিক্রিয়া অন্যদের চেয়ে আলাদা হওয়ারই কথা। বিরাট কোহলির ক্ষেত্রে হয়তো তেমনটাই ঘটে। ‘হিট অব দ্য মোমেন্ট’ কোহলিকে যে রূপেই প্রকাশ করুক, প্রকৃত অর্থে এ ক্রিকেটার পুরোপুরি পেশাদার।
বাংলাদেশের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে ভারত অধিনায়ক হারমানপ্রিত কৌরের মাঠের ঘটনাকেও ‘হিট অব দ্য মোমেন্ট’ হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন সবাই। কিন্তু মাঠের বাইরের নানা ঘটনায় ভারত অধিনায়ক প্রমাণ করেছেন সবার সে ধারণা ছিল ভুল। মাথা গরম অবস্থায় সামান্য বিষয়ে আপনি কাউকে কষে চড় বসিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু মাথা ঠান্ডা হওয়ার পরও যদি আপনার মনে হয়, ‘যা করেছি, ওটাই সঠিক।’ সেক্ষেত্রে আপনার মানসিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে; এ জন্য সংশ্লিষ্টরা ব্যথিত হবেন, কষ্ট পাবেন। মাঠের কাণ্ডকে বাইরে টেনে এনে হারমানপ্রিত যেভাবে আম্পায়ার ও প্রতিপক্ষ দল নিয়ে কটাক্ষ করলেন; তাতে ব্যথিত হয়েছেন, কষ্ট পেয়েছেন বাংলাদেশি ক্রিকেটার থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্টরা।
আরও পড়ুন : জরিমানা দিয়েই পার পেলেন হারমানপ্রীত
ভারত অধিনায়ক কেবল কটূক্তিতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না। ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণও করলেন মাঠের ওই ঘটনায় শুনানি প্রত্যাখ্যান করে। শৃঙ্খলা ভঙ্গের ঘটনায় এ ক্রিকেটারের ম্যাচ ফি’র ৭৫ শতাংশ কাটা হয়েছে। আপাতত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, অর্থদণ্ডেই পার পাচ্ছেন ভারত অধিনায়ক। ব্যাট দিয়ে স্ট্যাম্প ভাঙা, সরাসরি আম্পয়ারিং নিয়ে বাজে মন্তব্য করা এবং প্রতিপক্ষ দলকে কটাক্ষর পর এমন শাস্তিতে পার পাওয়া যাচ্ছে! শেষপর্যন্ত গুরু পাপে লঘুদণ্ড হলে হারমানপ্রিত কৌর নন, খোদ খেলাটির নিয়ন্ত্রক সংস্থাকেই আসলে কাঠগড়ায় দাড় করানো উচিত! ‘ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা’— এমন উক্তির পক্ষে এখনও যারা জোরালো যুক্তি দেন, হারমানপ্রিতকাণ্ডে তারা হয়তো লজ্জায় মুখ লুকাতে চাইবেন। ‘খেলাধুলা নিখাদ বিনোদনের মাধ্যম’— এমন উক্তিও পদদলিত হচ্ছে উল্লিখিত আচরণে।
বিশ্বায়নের স্রোতের অনুকূলে দুরন্ত গতিতে ছুটছে পেশাদারিত্বের ক্রিকেট। ১২ পূর্ণ ও ৯৬ সহযোগী সদস্য নিয়ে বৈশ্বিক ক্রিকেট পরিবার। সে পরিবারের কর্তা হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সংস্থা (আইসিসি) যে ভূমিকা প্রয়োজন, তা বিভিন্ন ঘটনায় প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এ কারণেই হয়তো একের পর এক ক্রিকেট শিষ্টাচার বহির্ভূত ঘটনার জন্ম নিচ্ছে!
বাংলাদেশ-ভারত সিরিজে হারমানপ্রিত কৌর মাঠে যে কাণ্ড করলেন, এটা যে কোনো ক্রীড়াবিদ কিংবা ম্যাচ সংশ্লিষ্টদের ক্ষেত্রেই ঘটতে পারে। কিন্তু ভারত অধিনায়ক ম্যাচ- পরবর্তী সময়ে যা করলেন, যা বললেন— সেটা অগ্রহণযোগ্য, অনাকাঙ্ক্ষিত।
লেখক : ক্রীড়া বিশ্লেষক ও সাংবাদিক
মন্তব্য করুন