চিররঞ্জন সরকার
প্রকাশ : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৩:৪২ এএম
অনলাইন সংস্করণ

বসন্ত ও ভালোবাসার উন্মাদনা

বসন্ত ও ভালোবাসার উন্মাদনা

করোনা নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বাধ্যবাধকতার মধ্যেই প্রকৃতিতে আবারও এসেছে বসন্ত। এসেছে ভালোবাসা দিবস। বাংলা বর্ষপঞ্জিতে সংশোধনের কারণে এখন বসন্ত ও ভালোবাসা দিবস একই দিনে উদযাপন করা হচ্ছে।

‘এখনো বুঝি না ভালো, কাকে ঠিক ভালোবাসা বলে’—কবি শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন। ভালোবাসার মতোই ভালোবাসার দিন নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন অনেকেই; কিন্তু আপনি মানুন আর না মানুন পহেলা ফাল্গুন আর ভালোবাসার দিনটি এখন নতুন প্রজন্মের বাঙালির কাছে অনেক কাঙ্ক্ষিত এক উৎসবের দিনে পরিণত হয়েছে।

এ দুদিন সোশ্যালমিডিয়া-নির্ভর নতুন প্রজন্ম উৎসবে মেতে উঠে। মেয়েরা বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে। খোঁপায় ফুল জড়ায়। ছেলেরা হলুদ কিংবা লাল রঙের পাঞ্জাবি পরে। রঙিন প্রজাপতির মতো এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়ায়। বিভিন্ন ক্যাফে-হোটেল-রেস্টুরেন্টে ভিড় জমায়। নানা ঢঙে ছবি তুলে ফেসবুক সয়লাব করে।

আমাদের দেশের কবি-সাহিত্যিকরা ফাল্গুন বা বসন্ত নিয়ে মাতামাতি করলেও ভালোবাসা দিবস ছিল তাদের কাছে একেবারেই অচেনা। মাত্র তিন দশক আগে বিশ্বায়নের ঢেউ থেকে বাংলাদেশের উচ্চবিত্ত সমাজের উঠানে প্রথম ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ বা ভালোবাসা দিবস উঁকি মারে। এরপর করপোরেট পুঁজির প্রচার-প্রচারণায় তা উচ্চবিত্তের আঙিনা পেরিয়ে মধ্যবিত্তের মনোভূমিতেও একটু একটু করে বাসা বাঁধে। এখন তো এটি প্রায় জাতীয় দিবসে রূপ পেয়ে গেছে। ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ নিয়ে এখন রীতিমতো উন্মাদনা চলছে।

অনেকে বলেন, এ দিবসটি নিয়ে এত রক্ষণশীলতার কী আছে? এটি তো খুন-খারাবি কিংবা ধ্বংসাত্মক কোনো ব্যাপার নয়, ভালোবাসার এবং ভালোবাসবার একটি দিন। ভালোবাসার চেয়ে পবিত্র, এর চেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস এই বিশ্বসংসারে দ্বিতীয়টি আছে কি? এই দিনটি নিয়ে মাতামাতি—এমনকি যদি বাড়াবাড়িও কিছু হয়, তো ক্ষতি কী? অনেকে আবার পাল্টা যুক্তি দেন, ভালোবাসা কি কেবল একদিনের ব্যাপার যে, ভালোবাসার জন্য একটি দিবস পালন করতে হবে? এই দিনই আমরা কেবল ভালোবাসব, ভালোবাসার কথা বলব? আর বাকি দিনগুলো হৃদয়হীন-পাষাণ হয়ে বসে থাকব?

কেউ কেউ আবার বাজার সংস্কৃতির দোহাই দেন। এ ধরনের দিবসের হুজুগে মাতিয়ে রেখে ব্যবসায়ীরা আসলে তাদের পণ্যবিক্রির সুযোগ নেন। এটি আসলে পোশাকসহ বিভিন্ন রকম পণ্যসামগ্রী, কার্ড আর চকোলেট কোম্পানিগুলোর পকেট-ভর্তির দিন! আবার কেউ কেউ মনে করেন, ভ্যালেন্টাইন ডে আসলে একটি খেলনার মতো। সবাই যেটি নিয়ে এক দিনের জন্য খেলা করতে চায়। আপনার যদি যথেচ্ছ টাকা এবং ইচ্ছে থাকে এবং এই ভোগবাদী উৎসবে কাউকে নিজের করে পেতে ইচ্ছে করে, তা হলে আপনিও এই এক দিনের মজা চেটেপুটে নিতে পারেন!

কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক, আজ বসন্ত!’ প্রকৃতিতে যেমন ফুল না ফুটলেও, কোকিলের কুহুধ্বনি শোনা গেলেও ঋতুচক্রের হিসেব মতে, বসন্তদিন আসে, ঠিক তেমনি আমি-আপনি মানি আর না মানি, আমাদের অন্তরে প্রেম-ভালোবাসার যতই ঘাটতি থাক, আজ ভালোবাসা দিবস। আজ ফাগুনের মাতাল হাওয়ায় ভেসে ভেসে অসংখ্য নারী বাসন্তী রঙে নিজেদের রাঙিয়ে রাজধানীর রাজপথ, পার্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরসহ পুরো নগরী সুশোভিত করে তুলবে। গালে আঁকে নানা রঙের বসন্ত বরণ উল্কি, মাথায় ফুলের তাজ।

বসন্তের পূর্ণতার এই ছোঁয়া শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নয়, ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে থাকা সব বাঙালির আবেগি মনে। ভালোবাসা দিবস মানে এখন জড়তাকে ঝেড়ে ফেলা, নতুন প্রাণের কলরব, একে অপরের হাত ধরে হাঁটা। আমরা জানি, জীবন সবসময় সুখের নয়। বিবাদ, অশান্তি, দুঃখ-দুর্দশা সেখানে আছেই। এই সব নিয়েই আমাদের চলতে হয়; কিন্তু দুঃখ-অশান্তির কালিমায় মন আবৃত রাখলে কি আমাদের জীবন সুচারু রূপে চলবে? না। কারণ জীবন পরিবর্তনশীল। আর বসন্তবরণ বা ভালোবাসা দিবসের উৎসবের মধ্যে রয়েছে সেই উৎসাহের বার্তা। যে উৎসব বার্তা দেয় সব দুঃখ-দৈন্য তুচ্ছ হোক, মুছে যাক সব ক্লেদ-কালিমা—জীবন পূর্ণ হোক আনন্দরসে। আমরা আরও প্রত্যাশা করি, আমাদের রাজনীতিতে বসন্ত-বাতাস বয়ে যাক, প্রতিষ্ঠিত হোক গণতান্ত্রিক-সংস্কৃতি, ঘুচে যাক বিদ্বেষ-হানাহানি।

বসন্তে আমরা উদ্বেল হই, উল্লসিত হই। আমাদের মন ভরে উঠে। মন তো ভরবেই, কারণ জীবনে আরও একটি বসন্ত যে এসে গেছে! জীবনের পথে চলতে চলতে যত ঝড়ঝঞ্ঝাট আসুক, তবু জীবন বড় সুন্দর—জীবন এক চলমান উৎসব। আমাদের প্রত্যেকেরই যে আকাঙ্ক্ষা-জীবনের প্রতিটি দিন বসন্তের মাধুর্যের মতোই চিরকাল আমাদের কাছে ধরা দিক। জীবনের দিনগুলো তো একটা একটা করে ঝরে যাবেই; কিন্তু মন যেন সজীব থাকে। চিরবসন্ত যেন জাগ্রত থাকে মনের মাঝখানে। তাহলেই বড় হব, ‘বুড়ো’ হব না। নানারঙের ফুল, প্রজাপতি—এই পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে থাকা গানের মধুময় সুর, আকাশে রামধনুর সাত রং এক অপূর্ব মায়ায় ঘিরে থাকুক আমাদের। জীবনটা থাক এক মনোরম স্বপ্ন হয়ে। দুঃখ-দুর্দশার মাঝেও যেন এ স্বপ্নগুলো জীবন থেকে হারিয়ে না যায়। তাহলেই এই পৃথিবীতে যতদিন বেঁচে থাকব একটি সুন্দর বাসন্তী মন নিয়ে বাঁচব। সবাইকে নিয়ে বাঁচব, সবার জন্য বাঁচব।

আরেকটি কথা, আমরা ভালোবাসা দিবস অবশ্যই পালন করব। অবশ্যই প্রেমের নিশান উড়াব। উচ্চস্বরে ভালোবাসার গান গাইব; কিন্তু তা যেন কোনোমতেই একদিনের সস্তা উৎসবে পরিণত না হয়। তরুণ-তরুণীদের ভালোবাসার গুরুত্ব ও মর্ম বুঝতে হবে। উপলব্ধি করতে হবে। যখন যাকে খুশি ভালোবাসলাম, হাত ধরলাম, আবেগের কলস উপুড় করে দিলাম, তারপর ‘মোহভঙ্গ’ ঘটল, আর সেই হাত ছেড়ে উল্টো দিকে হাঁটা দিলাম, এমন মনোভাব সমাজের জন্য খুব একটা স্বাস্থ্যকর নয়। ভালোবাসা যেন ‘খেলা’ হয়ে না দাঁড়ায়।

ভালোবাসা দিবস যেন শুধু একটি ছেলে মেয়েকে অথবা একটি মেয়ের একটি ছেলেকে ভালোবাসার মধ্যে সীমাবদ্ধ না হয়ে পড়ে। আমরা যেন সবাই সবাইকে ভালোবাসতে পারি, শুধু একদিন নয়, প্রতিদিন ভালোবাসতে পারি—সেই অঙ্গীকার প্রয়োজন।

আমাদের সমাজ বর্তমানে ভয়ানক রকম অস্থির ও অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছে। চারপাশে তাকালে মনে হয়, মানুষের মধ্যে ধৈর্য-সহ্য সহানুভূতির মতো গুণগুলো যেন প্রায় হারিয়েই গেছে। সবসময় একটা উগ্রতা, একটা লড়াই-লড়াই ভাব সবার মধ্যে। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না। অন্যের ভালো দেখলে যেন বুক জ্বলে যায়। সে জ্বালা মেটাতেই সংশ্লিষ্টজনের সর্বনাশের চিন্তা চড়বড় করে ওঠে যেন মাথায়! আর তার পরিণতিতেই ঘটে যায় অপ্রীতিকর মর্মান্তিক ভয়াবহ সব ঘটনা। যে সহনশীলতা, কোমলতা, স্নেহ-ভালোবাসা, মায়া-মমতা দেশে এবং দেশের বাইরে বাঙালিকে একটা আলাদা সুনাম ও স্বাতন্ত্র্য দিয়েছিল, তা আজ কোথায়? আজকের বাঙালির চেহারায় চরিত্রে সাজপোশাকে কথায় হাবেভাবে তার কতটুকু অবশিষ্ট আছে? বদমেজাজ, বেহিসেবিপনা উড়নচণ্ডিবৃত্তি আর স্বার্থপূরণের উচ্চাশা ঘরসংসার, আত্মীয়পরিজনের সঙ্গে মানুষের দূরত্ব যেন বাড়িয়েই চলেছে। সেই গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো জেগেছে ফেসবুক, মেসেঞ্জার, টুইটার, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপের মতো হাজারো সোশ্যাল নেটওয়ার্ক! পাশাপাশি বসে মনের কথা বলার অভ্যাসটাই নষ্ট করে দিচ্ছে এসব যান্ত্রিক ব্যাপার-স্যাপার।

সব মিলিয়ে হয়তো আমাদের চিরাচরিত সম্পর্কের বাঁধনগুলোই আলগা এবং ক্ষেত্রবিশেষে অপ্রয়োজনীয় ঠেকছে মানুষের কাছে। নিজের স্বার্থ, নিজের সুখ, নিজের ইচ্ছে, নিজের সুবিধেটা বড় হয়ে উঠছে। বাবা-মা ভাই-বোন-স্ত্রী-স্বামীর মধ্যে সমাজ ছাড়িয়ে যে স্নেহ মায়া-মমতার বাঁধনটা ছিল এতদিন, তা শিথিল হয়ে পড়ছে। আমাদের পারস্পরিক শ্রদ্ধা ভালোবাসার সম্পর্কগুলো বেসামাল হয়ে যাচ্ছে। বাবা মায়ের মহিমা, সন্তানের ঐশ্বর্য, শিক্ষকের মান, গুণীর কদর, সহকর্মী আত্মীয় প্রিয়জনের গুরুত্ব—কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করছি না আমরা। আর তার পরিণতিতে কোথাও অপ্রীতিকর মর্মান্তিক কিছু একটা ঘটলে খানিক সন্দেহ সমালোচনা আর পুলিশের ওপর দোষারোপ করে দায় সারছি। ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে। স্বাভাবিক স্নেহপ্রবণ বাবা-মা আছেন, দায়িত্বশীল ছেলেমেয়েও আছে, সহৃদয় সজ্জন মানুষজনেরও অভাব নেই; কিন্তু সেই ব্যতিক্রমের পর্দা দিয়ে আমাদের আজকের ক্রমবর্ধমান উদভ্রান্তি-অস্থিরতা আর অসহিষ্ণুতাকে আর আড়াল করা যাচ্ছে কি? আমাদের স্নেহ-ভালোবাসার সম্পর্কগুলোর স্বাভাবিকতা যথাযথভাবে বজায় আছে—জোর গলায় পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এমন দাবিও কি করতে পারছি আমরা? নাকি আমাদের সম্পর্কগুলোর স্থায়িত্ব নিয়ে দিনের পর দিন সংশয়টাই বাড়ছে, বেড়েই চলেছে? তাহলে আর বসন্তবরণ কিংবা ভালোবাসা দিবস পালনের গুরুত্ব কোথায়?

লেখক : কলামিস্ট ও উন্নয়নকর্মী

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে ইউপি সদস্য গ্রেপ্তার

দৌলতদিয়া লঞ্চঘাট থেকে নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনে নিয়োগ, এসএসসি পাশেও আবেদন

ঈদের আগে জুতার কারখানায় রহস্যের আগুন

সরকারকে হেফাজতের হুঁশিয়ারি

জাবিতে ছাত্রলীগ কর্মীসহ বহিষ্কার ৭

হরিপুরে সৎসঙ্গ আশ্রম মন্দির উদ্বোধন

রেলপথ ও সড়ক পথ অবোরধের হুঁশিয়ারি ছাত্রলীগের

দক্ষিণ আফ্রিকায় সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে বাংলাদেশি যুবক নিহত

দেশের অসংখ্য মানুষ খাবারের কষ্ট পাচ্ছে : চরমোনাই পীর

১০

শৈলকুপায় ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত

১১

আজকের সেহরি ও ইফতারের সময়সূচি (৩০ মার্চ ২০২৪, শনিবার)

১২

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ

১৩

সিন্ডিকেট চক্র সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করছে : ডা. ইরান 

১৪

অহেতুক কথা বলে হাস্যাস্পদ হবেন না : সরকারকে আলাল

১৫

জমির দাবিতে বাবার কবরে শুয়ে দাফনে বাধা

১৬

লাইলাতুল কদর চেনার আলামত

১৭

বিএএফ শাহীন কলেজ ঢাকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি 

১৮

গণতন্ত্রকে আইসিইউতে পাঠিয়েছে আ.লীগ : প্রিন্স 

১৯

বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি প্রতিরোধে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ, ৬ দফা দাবি

২০
*/ ?>
X