চিররঞ্জন সরকার
প্রকাশ : ১৭ ডিসেম্বর ২০২২, ০১:৪২ এএম
অনলাইন সংস্করণ

বিজয়েও থাকে ঘৃণা

বিজয়েও থাকে ঘৃণা

সেমিফাইনালে ক্রোয়েশিয়াকে ৩-০ গোলে হারিয়ে আর্জেন্টিনার ফাইনাল নিশ্চিত হওয়ার পর আমার বাসার পাশে আর্জেন্টিনা দলের সমর্থকরা মিছিল বের করে। মিছিলের স্লোগান ছিল একটাই—ব্রাজিল-ভুয়া, ব্রাজিল-ভুয়া!

মিছিলে আর্জেন্টিনার নাম নেই, যে দলকে হারাল সেই ক্রোয়েশিয়ার নাম নেই, এমনকি ফাইনালে যাদের সঙ্গে লড়বে—সেই ফ্রান্স বা মরক্কোর কথাও নেই। যারা টাইব্রেকারে ক্রোয়াটদের কাছে ৪-২ ব্যবধানে হেরে এবারের বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিয়েছে, যাদের সঙ্গে আর্জেন্টিনার সমর্থকদের কোনো সংযোগ-সম্পর্ক কিছুই নেই, সেই ব্রাজিলের নামে দুয়োধ্বনি!

সারা দিন ‘ব্রাজিল-ভুয়া’, ‘ব্রাজিল-ভুয়া’ এ ধ্বনিটা কানে বেজেছে! বঙ্গ দেশে আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের সমর্থকরা নিজের দলের জয়ে যতটা খুশি হয়, তার চেয়ে বেশি খুশি হয় তাদের নিজ নিজ ‘শত্রু’র পরাজয়ে। তাদের অভিধানটা বাংলাদেশের রাজনীতির অভিধানের মতো, যেখানে ‘বিরোধিতা’ মানে ‘শত্রুতা’! এই মনস্তত্ত্ব কোনোদিন পাল্টাবে বলে মনে হয় না।

খেলা নিয়ে আমরা যথেষ্ট বাড়াবাড়ি করি। কিন্তু স্বীকার করি না। বিশেষ করে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার সমর্থকরা। এ দুই দলের সমর্থকরা ছাত্রলীগ বনাম ছাত্রদলের মতো পারলে একে-অপরের হাড়-হাড্ডি গুঁড়ো করে দিই। কীভাবে অন্যকে জব্দ করা যায়, অপমান করা যায়, তাতিয়ে দেওয়া যায়, সারাক্ষণ সেই চেষ্টা করি। এতে নির্মল আনন্দের চেয়ে তিক্ততা হয় বেশি—সে হুঁশ আমাদের থাকে না। সেদিকে আমরা খেয়ালও রাখি না। ‘সেভেন-আপ,’ ‘থ্রি-পিস,’ ‘ডিমের হালি’—এসব উপমা কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিক্ততা, বিদ্বেষ এবং ঝগড়ার হাতিয়ার ছাড়া ফান-আইটেম কম হয়েছে।

আমরা আওয়ামী লীগ-বিএনপির মতো অন্ধ দলতন্ত্রে নিমজ্জিত ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার ক্ষেত্রেও। দলের কোনো দোষ বা ত্রুটিই কবুল করতে চাই না! হারলে বলি: ভাগ্য সহায় ছিল না, প্রতিপক্ষ ফাউল করে খেলেছে, রেফারি পারসিয়ালটি করেছে, ওমুকের ইনজুরি ছিল। কিন্তু শেষ বিচারে খেলা তো গোলের এবং ফলের। পরিস্থিতি যা-ই হোক, ফলটাই তো পরের সবকিছু নির্ধারণ করে। আমরা সুবিধা অনুযায়ী কখনো ‘ফল’, কখনো ‘শিল্প’পন্থি হয়ে যাই!

ফুটবল সমর্থন কি এমন অন্ধ দলবাজিতে পরিণত হওয়া উচিত? নাকি ‘ভালো খেলা’ বিবেচনায় হওয়া উচিত? বিষয়টি নিয়ে ভাবা দরকার! ‘ব্রাজিল শৈল্পিক ফুটবলের সূতিকাগার, পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন, কাজেই আমি ব্রাজিল;’ ‘যে দলে ম্যারাডোনা খেলেছে, মেসি খেলে, আমি সেই আর্জেন্টিনার সমর্থক;’ ‘কিংবা জার্মানি মানেই জয়, বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল, কাজেই আমি জার্মানি’—এ ধরনের আপ্তবাক্য কি আমাদের বিশেষ ‘দলপন্থি’ বানিয়ে ফেলছে না? এর পর যা হচ্ছে, আমরা নিজ দলের সমালোচনা নিতে পারছি না, নিজের দলকে সারাক্ষণ শ্রেষ্ঠ বলে প্রচার করে প্রতিপক্ষের বুকে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছি। কেউ দলের সমালোচনা করলে ‘হাতুড়ি’ নিয়ে তেড়ে যাচ্ছি! আমাদের ফুটবল সমর্থন কেন এমন অন্ধ হবে? ফুটবল সমর্থন তো পিতৃ বা মাতৃপরিচয় নয়, যে মুছে ফেলা যায় না বা পরিবর্তন করা যায় না! এটা কোনো মহৎ আদর্শও নয়, শুধু একটা ক্ষণিক আনন্দের উপাদান, এ নিয়ে এমন উন্মত্ত আচরণ আমরা কেন প্রদর্শন করব? আমাদের স্থায়ী সমর্থন শুধু বাংলাদেশের বেলায় প্রযোজ্য হওয়া উচিত। বাকি সব শর্তসাপেক্ষ, পরিবর্তন যোগ্য। এবার আমার মরক্কো বা ফ্রান্সের খেলা ভালো লাগতে পারে, আগামীবার হয়তো ব্রাজিল। তার পরেরবার হয়তো আর্জেন্টিনা বা অন্য কেউ! কিন্তু আমরা সেটা না করে নির্দিষ্ট দুই-তিনটি ফুটবল দলের সোল-এজেন্ট হয়ে বসে আছি। যেন আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বা ছাত্রলীগ, ক্ষমতাসীনদের প্রতি আনুগত্য না দেখালে, ‘দাসখত’ লিখে না দিলে চাকরি থাকবে না, উন্নতি হবে না! কেন আমাদের চিন্তায় সমর্থনে এই ‘দাসত্ব’ থাকবে?

বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে আমাদের শক্তি আর আবেগ অবশ্যই পরিশীলিত বা সংক্ষিপ্ত হওয়া দরকার। আসুন আমাদের সবটুকু শক্তি-সামর্থ্য-আবেগ আমরা ব্যবহার করি এই দুঃখিনী দেশটির কল্যাণে, নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে, বেকারদের কর্মসংস্থানের পক্ষে, দলবিশেষের দস্যুতা ও লুটপাটতন্ত্রের বিরুদ্ধে, মানবিক সমাজ নির্মাণের পক্ষে!

আরেকটি কথা। ফুটবলে মাত্রাতিরিক্ত ফাউল নিয়ে ভাবা দরকার। ফাউলটাই ‘গেম’ হয়ে দাঁড়াচ্ছে! ‘ফাউল’ রাজনীতিতেও আছে। আমাদের ব্যক্তিগত আচরণেও আছে। আর ফুটবলে তো আছেই। কথা হলো—এটা যেন কোনোমতেই সহনীয় না হয়, প্রাতিষ্ঠানিকতা না পায়!

এবারে বিশ্বকাপ দেখতে দেখতে বারবার মনে হয়েছে, ফাউলটা খেলার অংশ হয়ে যাচ্ছে না তো? ফুটবলের অনেক ভালো দিক আছে। তবে খারাপ দিকটা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। পরিচ্ছন্ন, ফাউলহীন খেলা একেবারেই কমে যাচ্ছে। অবাক লাগছে, বিভিন্ন দেশের খেলোয়াড়রা, এমনকি বেশ নামকরা খেলোয়াড়রাও, নির্বিচারে ফাউল করে যাচ্ছেন। যদি কেউ প্রথম ফুটবল খেলা দেখতে বসেন, সে তো ভাববেন, ফুটবলের একটা আবশ্যিক অঙ্গ বোধহয় বিপক্ষ খেলোয়াড়ের পা মাড়িয়ে দেওয়া, তাকে ধাক্কা মেরে ঠেলে ফেলে দেওয়া, তার পিঠে খুব জোরে কনুই দিয়ে মারা, তিনি যখন ছুটছেন তখন জার্সি ধরে টেনে পারলে ছিঁড়ে দেওয়া, প্যান্ট ধরে টানা, কর্নারের সময় তাকে জাপ্টে ধরে থাকা, তার হাতে হাত পেঁচিয়ে শিকল দিয়ে রাখা!

এ নিয়ে কথা বলতে গেলে দুই ধরনের আপত্তি শুনতে হয়। এক, ‘ফুটবল হচ্ছে কনট্যাক্ট স্পোর্ট, এসব একটু-আধটু হবেই।’ আর দুই, ‘ফাউল দিচ্ছেন তো রেফারি!’ মুশকিল হলো, এ ধরনের কথায়, অন্যায়কে সংগত বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফুটবল তো আর বক্সিং নয়, যে মারতে হবেই!

ফাউল কিন্তু একটু-আধটু হচ্ছে না, বাড়াবাড়ি রকমের হচ্ছে, আর একটা জিনিস বহুবার বা বারবার হলেই তা সহনীয় মনে হওয়া খুব খারাপ অভ্যাস। আর, রেফারি ফাউল দিন আর না দিন, এত ইচ্ছাকৃত অন্যায় কেন করা হবে? কেন খেলাটার প্রতি দায়বদ্ধতা থাকবে না এমন পরিমাণে যে, সৎ খেলোয়াড় বলবেন, কোনো পরিস্থিতিতেই এতটুকু অন্যায় করে জেতার প্রশ্ন ওঠে না? সবখানে নীতিনৈতিকতা চাইলে ফুটবলে নয় কেন!

লেখক : কলামিস্ট ও উন্নয়নকর্মী

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

দাজ্জালের সঙ্গে দেখা হয়েছিলো যে সাহাবির

লোহাগড়ায় জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ / কুপিয়ে জখম ৩

চুয়াডাঙ্গায় হিট অ্যালার্ট জারি

৮০ কিমি বেগে ঝড়ের শঙ্কা, সতর্কতা জারি

পাবলিশহার এক্সেলেন্স অ্যাওয়ার্ড পেলেন মিতিয়া ওসমান

৮৪ জন গ্রাউন্ড সার্ভিস এসিস্টেন্ট নিয়োগ দিল বিমান

প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের শাড়ি বন্ধুদের দিলেন ব্যারিস্টার সুমন

‘নতুন প্রজন্মের মাঝে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের তাৎপর্য তুলে ধরার আহ্বান’

লক্ষ্য যাত্রী সেবার মানোন্নয়ন  / ৮৪ জন গ্রাউন্ড সার্ভিস অ্যাসিস্ট্যান্ট নিয়োগ দিল বিমান

নওগাঁয় সিআইডি পরিচয়ে চাঁদাবাজি, অতঃপর...

১০

ইন্দোনেশিয়ায় অগ্ন্যুৎপাতে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে ১১ হাজার মানুষকে

১১

প্রবাসীদের রেমিট্যান্স উন্নয়নের অন্যতম মূল চালিকা শক্তি : দীপু মনি

১২

প্রচণ্ড তাপদাহে অগ্নি দুর্ঘটনা প্রতিরোধে যা করবেন

১৩

মেঘনায় জাটকা ধরায় ২০ জেলে আটক

১৪

হাইকমিশনারের সঙ্গে বৈঠক / বিএনপির কৌশল বুঝতে চায় ব্রিটেন

১৫

মদ বিক্রেতার হামলায় আহত হয়ে মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর

১৬

যৌন হয়রানির অভিযোগে শিক্ষক রিমান্ডে 

১৭

বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে অভিবাসী পাচারের অভিযোগে গ্রেপ্তার ২৪

১৮

সাভারে গ্যাস বিস্ফোরণে দগ্ধ ৩

১৯

বিএনপি-জামায়াত দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে : লিটন

২০
*/ ?>
X