অজয় দাশগুপ্ত
প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৩:১২ এএম
অনলাইন সংস্করণ

বিকৃতি রোধ করে ভাষা বাঁচলেই দেশ ও প্রজন্ম বাঁচবে

বিকৃতি রোধ করে ভাষা বাঁচলেই দেশ ও প্রজন্ম বাঁচবে

বাংলাদেশের জন্ম মূলত ভাষার কারণে। পাকিস্তানের জন্মের মাস সাতেক পর, ১৯৪৮ সালের মার্চে মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ যখন তার জীবনের প্রথম ও শেষবারের মতো পূর্ববঙ্গে এসেছিলেন—তিনি হয়তো ভাবেননি যে সেখানে তার উচ্চারিত কিছু কথা একসময় তারই প্রতিষ্ঠিত নতুন দেশটির ভাঙন ডেকে আনতে ভূমিকা রাখবে। ইংরেজিতে দেওয়া সেই বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘আমি খুব স্পষ্ট করেই আপনাদের বলছি যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু এবং অন্য কোনো ভাষা নয়। কেউ যদি আপনাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে তাহলে সে আসলে পাকিস্তানের শত্রু।’

কয়েক দিন পর মি. জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে ছাত্রদের সামনে আরও একটি ভাষণ দিলেন। সেখানেও একই কথা বললেন তিনি। বললেন, পাকিস্তানের প্রদেশগুলো নিজেদের সরকারি কাজে যে কোনো ভাষা ব্যবহার করতে পারে, তবে রাষ্ট্রীয় ভাষা হবে একটিই এবং তা হবে উর্দু।

ভাষার প্রসঙ্গ এলেই আমার মনে পড়ে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের কথা। পাকিস্তান সৃষ্টির পর মুসলিম লীগের নেতারা তখন প্রকৃত অর্থে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজে মগ্ন। তখনই ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব সেই ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রচিন্তার মূলে এক বিশাল আঘাত। ১৯৪৭ সালের আগস্টে পাকিস্তানের জন্ম। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা করলেও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী স্বপ্নবান ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দেশত্যাগ করেননি। বরং রাজনীতিতে সক্রিয় থেকেই বাংলার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যে কার্যকর ভূমিকা নেওয়া জরুরি ছিল তাই করেছেন দারুণ সাহসের সঙ্গে। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের গণপরিষদের সভায় ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কী বলেছিলেন। তিনি বলেন, “আমি প্রস্তাব করি রুল ২৯ এর সাব-রুল (১) এর দ্বিতীয় লাইনে ‘ইংরেজি’ শব্দটির পরে ‘অথবা বাংলা’ শব্দ দুটি বসানো হোক।” একই দিন প্রস্তাবের প্রথম অংশে তিনি বছরে গণপরিষদের অন্তত একটি অধিবেশন পূর্ব বাংলায় করার প্রস্তাব দেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি এ প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যায়।

পরদিন ২৫ ফেব্রুয়ারি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পরিষদের সভায় তার প্রস্তাবের পক্ষে সেই ঐতিহাসিক ভাষণটি দেন। ‘বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা প্রদান করিতে হইবে’ শীর্ষক ওই বক্তব্যে তিনি বলেন, “…আমার মনোভাব এই রূপ যে, যেন সদস্যবর্গ গভীরভাবে বিষয়টি বিবেচনা করেন। এ কথা আমি জানি বাংলা একটি প্রাদেশিক ভাষা। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রের কথা যদি আমরা চিন্তা করি তাহলে দেখিব যে রাষ্ট্রের অধিকাংশ অধিবাসীর ভাষা হইতেছে বাংলা। কাজেই প্রাদেশিক হইলেও যেহেতু রাষ্ট্রের অধিকাংশ অধিবাসীর ভাষা বাংলা, সে কারণে বাংলা ভাষা ভিন্ন মর্যাদার দাবিদার। রাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যা ৬ কোটি ৯০ লক্ষ এর মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লক্ষ বাংলা বলে। এই যদি অবস্থা হয় তা হইলে রাষ্ট্রভাষা কোনটি হওয়া উচিত? সেই ভাষারই দেশের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক যে ভাষায় কথা বলে, আর সেজন্যই আমার বিবেচনায় বাংলা ভাষাই হচ্ছে আমাদের দেশের ‘লিংগুয়া ফ্রাঙ্কা’। আমি জানি আমার এ মনোভাব দ্বারা আমাদের রাষ্ট্রের বিপুলসংখ্যক মানুষের অনুভূতিকে প্রকাশ করিতেছি।…”

একাত্তরের ২৯ মার্চে এ মানুষটিকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী। সে নির্যাতনের মূল কারণ ছিল তার মাতৃভাষাকে সম্মান ও রাষ্ট্রভাষা বানানোর সদিচ্ছা। তিনি সে অর্থে সালাম-বরকত-রফিকের যোগ্য উত্তরসূরি। বাংলা ভাষার এ মাস নিয়ে আমরা গর্ব করি। অথচ নতুন প্রজন্ম এদের কারও নাম জানে না। শুধু জানে না হলেও চলত। এদের সঙ্গে কথা বললে মনে হবে আমরা অন্য কোনো দেশের নাগরিক। বাংলা ভাষার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে নাটক-সিনেমাসহ রেডিও। মুখের ভাষার এ বিকৃতি কোনো একদিন লেখার ভাষাকেও আক্রমণ করবে। আর তখনই ঘটবে সমূহ সর্বনাশ। এর জন্য দায়ী কারা তার চেয়ে বড় কথা এভাবেই মান হারাবে বাংলাদেশ। শুধু ভারতবিরোধিতা পশ্চিমবঙ্গের বিরোধিতা করতে গিয়ে বাংলা ভাষার এমন সর্বনাশ সাধন অহিতকর।

গবেষণা বলছে : “একাকার করে ফেলছেন। উচ্চারণের ক্ষেত্রে শোনা যায় নানা ধরনের ভঙ্গি। তা ভাষাকে প্রকৃত অর্থে ভিন্নপথে ধাবিত করছে। তরুণ প্রজন্ম আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। সেই তরুণ প্রজন্মের ওপর সবচেয়ে প্রভাব ফেলে এসব বিষয়। এফএম রেডিও চ্যানেলগুলো এসব ভাষা অবলীলায় প্রয়োগ করছে। তা আমাদের জন্য কোনোভাবেই কল্যাণকর নয়। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক-মহাসড়ক, বাজার, ফুটপাত, যানবাহন ও বিলবোর্ডগুলো বানানের ভুল প্রয়োগ ও বিকৃতিতে ছেয়ে গেছে। এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং এফএম রেডিওগুলোয় ভাষার মাসেও বিকৃত উচ্চারণে কথা বলা বন্ধ হয়নি। এ সংক্রান্ত গবেষণাতেও ভাষা বিকৃতির ভয়াবহ চিত্রের প্রমাণ মিলেছে। দিনের পর দিন এমন ভুল বানান দৃশ্যমান হলেও এগুলো নজরদারি করার মতো কেউ নেই।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় বাংলা বানানের বিকৃতি ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে। এখানে ভুলের চেয়ে বিকৃতিই বেশি। বাংলা-ইংরেজির মিশ্রণ, বাংলা শব্দের মনগড়া সংক্ষিপ্ত রূপ, নতুন শব্দ তৈরি ও ব্যবহার ইদানীং ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে ফেসবুক ও ব্লগ এখন ব্যাপক জনপ্রিয়। অনেক দিন ধরেই ব্যবহার বাড়ছে ইউটিউবের, ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হচ্ছে টুইটারও। তবে এগুলোর কোনোটিই ফেসবুকের মতো জনপ্রিয় নয়। ফেসবুকে বাংলা লেখার ধরনও অদ্ভুত। শব্দের বিকৃত বানান ও উচ্চারণ। যেমন—বেসম্ভব (অসম্ভব), নাইচ (নাইস), কিন্যা (কিনে), গেসে (গেছে) ইত্যাদি। এরকম অসংখ্য বিকৃত ব্যবহার চলছে সবসময়ই। বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি মিলিয়ে বলা হচ্ছে মাগার, টাস্কিভূত ও ধিং সম্ভাবিলিটি, বিন্দাস। সবচেয়ে বড় ক্ষতিকর হচ্ছে ফেসবুকে অহরহ বাংলা ভাষাকে ইংরেজি অক্ষরে যে যার মতো করে মনগড়া শব্দ তৈরি করে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এখানে বাংলা শব্দ ও বাক্য গঠনে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। ফলে এভাবে বাংলা ভাষার চরম বিকৃতি ঘটছে।”

আজকের বাংলাদেশ নানা বিষয়ে অগ্রসরমাণ। অনেক বিষয়ে তার পশ্চাৎপদতাও চোখে পড়ে। অভাব বা অনটন আছে কিনা নেই তার চেয়ে বড় কথা কষ্ট আছে। আছে নানা সমস্যা। সেসব সমস্যার চাপে চাপা পড়ে থাকলেও বাংলা ভাষার অমর্যাদা আর অসম্মান একটি বড় সমস্যা। যা ভবিষ্যতে আমাদের সমাজকে বিকলাঙ্গ করে ছাড়বে। আমি মনে করি যে কোনো দূষণের মতো ভয়াবহ ভাষা দূষণ। একুশের ভোরবেলা আমরা যত গর্ব করি আর বিশ্ব অবাক তাকিয়ে আছে বলে সন্তোষ লাভ করি না কেন, আমাদের মা ও মায়ের ভাষা আজ বিপদে। এ বিপদাপন্ন ভাষার মাস যদি সম্ভাবনার দিকে মুখ তোলে তবেই আমাদের অতীতের সংগ্রাম সার্থক হবে। অগ্রজরা যে পতাকা দিয়ে গিয়েছিলেন আমরা তা তুলে রেখেছি আজীবন। এবার আমাদের সন্তানসন্ততি বা নাতি-নাতনিদের পালা। তারা বদলাবে এটা সত্য। আমরাও বদলেছি। কিন্তু স্বকীয়তা বাদ দিয়ে নয়। আজকে উর্দু নেই বটে, আছে অন্যান্য ভাষার আগ্রাসন। তার চেয়েও বড় কথা, নিজের ভাষা বিকৃতির চেনাজানা শতবর্ষ গড়ে ওঠা বাংলাকে ধরেবেঁধে অতল জলে ফেলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র সাংঘাতিক। এর অবসান না হলে আগামী কয়েক দশকে আ মরি বাংলা ভাষা কথাটাও দেখবেন বিজাতীয় উচ্চারণ ও বানানে লেখা হবে। কারও কোনো দায় আছে বলে মনে হয় না। সে দায় নিতেও আগ্রহী নয় কেউ। এই যে বছর বছর একুশে পদক পায় মানুষজন, তাদের মধ্যে এমন একজনের নাম বলুন তো যিনি বাংলা ভাষার জন্য এখন জান দিয়ে কাজ করেন? একমাত্র পলান সরকার করতেন। বই ফেরিওয়ালা। আমার মনে হয় তার মতো সাধারণ মানুষই পারে অসাধারণ কাজ করতে। তাদের মতো মানুষজনের অভাব বলেই আজ এত দুর্দশা।

সবার ওপরে দেশ আর দেশের নাড়ির টান। সে টানের আরেক নাম বাংলা ভাষা। বাংলা ভাষা ও দেশ একসূত্রে গাঁথা। ভাষা যত বলীয়ান হবে, সমৃদ্ধ হবে, যত বলশালী হবে, তত প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম সে পথ দেখাবে। সব সংকীর্ণতা আর বিভেদমুক্ত করে বাঙালি করে রাখবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট, সিডনি প্রবাসী

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ডা. জাফরুল্লাহর স্মরণসভায় বক্তারা / দেশ ও জাতি দুঃসময় পার করছে

এবার মাদ্রাসাও বন্ধের ঘোষণা

ভোটারবিহীন ক্ষমতা সৌভাগ্য নয়, দুর্ভাগ্য: স্বপন 

পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতি জাতিসংঘে তুলে ধরল বাংলাদেশ

সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ / বিআইপিডির কোটি টাকা পরিশোধ করছে না ফার ইস্ট ফাইন্যান্স

কিশোরগঞ্জে খালে ডুবে ২ ভাইয়ের মৃত্যু

বিএনপির কারাবন্দি নেতা খোকনের পরিবারের খোঁজ নিলেন মহানগরীর নেতারা

কাতার ছাড়ার চিন্তা করছেন ফিলিস্তিনি নেতারা

তীব্র দাবদাহে জবির ক্লাস-পরীক্ষা নিয়ে সিদ্ধান্ত কাল

গরম কমাতে হিট অফিসারের যত পরামর্শ 

১০

এবার আগুনে পুড়ে ছাই ৪০ বিঘা পানের বরজ

১১

সাভারে ভাঙারির গোডাউনে আগুন

১২

গণতন্ত্রের শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে রাখতে হবে: তথ্য প্রতিমন্ত্রী

১৩

আগুনে রোদ আর তীব্র গরমে ওষ্ঠাগত প্রাণ

১৪

যুক্তরাষ্ট্রের উৎসবে সোহানা সাবা

১৫

মিনিস্টার হাই-টেক পার্কে ৫০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি

১৬

রাতেই যেসব জেলায় ৮০ কিমি বেগে ঝড়ের শঙ্কা

১৭

৭১ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিচ্ছে এডিবি

১৮

প্রেমিকাকে পেতে পাগলা মসজিদের দানবাক্সে চিঠি দিলেন সাইফুল

১৯

নির্বাচনে যে কেউ অংশগ্রহণ করতে পারবে : ইসি আলমগীর

২০
*/ ?>
X