মুক্তিযুদ্ধের সুহৃদ

মুক্তিযুদ্ধের সুহৃদ
প্রতীকী ছবি।

প্রণবেশ সেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এক অকৃত্রিম বন্ধু। একাত্তরে এদেশের মুক্তি-সংগ্রামের সঙ্গে একাত্ম হয়েছিলেন। কেননা বাংলাদেশ হলো তার জন্মভূমি। যুদ্ধের মাঠে গিয়ে তিনি অস্ত্র ধরেননি। কিন্তু পেশাগত দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য কাজ করেছেন। প্রণবেশ সেন ছিলেন আকাশবাণীর খবর আর সংবাদ পরিক্রমার স্ক্রিপ্ট রাইটার।

দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে যারা সংবাদ পরিক্রমা আর খবর শুনেছেন, তারা প্রণবেশ সেনের নামের সঙ্গেও পরিচিত। এই প্রণবেশ সেনের মেধা মূর্ত হয়ে উঠেছিল দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে। প্রণবেশ সেন মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন। প্রণবেশ সেনের জন্ম ১৯৩৭ সালে বৃহত্তর পাবনার সিরাজগঞ্জ শহরে। লেখাপড়া করেছেন পাবনার এডওয়ার্ড কলেজে। ১৯৫৪ সালে চলে যান ভারতে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনেও তিনি যোগ দিয়েছিলেন কলেজে পড়াকালে। প্রণবেশ সেনের বাবা কমলেশ চন্দ্র সেন একসময় পাবনার জিপি ছিলেন।

আওয়ামী লীগ নেতা তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর সঙ্গে ছিল তাদের পারিবারিক সম্পর্ক—বাবার সঙ্গে ছিল বন্ধুত্ব। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে (মেহেরপুরের ভাবেরপাড়া গ্রাম) মন্ত্রিপরিষদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের পর দেখা হয়েছিল ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর সঙ্গে। তার কাছেই তিনি প্রথম খবর পান তার আত্মীয়স্বজনদের। প্রণবেশ সেন বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রিপরিষদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটি রেকর্ড করেছিলেন। বিশেষ সংবাদ বিচিত্রায় পরের দিন তা শোনানো হয়েছিল। সেই সংবাদ বিচিত্রার গোড়াতেই বাজানো হয়েছিল অংশুমানের গাওয়া ও শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণের ইনসার্ট সংবলিত গান ‘শোনো একটি মুজিবের কণ্ঠস্বরে ধ্বনি প্রতিধ্বনি’। প্রণবেশ সেন দূরদর্শনেও কাজ করেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উপলক্ষে তিনি বিভিন্ন ঘটনার ওপর ভিত্তি করে (১৯৪৭-৭১) দূরদর্শনের জন্য তৈরি করেছিলেন ‘সূর্যাস্তে সূর্যোদয়’ শীর্ষক তিন পর্বের অনুষ্ঠান। এটি ডিডি-১ ও ডিডি-৭-এ প্রচারিত হয়েছিল।

মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান বিষয়ে এক স্মৃতিচারণে তিনি বলেছেন, সেদিন আকাশবাণীর নিউজ রুমে কাজ করছি। সংবাদ পরিক্রমার বুলেটিন প্রচার শেষ হয়েছে। এবার ঘরে ফেরার পালা। হঠাৎ এসে বার্তা সম্পাদক দ্বীপেশ ভৌমিক বলেন, ‘আপনার আর উপেন তরফদারের বাড়ি ফেরা হবে না। রাতেই যেতে হবে। কলকাতা প্রেস ক্লাবে। ব্যাপারটা জানতে চাইলে বার্তা সম্পাদক এড়িয়ে যান। তবে তিনি বললেন, বিএসএফের জনসংযোগ কর্মকর্তা সমর বসু যা বলবেন তাই করবেন। আমরা রাত ৩টায় প্রেস ক্লাবে পৌঁছি। দেখি বহু গাড়ি লাইন দিয়ে আছে। অপেক্ষা করছেন বহু দেশি-বিদেশি সাংবাদিক। সমর দাকে জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার, এত রাতে তলব? উনি উত্তর না দিয়ে না চেনার ভান করলেন।

কিছুক্ষণের মধ্যে দেখি সমরদা এগিয়ে গেলেন। দুই ভদ্রলোককে স্বাগত জানিয়ে নিয়ে এলেন ভেতরে। এর একজন সম্ভবত যশোরের জেলা প্রশাসক। উনি এসে আমাদের বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে আমন্ত্রণ জানালেন— বললেন, আপনারা আসুন। তারপর ভদ্রলোক দুজন বেরিয়ে গেলেন। উঠলেন গাড়িতে। আমরাও উঠলাম। গাড়ির বহর ছুটল। ভাবছিলাম কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমাদের? একসময় দেখি আমরা কৃষ্ণনগর এসে পৌঁছেছি। তারপর ভাঙাচোড়া রাস্তায় কয়েক কিলোমিটার পর গাড়ি থামল। এবার হাঁটার পালা। মনে তখন নানা প্রশ্ন উঁকি মারছিল। ভাবছিলাম আমাদের জন্য হয়তো কোনো বিস্ময় অপেক্ষা করছে—হয়তো শেখ মুজিব আত্মপ্রকাশ করবেন, হয়তো বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হবে, নয়তো মুক্তিবাহিনীর হাতে আটক কোনো পাকিস্তানি সামরিক ব্যক্তিকে উপস্থাপন করা হবে ইত্যাদি নানা প্রশ্ন। হঠাৎ সে ভাবনা উবে গেল। আমরা উপস্থিত হলাম একটি গ্রামে। অসংখ্য মানুষের ভিড়, হাতে রাইফেল, কারও হাতে এলএমজি। কারও হাতে আবার বাংলাদেশের পতাকা। তৈরি হয়েছে মঞ্চ। কাগজের তৈরি লাল আর সবুজ পতাকা দিয়ে সাজানো হয়েছে, এবার জানলাম বাংলাদেশের মন্ত্রীদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হবে। তারিখটি ১৭ এপ্রিল।’

মুক্তিযুদ্ধের একটি ঘটনার স্মৃতি তাকে তাড়িয়ে বেড়াত। মাঝে মাঝে সীমান্ত এলাকায় যেতেন তিনি। উদ্দেশ্য, খবর সংগ্রহ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজ-খবর নেওয়া। এমনি একদিন উপেন তরফদারকে নিয়ে গিয়েছিলেন। হঠাৎ ছোট্ট মেয়ে আয়েশার সঙ্গে পরিচয়। বহু নির্যাতন চালানো হয়েছিল কিশোরী আয়েশার ওপর। উপেন তরফদার আয়েশার কথাগুলো রেকর্ড করেন। অত্যাচারের কথা বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে আয়শা। আর সেই কান্নামাখা কণ্ঠে গেয়ে ওঠে আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। আর তখন প্রণবেশ সেনের মনে হয়, বাঙালি অত্যাচারিত হলেও ভেঙে পড়ে না। কেননা তারা স্বাধীনতা চায় জীবনের বিনিময়ে। মুক্তিযুদ্ধের সুহৃদ প্রণবেশ সেন ২০০০ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.
logo
kalbela.com