ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
প্রকাশ : ১৫ অক্টোবর ২০২৩, ০২:১০ পিএম
আপডেট : ১৫ অক্টোবর ২০২৩, ০৭:০৩ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সাক্ষাৎকার

সরকারের কোনো নীতি কাজ করছে না

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর এবং বর্তমানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। ১৯৬৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে এবং ১৯৭৪ সালে কানাডার এমসি মাস্টার্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭৮ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে তিনি সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানে (সিএসপি) যোগ দেন। এ ছাড়া তিনি বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের বর্তমান অবস্থা, খেলাপি ঋণ, ডিজিটাল ব্যাংকিং, রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতি, বিদেশি বিনিয়োগসহ নানা বিষয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা

কালবেলা: সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকগুলোর ক্রেডিট রেটিং নিয়ে একটা আলোচনা চলছে। এমনকি দেশের ক্রেডিট রেটিংয়েও অবনমন ঘটেছে। এমনটা কেন ঘটল এবং এর থেকে উত্তরণের উপায় কী?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: সর্বজনীন ক্রেডিট রেটিং এবং সেক্টরাল ক্রেডিট রেটিংয়ে আমরা যা দেখতে পাচ্ছি তা শুধু কোনো রেটিং নয় বরং এর ব্যাপকতা রয়েছে। ক্রেডিট রেটিং কেন কমে যাচ্ছে সেটার গভীরে অনুসন্ধান করলে দেশের কতগুলো আর্থিক খাতের একই সঙ্গে পুরো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো স্পষ্ট হবে। এর সঙ্গে যুক্ত ঋণখেলাপি, অর্থ পাচার, শাসন প্রক্রিয়ার ত্রুটি, ব্যাংকিং সেক্টরের স্ক্যামসহ আরও অনেক বিষয়। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো এটা শুধু ক্রেডিট রেটিং এবং ব্যাংকিং সেক্টরের প্রশ্ন নয়, এখানে পলিটিক্যাল স্ট্যাবিলিটি এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ একটি বড় বিষয়। রেটিং কমিটির মেম্বাররা রেটিং করার সময় এই বিষয়গুলোও দেখেন।

সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে শুরু করে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন, বিটিআরসির মতো স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর দুর্নীতি এখানে গুরুত্বপূর্ণ। তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে- চলমান অর্থনৈতিক সংকট। মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে, রিজার্ভ কমে যাচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়গুলোকে ম্যানেজ করতে পারছে না। এরপর আছে অর্থ পাচার, হুন্ডির মতো বিষয়। সুতরাং এটা কোনো হালকা বিষয় নয়। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুর্বলতাগুলো তারা চিহ্নিত করেন।

দিন দিন এই সংকট আরও প্রকট হচ্ছে। আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় এই রেটিংগুলো হয়। আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংক ছাড়া ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্ট করা সম্ভব ছিল না। ইকোনমিক রিফর্ম, রিজার্ভ ক্যালকুলেশনসহ বিভিন্ন ব্যাপারে কথা বলছে আইএমএফ। পরের বার আইএমএফ প্রতিনিধিরা বাংলাদেশে এসে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যালেন্স শিট দেখতে চাইবেন। যারা রেটিং কমিটিতে থাকেন তারা প্রত্যেকে একেকটা বিষয়ে এক্সপার্ট। সুতরাং রেটিংটাকে হেলাফেলা না করে সিরিয়াসলি নেওয়া উচিত। ক্রেডিট রেটিং শুধু ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা না, বা শুধু ব্যাংকের অর্থ ব্যবস্থাপনা না। ডেসটিনি, এমটিএফের মতো ফ্রড প্রতিষ্ঠান কাজ করেছে বাংলাদেশে। এগুলোর রেকর্ড আমরা জানি। সুতরাং চ্যালেঞ্জগুলো এত প্রকট হয়ে গেছে যে গভীরভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপরে কেউ যদি তাকায় তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতির অর্জনগুলো চোখে পড়ার মতো অবস্থায় আর নেই।

কালবেলা: বর্তমানে ব্যাংকিং সেক্টরের পারফরম্যান্স সন্তোষজনক নয়। এর মধ্যে আমরা দেখছি নতুন ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের যাত্রা করতে যাচ্ছে। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: সমস্যা হলো প্রযুক্তি। প্রযুক্তিকে বন্ধ বা আটকে রাখা যাবে না। ফিনটেক এসেছে, এমএফএস এসেছে, অনেকে ক্রিপ্টোকারেন্সির কথা বলছেন। কিন্তু এগুলো চট করে না করে একটু সাবধানে করা উচিত। বাংলাদেশের মতো একটি দেশে সাইবার সিকিউরিটি নিশ্চিত না করে হঠাৎ করে যদি একটি টেকনোলজি নিয়ে আসা হয়, সেটা ঠিক হবে না। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সচেতনতা কম। বাংলাদেশে নতুন করে কিছু আনার দরকার নেই। যে ব্যাংকগুলো রয়েছে সেগুলোর ডিজিটাল সেবা আরও সহজ করা উচিত এবং তাদের সেবা আরও সম্প্রসারণ করা উচিত। মানুষকে ব্যাংকিং সেক্টরের সঙ্গে আরও বেশি যুক্ত করা উচিত। এটা করলেই অনেক কাজ হয়ে যাবে। শুধু এজেন্ট ব্যাংক এবং মোবাইল ব্যাংকিং দিয়ে হবে না। প্রকৃত ব্যাংকগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।

বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সচেতনতা অনেক কম। এ কারণে এখানে ফ্রডের ঘটনা অনেক বেশি। এই বিষয়গুলো কে দেখবে? কারা নিয়ন্ত্রণ করবে? এটা কি বাংলাদেশ ব্যাংক দেখবে নাকি সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দেখবে? নাকি এটা আইসিটি মন্ত্রণালয় দেখবে? বিটিআরসিও বিষয়টা দেখতে পারে।

৫২ জন আবেদন করেছেন যারা মোবাইল ব্যাংকিং বা ডিজিটাল ব্যাংকিং চালু করতে চান তারা মূলত ব্যবসায়ী। ব্যাংকিং এবং ফিন্যান্সিয়াল টেকনোলজি সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। তাদের ধারণা হলো- একটা ব্যাংকিং সেবা চালু করলে অনেক টাকা জমা হবে তাদের কাছে। কিন্তু এখানে জবাবদিহি এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিতের বিষয় রয়েছে। যেমন- ইভ্যালিতে শত শত কোটি টাকা জমা হলেঅ কিন্তু তাদের কোনো হিসাব নেই। তারা কত টাকা সেখান থেকে খরচ করে ফেলছে কত টাকা রয়েছে তার কোনো হিসাব নেই। সেখানে ব্যাংকগুলো ডিজিটাল সেবা চালু করলে অন্তত তাদের একটা হিসাব থাকে।

নতুন মোবাইল ব্যাংকিং বা ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবার লাইসেন্স দিতে হলে এই বিষয়গুলোকে কীভাবে হ্যান্ডেল করা হবে তা নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকে যায়। আমাদের দেশে সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা যথেষ্ট দুর্বল, এর প্রমাণ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রিজার্ভের অর্থ লুট হওয়া। আমাদের আরও একটি বিশেষ সমস্যা হলো ব্যাংকিং সেক্টরের গুরুত্বপূর্ণ ও টেকনিক্যাল জায়গাগুলোতে বিদেশিদের দিয়ে কাজ করানো। এখানে একটি বড় ধরনের টেকনোলজিক্যাল দুর্বলতা থেকে যায়। এসব জায়গায় আমাদের দেশিও ব্যক্তিরা কাজ করলে একটা জবাবদিহির জায়গা থাকে। এসব জায়গায় বাইরে থেকে আনা লোক কাজ করলে তারা কী করে রেখে গেল, সেটা আমরা জানতেও পারি না। এমনকি এসব গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরের সার্ভারও অভ্যন্তরীণ হওয়া উচিত। দেশের ব্যাংকিং সার্ভারের সোর্স কোডসহ সব সিকিউরিটির ব্যাপারগুলো তারা জানার কারণে বাইরে থেকে ম্যানিপুলেট করার একটি আশঙ্কা থেকে যায়।

আমি মনে করি, বাংলাদেশ ব্যাংক আপাতত নতুন কোনো মোবাইল ব্যাংকিং বা ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের অনুমোদন না দিয়ে এটা স্থগিত রাখুক। আগে আমাদের ক্যাপাসিটি ডেভেলপ করা হোক, সিকিউরিটি নিশ্চিত করা হোক, রিস্ক ম্যানেজমেন্টকে আরও গুরুত্ব দেওয়া হোক। বিকাশ, নগদ, রকেটের মতো মোবাইল ব্যাংকিং সেবাগুলোকে পর্যবেক্ষণ করে এগুলোর দুর্বলতা চিহ্নিত এবং তার সমাধান করা হোক। ই-কমার্সে কি হচ্ছে, এখানে কীভাবে মানুষকে ঠকানো হচ্ছে সেই বিষয়গুলো ভালোভাবে জানা হোক। এসব এক্সপিরিয়েন্স জানার পর তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক।

কালবেলা: বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে এক ধরনের সংকট দেখতে পাচ্ছি। আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে ডলার খুব বেশি আসছে না, কিন্তু অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স আসছে। এ সমস্যার সমাধান কীভাবে হতে পারে?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: যে পরিমাণ বাংলাদেশি প্রবাসী হয়েছেন সেই তুলনায় রেমিট্যান্স বাংলাদেশে আসছে না। আমি এটাকে বাংলাদেশের একটি পলিসিগত ত্রুটি হিসেবে দেখি। রিজার্ভ আটকে রাখার বাংলাদেশ ব্যাংকের ভুল পলিসি, যেখানে প্রবাসীরা ডলার পাঠালে বাংলাদেশ ব্যাংক যে রেট ধরেছিল তার থেকে অনেক বেশি তারা পেতেন হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠালে। যেখানে ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠালে তারা ডলারপ্রতি ৮০ থেকে ৮৫ টাকা পেতেন সেখানে হুন্ডিতে তারা পেতেন ৯০ থেকে ৯৫ টাকা। আবার ব্যাংক ডলার প্রতি ১০০ টাকা করে দিলে হুন্ডিতে তারা পেয়েছেন ১০৭ থেকে ১০৮ টাকা। সুতরাং এখানে মানুষ হুন্ডিতে টাকা পাঠানোতে বেশি উৎসাহী হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের এক্সচেঞ্জ বাড়ালেও আনানুষ্ঠানিক বাজারে এ হার আরও বেশি। সুতরাং হুন্ডি বাজার জমে উঠেছে।

দ্বিতীয়ত, টাকা পাঠানোর সুবিধার ব্যাপার। প্রবাসে যারা কাজ করেন তারা সেসব দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলেও কাজ করেন অনেকে। যেসব জায়গায় ব্যাংকিং এজেন্ট নেই। তাদেরকে ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর জন্য অনেক দূরে এসে তারপর টাকা পাঠাতে হতো। অপরদিকে যারা হুন্ডি ব্যবসার সাথে জড়িত তাদের এজেন্ট এসব ব্যক্তিদের কাছে নিজেরাই যায়। ফলে হুন্ডিতে তাদের টাকা পাঠানোর সুবিধা হয়। ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর ব্যবস্থাকে আরও সহজ করতে হবে। একটি ইন্টিগ্রেটেড সিস্টেমের মধ্যে আনতে হবে যাতে প্রবাসীরা একটি ব্যাংকে টাকা পাঠালে সেটা তার এলাকার বা পরিবারের সুবিধামতো যে কোন ব্যাংকের যে কোনো শাখা থেকে তা তুলতে পারেন। এই প্রক্রিয়াটা বাংলাদেশ করতে পারছে না। চতুর্থত্ব ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রক্রিয়াকে আরো দ্রুত করতে হবে। টাকা ডেলিভারিকে আরও দ্রুত করতে হবে। কারণ হুন্ডিতে তারা আজকে টাকা পাঠালে আজকেই পেয়ে যান।

পঞ্চম সমস্যা হলো ডলারের একাধিক রেট। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে চার ধরনের রেট নির্ধারণ করেছে। মাল্টিপল রেট হলে সেখানে ছলচাতুরী বা দুর্নীতির সুযোগ থাকে। সুতরাং সকল ক্ষেত্রে একই রেট নির্ধারণ করা দরকার। যারা রপ্তানি করবেন তারা যদি এখানে একটু বেশি ভর্তুকি পান তাতে তো কোনো সমস্যা নেই। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো যখন কোথাও বিনিয়োগ করে তখন তারা দুটি জিনিস দেখে। একটা হল -তারা কোন দেশে বিনিয়োগ করবে, আরেকটা হলো- কোন পণ্য উৎপাদনে বিনিয়োগ করবে। বাংলাদেশের বিনিয়োগ করার চিন্তা করতে গেলে তারা ডলার রেট নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যান। তারা ভাবেন, তারা ইমপোর্ট করবেন একটি রেটে আবার এক্সপোর্ট করবেন আরেকটি রেটে। এই ফোরকাস্টিংগুলো তাদের জন্য জটিল হয়।

আরেকটি বিষয় হলো লভ্যাংশ পাঠানোর ব্যাপার। যেমন এই মুহূর্তে বাংলাদেশে ডলার সংকটের কারণে গ্রামীণ ফোনসহ আরো অনেক কোম্পানি ডলার পাঠাতে পারছে না। এগুলো বিনিয়োগকারীদের জন্য সমস্যাজনক। তাছাড়া এখানে আমাদের ভৌত অবকাঠামোর একটি ব্যাপার রয়েছে। আমাদের দেশে কখন কোন এলাকায় বিদ্যুৎ চলে যায় সেটার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। রাস্তাঘাট পোর্ট ফ্যাসিলিটিসের সমস্যা রয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগ আনার জন্য এসব ফেসিলিটিস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রিজার্ভ বাড়াতে হলে এগুলো সবই আমাদের লাগবে।

কালবেলা: বারবার ঋণ রিশিডিউল সম্পর্কে আপনার অভিজ্ঞতা কী বলে?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: কনসেশন লোন একটি খারাপ জিনিস। ডিফল্ট লোন রিইস্যু করা, রাইট আপ করা, বারবার কনসেশন দেওয়া এটা একটি পরিত্যক্ত জাহাজের মতো। যখন এটাকে আর ঠিক করা যায় না, তখন যে যেভাবে পারে ঝাঁপ দিতে থাকে। যতটুকু স্যালভেজ ভ্যালু থাকে সেটা আদায় করলে ডিফল্ট অনেক কমে যায়। কিন্তু এখন যে বিষয়টা ঘটছে তা হলো, যারা ঋণ পরিশোধ করতে পারবে তারাও পরিশোধ করছে না। অন্যদিকে যারা ঠিকমতো ব্যাংকিং ঋণ পরিশোধ করছে তাদের মধ্যে একটি দ্বৈততা সৃষ্টি হচ্ছে। যারা ঋণ স্বল্প পরিমাণ পরিশোধ করছে তাদেরকে আবারো ঋণ দেওয়া হচ্ছে। পুরস্কৃত করা হচ্ছে। এটা একটি বিকৃত প্রণোদনা। এতে সৎ ঋণ পরিশোধকারী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ জন্যই দেশে ব্যবসার উন্নতি হচ্ছে না, নতুন ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে না এবং ভালো লোক উঠে আসছে না।

দিনে দিনে কনসেনট্রেশন লোন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে কতগুলো লোকের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ছে বাজারব্যবস্থা। বাজার যখন জিম্মি হয়ে যাবে, বাজারের ওপর যখন রাষ্ট্রীয় অথরিটির নিয়ন্ত্রণ থাকবে না, তখন সেটা সবচেয়ে খারাপ অবস্থা। একটা সময় তারা যদি বাংলাদেশ ব্যাংককে বলে টাকা ফেরত দিতে পারব না। তখন কি পরিস্থিতি তৈরি হবে?

কালবেলা: মুদ্রানীতিতে আমানতের সুদের হারের সিলিং শিথিল করা হলো। কিন্তু ব্যাংকের সুদের হারের তেমন পরিবর্তন হয়নি এবং এখনো সেটি মূল্যস্ফীতির নিচেই রয়েছে....

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: আমানতের সুদের হার উঠিয়ে নেওয়ার যে কথাটি বলা হয়েছিল এটা এক ধরনের আইওয়াশ। এগুলো মন ভোলানো কথাবার্তা। ট্রেজারি রেট কোনো মার্কেট রেট না এবং এটা বানানো একটা বিষয়। সুতরাং এর সাথে তিন যোগ করে কী লাভ হলো! মার্কেটের ডিমান্ড অনুযায়ী রেট দিতে হবে। সেটা দুই তিন পারসেন্ট হোক অথবা ১৩ শতাংশ হোক। কেউ আমানত নিলে নেবে, না নিলে নেই। সুতরাং সরকার যেটা করেছে সেটা সরকারের সুদের জন্য করেছে। সরকার সেই টাকাটা পাবে। এ জন্যই এখন ডিপোজিট প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না। মানুষ ব্যাংকবিমুখ হয়ে গেছে। মানুষ পকেটে টাকা রেখে দিচ্ছে। তারা ভাবছে ব্যাংকে রেখে লাভ কী? ব্যাংকে যেতে হবে, কত প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে, সাত দিন আগে নোটিশ দিতে হবে, কী দরকার এগুলো করার। সরকার টাকা ছাপাচ্ছে। ইতিমধ্যে ৬০-৭০ হাজার কোটি টাকার বেশি ছাপিয়ে ফেলেছে। যার ফলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়ছে।

সমস্যার গভীরে গিয়ে চিন্তাভাবনা করে পলিসি ঠিক করতে হয়। হুটহাট করে পলিসি পরিবর্তন করা ঠিক না, যা বাংলাদেশ ব্যাংক দুদিন পরপর করছে। ঋণ রিশিডিউল করছে কয়দিন পরপরই। যারা ঋণখেলাপি তাদেরকে আবারও সময় দেওয়া হচ্ছে, সুদ মওকুফ করা হচ্ছে, আবারও ঋণ দেওয়া হচ্ছে। কাউকে বিশেষ ক্ষমতা বলে হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হচ্ছে। আবার অনেকে যারা সঙ্গত কারণেই লোন পরিশোধ করতে পারেনি তাদের নামে মামলা ঠুকে দেওয়া হচ্ছে। সরকারের কোনো নীতি কাজ করছে না। মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।

শ্রুতলিখন : মুজাহিদুল ইসলাম

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

একদিনের জন্য কারাগারে যেতে হবে হলান্ডকে!

বিশ্বব্যাংকের আয়োজনে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের গ্রাফিতি প্রদর্শনী

‘ফ্যাসিস্ট’ হাসিনার সরকার কাউকে রেহাই দেয়নি : রিজভী

সব সংস্কার অন্তর্বর্তী সরকারের দ্বারা সম্ভব নয় : তারেক রহমান

ভঙ্গুর শিক্ষাব্যবস্থাকে দ্রুত আলোর পথ দেখাব : ভিসি আমানুল্লাহ

ম্যানসিটির অবনমন হলেও দলের সঙ্গে থাকার প্রতিশ্রুতি গার্দিওলার

আন্দোলনে ঢামেক শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ প্রেরণা জুগিয়েছিল : আসিফ মাহমুদ

ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনে দুদিনে মামলা ২৭০৯ 

চাকরি দিচ্ছে ওয়ালটন, ১৮ বছর হলেই আবেদন

রাহুল-জয়সওয়ালের ব্যাটে পার্থে ভারতের দাপট

১০

এবার ইসরায়েলের পক্ষে দাঁড়াল আরও এক দেশ

১১

হাসিনা ও দোসরদের পুনর্বাসন নিয়ে কোনো সাফাই নয় : সারজিস

১২

বিচ্ছেদ নিয়ে মুখ খুললেন রাহমান পুত্র এবং মোহিনী

১৩

আরও ২ দিন বন্ধ থাকবে সিটি কলেজ

১৪

বইমেলার স্টল ভাড়া ৫০ শতাংশ কমানোর দাবি প্রকাশকদের

১৫

পতিত স্বৈরাচারের ষড়যন্ত্র থেমে নেই : নাজমুল হাসান

১৬

প্যারালাইসড রোগীদের জন্য আশার আলো মাস্কের ‘মস্তিষ্ক চিপ’

১৭

প্রতিটা মিনিট এই পৃথিবীকে উপহার দাও : আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

১৮

৩৫ লাখ বেতনে চাকরি দিচ্ছে কানাডা হাইকমিশন

১৯

নেতানিয়াহুকে গ্রেপ্তার করবে মিত্র যুক্তরাজ্য

২০
X