নেতা আছে, নেতা নেই

চিররঞ্জন সরকার।
চিররঞ্জন সরকার।পুরোনো ছবি

আমাদের দেশে সুস্থ ধারার রাজনীতি ও গণতন্ত্রের চর্চা না থাকলে কী হবে, রাজনৈতিক দল, জোট ও নেতার কোনো অভাব নেই। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে আছে ১৪ দলীয় জোট। এ জোটের দু-তিনটি ছাড়া বাকিগুলো নামসর্বস্ব। যাদের সারা দেশে এক হাজার সমর্থক খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ! ওদিকে সরকারবিরোধী অবস্থানে থাকা দলগুলোর অবস্থা আরও শোচনীয়। চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে সমমনা ৩২টি রাজনৈতিক দল। গঠিত হয়েছে আলাদা তিনটি রাজনৈতিক জোট। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ ১০ দফা দাবি আদায়ে যুগপৎ আন্দোলনে এসব দলকে নিয়ে বিএনপি নানা কর্মসূচি পালন করছে।

যদিও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিএনপির নেতৃত্বে এ সাইনবোর্ডসর্বস্ব ছোট দলগুলোর রাজপথের সামর্থ্য নিয়ে খোদ বিএনপির নেতাকর্মীদেরই সন্দেহ রয়েছে। বিএনপির সমর্থনে তিন জোটে রয়েছে ৩০টি রাজনৈতিক দল। এর মধ্যে নাগরিক ঐক্য, গণ অধিকার পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলনসহ সাতটি দল নিয়ে গঠন হয়েছে গণতন্ত্র মঞ্চ। বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোট ভেঙে গঠন করা হয়েছে ১২ দলীয় জোট। আর জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট নামে একত্র হয়েছে ১১টি রাজনৈতিক দল। এই তিন জোটের বাইরে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি এলডিপি স্বতন্ত্র দল হিসেবে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করছে। প্রশ্ন হলো, এই ৩০-৩২টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিএনপি ও জামায়াত ছাড়া অন্য দলগুলোর ৫০০ মানুষকে সমবেত করার সামর্থ্য আছে কি?

আসলে আমাদের দেশে রাজনৈতিক দল, জোট ও নেতার অভাব না থাকলেও প্রকৃত রাজনীতি ও যোগ্য নেতার বড়ই অভাব। দেশে বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে না। অনেকেই বলাবলি করেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব থেকে শেখ হাসিনার অবসর নেওয়া উচিত। কিংবা বিএনপির নেতৃত্ব থেকে বেগম খালেদা জিয়ার সরে দাঁড়ানো দরকার। কিন্তু সত্যিই কি আমাদের দেশে শেখ হাসিনা কিংবা বেগম খালেদা জিয়ার তেমন যোগ্য বিকল্প নেতৃত্ব আছে? তেমন বিকল্প নেতৃত্ব সৃষ্টির সুযোগ কি দেওয়া হয়েছে?

এমনিতে এখন দলগুলোতে নেতা কিলবিল করে। সভা-সমাবেশে ও মঞ্চে এখন কর্মীর চেয়ে নেতার সংখ্যা বেশি দেখা যায়। অধিক নেতার ভার বহন করতে না পেরে মঞ্চ ভেঙে পড়ার ঘটনাও ইদানীং ঘটছে। তবু দেশ উদ্ধার হচ্ছে না, মানুষের দুর্দশা কমছে না। অর্থাৎ দলগুলোতে গণ্ডা গণ্ডা নেতা পয়দা হলেও তাদের কেউ জননেতা হতে পারছে না। এটা আমাদের জন্য চরম দুর্ভাগ্যের।

চিররঞ্জন সরকার।
সাপুড়ে পাকিস্তানের বুকে সাপের ছোবল!

হ্যাঁ, দল পরিচালনা কিংবা দেশ পরিচালনার জন্য যোগ্য নেতার প্রয়োজন হয়। শুধু দল বা দেশ কেন, যে কোনো উদ্যোগ বা কর্মে, যে কোনো প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে গেলেই নেতা দরকার হয়। নেতা ছাড়া কোনো কাজ সুষ্ঠুভাবে করা যায় না। কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসে না। যোগ্য নেতৃত্ব ছাড়া কোনো কাজ করা মানে হচ্ছে—ছাগল দিয়ে ধান পাড়ানো। এতে কাজের কাজ কিছু হয় না। আমাদের দেশে অন্য অনেক ক্ষেত্রে নেতার অভাব না থাকলেও রাজনীতিতে যোগ্য নেতার অভাব লক্ষ করা যায়।

আমরা জানি যে, রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিই হচ্ছে রাজনীতি। একসময় বলা হতো, রাজনীতি হচ্ছে রাজার নীতি। রাজা কীভাবে দেশ পরিচালনা করবেন, সেটাই রাজনীতির মূল কথা। রাজনীতির সঙ্গে ‘নীতি’ কথাটা যুক্ত আছে। নীতি হলো কিছু আদর্শ নিয়মকানুন। অতীতে আমরা দেখেছি যারা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন, তারা নীতি-নৈতিকতার চর্চা করেছেন। রাজনীতিবিদদের মানুষ শ্রদ্ধা করত। তাদের কথায় জীবন উৎসর্গ করতেও দ্বিধাবোধ করত না। রাজনীতি ছিল একসময় দেশ ও মানুষের সেবা করার সবচেয়ে উত্তম পন্থা। যারা রাজনীতির খাতায় নাম লেখাতেন তারা আত্মস্বার্থ কখনো বিবেচনায় রাখতেন না।

দেশ-জাতি, মানুষের কল্যাণই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। তারা জাতির কল্যাণ সাধনায় ব্রতী হয়ে নিজেদের দিকে তাকানোর সময় পেতেন না। জনগণের স্বার্থকে সবার ওপরে স্থান দিয়ে সত্য ও ন্যায়ের পথে এগিয়ে চলতেন সব ধরনের ভয়ভীতি, লোভ-লালসাকে উপেক্ষা করে। আর এখন? সব কথা খুলে বললে চারদিকে হৈচৈ পড়ে যেতে পারে! দেশ-জাতি এসব শব্দ আজকের রাজনৈতিক নেতাদের কজনের মস্তিষ্কে বাসা বাঁধতে পেরেছে তা গবেষণার বিষয় হতে পারে। ওপর থেকে শুরু করে নিচ পর্যন্ত—সবখানে একই ধারা চলছে বছরের পর বছর ধরে। দলগুলো ব্যস্ত রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে রাখতে, কিংবা দখল করতে। আর নিচু পর্যায়ে ‘নেতারা’ ব্যস্ত হাতের কাছে যা পাওয়া যায় তার সবটা উদরস্থ করে ফুলেফেঁপে পাটখড়ি থেকে হাতি হতে। আর যারা রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে, তারা অপেক্ষায় থাকে কবে সে সোনার হরিণ ধরা দেবে, যা তাদের ভাগ্য খুলে দেবে। এ জন্য তাদের ছল-বল-কৌশল প্রয়োগের কোনো শেষ নেই।

রাজনীতির সঙ্গে নেতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নেতা ছাড়া রাজনীতি কল্পনাই করা যায় না। যাদের হাত ধরে নীতি প্রণয়ন হয়, প্রতিষ্ঠিত হয়, নীতির প্রচার ও প্রসার হয়, তাদের মধ্যেই আজ নীতি-নৈতিকতা নির্বাসিত প্রায়। আজকে রাজনীতির মাঠে নীতিহীন নেতার সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। তারা বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ নানা ধরনের অপকর্মের মহোৎসব পালন করে। সমাজসেবার নামে ফটোবাজি করে সমাজের বারোটা বাজায়। এমপি-মন্ত্রীদের ছবির সঙ্গে রংচটা পোস্টার ছাপিয়ে তারা বড় নেতা বনে যায়। অনুষ্ঠানের নামে চাঁদা তোলার মহড়া দেয়। এসব নেতা স্বার্থের জন্য কারও পায়ে মাথা ঠেকাতেও দ্বিধা করে না। আবার স্বার্থের জন্য কারও কপাল ফাটাতেও পিছপা হয় না।

চিররঞ্জন সরকার।
বিএনপির আন্দোলনের দৈর্ঘ্য কম প্রস্থ বেড়ে যাচ্ছে : কাদের

আজকের নেতারা নীতির চর্চা করেন না। তাই তো জাতি আজ নৈতিকতাহীন ও মেধাশূন্য হয়ে পড়ছে। তারা তাদের লাভের আশায় দেশের বারোটা বাজাতে একটুও চিন্তা করেন না। চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, খুনি, ছিনতাইকারী, মাদক কারবারিরা যখন সমাজের নেতৃত্বে আসে তখন তারা মানুষের জন্য কী করবে? ধান্দাবাজদের নেতৃত্বে সমাজ কখনোই এগিয়ে যাবে না। তাই তো আমরা বারবার এগিয়ে চলার পথে হোঁচট খাচ্ছি।

অনেকে জালিয়াতির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় মেডেলের সোনা মেরে, রাজউকের প্লট গ্রাস করে, বনের গাছ কেটে, বনের ভূমি নিজের নামে লিখিয়ে, চুক্তিবদ্ধ খুন অথবা গুম করিয়ে, মাদক ও সোনার চোরাচালানি করে। অনেকে আবার চাঁদাবাজির মাধ্যমে জোঁকের মতো রক্ত শোষণ করে। দেশের স্বার্থে, জনগণের মঙ্গলে, মানবতার স্বার্থে সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা ও আইনের শাসন বজায় রাখার জন্য কোনটি উচিত আর কোনটি অনুচিত—এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব নেতাদের হলেও তারা সেই কাজটি করেন না।

এ কথা ঠিক যে, আমাদের দেশে অনেক নেতা আছেন। কিন্তু যোগ্য নেতা কি আছেন? যারা লড়তে জানেন, জনকল্যাণে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত, যারা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, যারা ঘুষ-দুর্নীতি-লোভ-মোহের ঊর্ধ্বে উঠে সব মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন। তেমন নেতা কি সত্যিই আমাদের সমাজে আছে? তৈরি হচ্ছে? আমাদের পরিবারে, প্রতিষ্ঠানে সমাজে, রাজনৈতিক দলে তেমন নেতৃত্ব বিকাশের পথ কি আছে? নাকি ধান্দাবাজ-স্বার্থান্ধদেরই শুধু সামনে চলার পথ তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে?

বিখ্যাত নাট্যকার ব্রেটল্ট ব্রেশটের ‘গ্যালিলিওর জীবনী’ নাটকে গ্যালিলিওর এক শিক্ষার্থী আন্দ্রিয়া বলেছেন, ‘দুর্ভাগা সেই দেশ যাদের কোনো নেতা নেই।’ উত্তরে গ্যালিলিও বলেন, ‘না, দুর্ভাগা সেই দেশ যারা শুধু নেতারই প্রয়োজন অনুভব করে।’ হ্যাঁ, আমরা সত্যিই দুর্ভাগা যে, আমাদের দেশে যোগ্য নেতার অভাব রয়েছে। আমরা আরও বেশি দুর্ভাগা যে, আমরা শুধু নেতারই প্রয়োজন অনুভব করি!

লেখক : কলামিস্ট ও উন্নয়নকর্মী

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.
logo
kalbela.com