অজয় দাশগুপ্ত
প্রকাশ : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৩:৪৯ এএম
অনলাইন সংস্করণ

দূষণের শহর ঢাকা : দূষণের শিকার দেশ

দূষণের শহর ঢাকা : দূষণের শিকার দেশ

সকাল বেলা পত্রিকা খুলে খবরটা দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমরা সবাই জানি জনবহুল দেশ আমাদের। মানুষের ভিড়ে চাপা পড়ে গেছে স্বপ্নসাধ । এমন কি বাঁচার আয়ুও যেন ধীরে ধীরে উধাও হতে শুরু করেছে। খবরে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক: গত ২৬ জানুয়ারি ঢাকার বাতাস ছিল সবচেয়ে বেশি দূষিত। সেদিন এ অঞ্চলের বাতাসে পিএম২.৫-এর মাত্রা ছিল ২৬৩ দশমিক ১ এবং বাতাসের মান ছিল ৩১৩। এটা সব বয়সী মানুষের জন্য ক্ষতিকর। তবে শিশু, অসুস্থ ব্যক্তি, প্রবীণ ও অন্তঃসত্ত্বাদের জন্য বায়ুদূষণ খুবই ক্ষতিকর। আইকিউ এয়ারের পূর্বাভাস বলছে, আগামী পাঁচ দিনও ঢাকায় বাতাসের মানে কোনো উন্নতির সম্ভাবনা নেই। অর্থাৎ আগামী সপ্তাহেও এ শহরের বায়ু থাকবে অস্বাস্থ্যকর।

গত ১১ দিন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণের শহর রাজধানী ঢাকা। নতুন বছর শুরুর পর এখনো এক দিনও স্বাস্থ্যকর বায়ু পায়নি ঢাকাবাসী। গত মাসের ৩১ দিনের মধ্যে ২২ দিনই ঢাকা শহরের বায়ু ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ ছিল। আর বাকি ৯ দিন ছিল ‘অস্বাস্থ্যকর’। ফলে প্রতিদিনই বিষে ভরা বাতাস শহরবাসীর নাকে ঢুকেছে। আর এতে বাড়ছে স্বাস্থ্যগত সমস্যাও। এদিকে বায়ুদূষণ ঠেকাতে বিশেষ অভিযানের নির্দেশ দিয়েছেন পরিবেশমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন। গতকাল মঙ্গলবার সকালে ঢাকার এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই-বায়ুর মানসূচক) স্কোর ২৯১। যা ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ হিসেবে বিবেচিত হয়। ঢাকা থেকে ১০০ কম নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে থাকা করাচির বায়ুর মান ছিল ১৯১। গত সোমবারও ঢাকার একিউআই স্কোর ছিল ২৬৩।

আমি যেদেশে থাকি যে শহরে বসবাস করি তার চিত্র ঠিক উল্টো। ঘর ছেড়ে বেরুলেই সুনীল আকাশ। মাথার ওপর ঘন নীলের চাদর। পায়ের তলায় সবুজ। নিঃশ্বাস নিলেই টের পাওয়া যায় বাতাসের শুদ্ধতা। সিডনির জনসংখ্যা কম কিছু না। ষাট লাখের বেশি মানুষ এই শহরে বসবাস করেন বলে জানা যায়। কিন্তু জনবহুল নগরীর সবকিছু সুপরিকল্পিত। সে কারণেই হয়ত টের পাওয়া যায় না। দূষণ দুনিয়ার সব দেশ সব শহরেই আছে।

এই যে দূষণ এর প্রভাব মারাত্মক। লোকালয়ের শিশুদের ঝুঁকি বড়দের চেয়ে বেশি। গরম ও অন্যান্য জলবায়ু সংক্রান্ত সমস্যার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সক্ষমতা বড়দের তুলনায় তাদের কম। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়ায় তাদের ডায়রিয়া ও অন্যান্য প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। পুষ্টিহীনতায় ভোগারও ঝুঁকি থাকে এসব শিশুদের। দুর্যোগে স্কুল, সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

দেশে বিজ্ঞান চর্চা হয় কিনা জানা নাই। তবে টের পাই বিজ্ঞান এখন দুশমন। তাকে সামনে আনলে অনেকের গাত্রদাহ হয়। এটা এমন এক পর্যায়ে চলে গেছে বিজ্ঞান নিয়ে লিখলে বিপদ আবার পড়ালে জেলখানায় যেতে হয়। মানুষ যদি জলবায়ুর প্রভাব বিষয়ে না জানে বা জেনেও তার দায় বিধাতার কাছে সমর্পণ করে তাহলে কি আমাদের মুক্তি মিলবে ? আমি দশম শ্রেণির পর বিজ্ঞান বিভাগ ছেড়ে আসি। অঙ্ক বিষয়ে আমার অজ্ঞতা মারাত্মক। কিন্তু রোজকার জন্য যে জ্ঞান তার নাম যে বিজ্ঞান তা তো বুঝতে হবে। না বুঝলে আপনি সাবধান হতে পারবেন না। আর সভ্য দেশে বসবাস করাও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে। কারণ বিজ্ঞান অসম্মত কাজের জন্য আপনাকে জরিমানা গুনতে হবে ।

ঢাকার মতো শহরে এসব নিয়ম চালু রাখা কঠিন। জনবহুল সমাজে মনিটরিং অসম্ভব। তারচেয়েও বড় কথা নিয়ম মানানো। কিন্তু বিষয় যদি হাতের বাইরে চলে যায় মানুষের প্রাণ ও জীবনযাপন বিঘ্নিত হবে। যার কু ফল এখন হাতে হাতে মিলছে। কী মারাত্মক! ৪৮ দিন ছাড়া বছরের বাকি ৩১৭ দিন ঢাকার বাতাস বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্মল বায়ুর মানমাত্রার চেয়ে খারাপ থাকে। এক গবেষণায় উঠে এসেছে, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে শীতকালে ঢাকার বাতাস ১৬ গুণ বেশি দূষিত থাকছে। প্রকৃতিই হচ্ছে ভারসাম্য। আমাদের বড় বড় শহরে মানুষের চাপে প্রকৃতি বিপন্ন। সবুজ নাই। মাঠ নাই। খোলা আকাশ উধাও হওয়ার পথে। যতবার দেশে যাই বিমান অবতরণের সময় জানলায় চোখ রাখলেই ভয় লাগে। অক্টোপাসের মতো দালানকোঠা ঘিরে ধরেছে ঢাকা নগরীকে। চারদিক থেকে দানবের মতো ঘাড় উঁচু করে উঠে আসা দালানের চাপে অসহায় এই নগরীর ভবিষ্যৎ কি?

আগেও লিখেছি সরকারের তহবিল বা বরাদ্দ থাকলেও কাজ নাই। মন্ত্রী-আমলারা যে ঘনঘন বিদেশে যান তারা নিশ্চয়ই দেখেন কীভাবে রাজধানীর জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখা হয় । বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নাই। কুয়ালালামপুর থেকে অনতি দূরে পুত্র জায়া নগরীতে সরকারি দপ্তর সরিয়ে নিয়ে মালয়েশিয়া যা করেছে তাও করি না আমরা। বিভিন্ন সরকারি দপ্তর ঢাকার উপকণ্ঠে বা একটু দূরে সরালেও চাপ কমত। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আর দীর্ঘমেয়াদি সব কাজের ঠেলায় এদিকে তাকানোর সুযোগ নাই কারও। আসলে কেউ কাউকে ঘাাঁটাতে নারাজ। সব দপ্তরেই সরকারি দলের নেতাকর্মীরা আছেন। তারা কী ঢাকা ছেড়ে বাইরে যাবেন ? কখনোই না। ফলে নীরব আঁতাতের ঘা খেয়ে ধুঁকছে আমাদের দেশের রাজধানী।

পরিসংখ্যান বলছে: বাংলাদেশে পরিবেশের অবক্ষয় ও দূষণ একটি বড় সমস্যা। উপর্যুপরি বন্যা, খরা ও ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ জলবায়ু ও আবহাওয়ার অস্থিরতাসহ অন্যান্য পরিবেশগত সমস্যা এখন মানুষের নিত্যসঙ্গী। এ সবের মূলে মানুষের কর্মকাণ্ডই প্রধানত দায়ী। যথেচ্ছ বৃক্ষ নিধন, অধিক জনসংখ্যা, দারিদ্র্য, যানবাহনের কালোধোঁয়া, জোরালো শব্দের হর্ন, আবাসিক এলাকায় শিল্প কারখানা ও ইটভাটার অবস্থান, ইত্যাদি পরিবেশকে দূষিত করছে।

পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার কারণে জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে। বিশেষ কোনো দেশ বা জনগোষ্ঠী নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের মুখে পড়েছে সারা বিশ্বের মানুষ। বিশেষত গত ২০ বছরে এই প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা থেকে আমেরিকা মহাদেশেও। বৈশ্বিক জলবায়ু ঝুঁকি সূচক (সিআরআই)-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হন্ডুরাস, তারপরেই আছে মিয়ানমারের নাম। চতুর্থ অবস্থানে আছে নিকারাগুয়া, পঞ্চম ফিলিপাইন ও ষষ্ঠ অবস্থানে বাংলাদেশ। (সূত্র উইকিপিডিয়া)।

দেশের মানুষের হাত-পা বাঁধা। তাদের রুটি রোজগার আর জীবনের জন্য দেশের ভেতরে বড় শহরেই থাকতে হয়। আমাদের অযুত আত্মীয়-স্বজন সবার কেউ না কেউ আজ এই দূষণের শিকার। মজার ব্যাপার হলো যারা, কথায় কথায় দেশকে সিঙ্গাপুর হংকং বানিয়ে ফেলেন তারাও থাকেন এসব শহরে। হয়ত অনেকের পরিবার সন্তানসন্ততি থাকে না দেশে। কিন্তু তাতে কি তাদের জীবন তো এই বায়ুদূষণেই বন্দি। তারা কেন এগিয়ে আসেন না? এটা এমন কোনো বিষয় না যা সময় ঠিক করে দেবে। বা কারচুপি করে পার পাওয়া যাবে। এর কুফল ভুগতেই হবে।

বাংলাদেশের উন্নয়ন সূচকগুলো যেমন আশাজাগানিয়া তেমনি এসব বিষয় হতাশার। কবে কে কখন কঠোর ভূমিকা নিয়ে এই দূষণ রোধে এগিয়ে আসবেন জানি না। তবে ঢাকাসহ বড় বড় শহরগুলোর ওপর চাপ কমানো এখনই প্রয়োজন। নয়তো আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট, সিডনি প্রবাসী

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

রাজার আমন্ত্রণে ভুটানে তথ্য প্রতিমন্ত্রী

নেতাকে ফাঁসাতে গিয়ে আ.লীগ কর্মী গ্রেপ্তার

কালবেলায় সংবাদ প্রকাশ / স্বাধীনতা দিবসের নামে চাঁদা দাবি করায় ইউএনওর ২ স্টাফ বদলি

স্কুটারে বসেই অফিস করছেন তিনি, ভিডিও ভাইরাল

মোস্তাফিজদের ম্যাচ দেখায় নতুন রেকর্ড

এখনো যুদ্ধ করার ক্ষমতা রাখে ফিলিস্তিনিরা

‘বিএনপি নেতাদের কথা শুনলে জিয়াউর রহমানও লজ্জা পেয়ে যেতেন’

কুমিল্লায় গত ১১ মাসে শতাধিক মামলায় গ্রেপ্তার ৪৬৭

বৃষ্টি হলেই সড়ক হয়ে যায় পুকুর, জনদুর্ভোগ চরমে

ব্রিটিশ গণমাধ্যমের তালিকা / পেলে-ম্যারাডোনা নয় সর্বকালের সেরা মেসি

১০

আইপিইউ সম্মেলন শেষে দেশে ফিরলেন স্পিকার

১১

৫ হাজার মূল্যের বাতি ২৭০০০ টাকায় কিনেছে রেল!

১২

মেট্রোরেলের ওপর দিয়ে যাওয়া ইন্টারনেট-ডিসের তার অপসারণের নির্দেশ

১৩

২০০ বছরের পুরোনো ‘গায়েবি’ মসজিদের গুপ্ত তথ্য

১৪

বিএনপির নেগেটিভ রাজনীতি মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে : ওবায়দুল কাদের

১৫

জজশিপের কর্মচারীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে দুদিনের কর্মশালা অনুষ্ঠিত

১৬

সিরিয়ায় ইসরায়েলি বিমান হামলা, নিহত ৩৬ সেনা

১৭

জাভির পর কে হবেন বার্সা কোচ!

১৮

১ ঘণ্টায় শেষ রেলের ১৪ হাজার টিকিট

১৯

বিজিএপিএমইএর নির্বাচনের প্যানেল ঘোষণা

২০
*/ ?>
X