শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক
প্রকাশ : ২২ অক্টোবর ২০২২, ১২:২৫ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

শিক্ষাব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন প্রয়োজন

শিক্ষাব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন প্রয়োজন

বাংলাদেশের মানুষ নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে তাদের জীবনযাপন করে চলেছে। অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক নানাভাবে আমরা সেই সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করতে পারি। স্বাধীনতা-পূর্বকালে ঔপনিবেশিক আমলে যে একটি অবস্থান ছিল, সেখান থেকে আজ ২০২২ সালে এসে আমরা অনেক দূর এগিয়ে এসেছি। দক্ষিণ এশিয়ার অনেক সূচকে আমরা এগিয়ে আছি। এমনকি বিশ্বের অনেক ক্ষেত্রে আমাদের উন্নয়নের যে গতিধারা প্রবাহ সেটি বিশেষ স্বীকৃতি লাভ করছে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর আমরা যে একটা অন্ধকার যুগে প্রবেশ করেছিলাম, সেখান থেকে আমরা ক্রমান্বয়ে বেরিয়ে আসছি। এখন দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, মানবিক উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য আমরা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে এ কথাটা মনে রাখা জরুরি, যে কোনো উন্নয়নের শর্ত হচ্ছে মানবিক উন্নয়ন। মানবিক উন্নয়নের ভিত্তি হচ্ছে শিক্ষার উন্নয়ন। এ ক্ষেত্রে সবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখার প্রয়োজন আছে। একটি কথা আছে, একটি জাতিকে যদি ধ্বংস করতে হয়, তার শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিলেই জাতি ক্রমান্বয়ে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাবে। সে রকম জায়গায় যেন আমাদের যেতে না হয়। সে জন্য শিক্ষা, শিক্ষক, শিক্ষানীতি, শিক্ষা উপকরণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—এ বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে সংবাদ প্রচার করা জরুরি।

শিক্ষাব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু সেভাবেই লক্ষ্য নির্ধারণ করে এগিয়ে চলছিলেন। তিনি প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বর্ধিত করে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেছিলেন। একটা দেশ, যা সমতার দর্শনে বিশ্বাসী সে জায়গায় প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় কোনো বিভাজন বঙ্গবন্ধু দেখতে চাননি। বঙ্গবন্ধু ড. কুদরাত-এ খুদার নেতৃত্বে যে শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিলেন, সে কমিশন রিপোর্ট বঙ্গবন্ধুর হাতে দেওয়া হয়েছিল, যেখানে ২৫০টি সুপারিশ ছিল। যেখানে শিক্ষাব্যবস্থাকে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়ার আশা প্রত্যাশা কমিশন করেছিল, তার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আমি এ কমিশন রিপোর্ট অতিদ্রুত বাস্তবায়ন করব। সেটা আমাদের পাওয়া সম্ভব হয়নি ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে পুরো দেশকেই হত্যা করা হয়েছিল। শিক্ষাব্যবস্থাকে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা থেকে বহুদূরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এখন প্রাথমিক শিক্ষাই বহু ধারায় বিভক্ত। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে বলেছিলেন, আমার নতুন শিক্ষানীতিতে এমন শিক্ষাব্যবস্থা চালু করব, যাতে কেরানি শিক্ষার প্রচলন যেন এ দেশে না থাকে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের একটি সাইডলাইন আয়োজনে ট্রান্সফরমিং এডুকেশন সামিট এই শিরোনামে যুক্ত হয়েছিলেন। যেটির আয়োজক ছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিব। সেই সামিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমাদের শিশুদের এখন থেকে বিশ্ব নাগরিক হিসেবে বড় হয়ে ওঠার শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। এই যে শিক্ষানীতিতে পরিবর্তন আনা হচ্ছে, সেটি কেন? কারণ একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা দেখতে পাচ্ছি গণমাধ্যমের প্রাচীর যেমন শিথিল হয়ে যাচ্ছে, তেমনি দেশের ভৌগোলিক সীমানা সেটিও ক্রমান্বয়ে শিথিল হয়ে যাচ্ছে। এখন বাংলাদেশে বসে অনলাইনে যুক্তরাষ্ট্রে অফিস করা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে কাজ পরিচালনা করা যাচ্ছে। এই একবিংশ শতাব্দীর কাজই হচ্ছে শিক্ষার সার্বিক উন্নয়ন। আমরা বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের শুধু বাংলাদেশে কাজ করার জন্য শিক্ষা দেব—এ নীতি নিয়ে চললে হবে না। বাংলাদেশে শিক্ষা গ্রহণের পর বিশ্বের যে কোনো দেশে গিয়ে সে তার দায়িত্ব পালন করবে অথবা বিদেশিরা এ দেশে এসে কাজ করবে। এ ধরনের এক বিশ্ব সম্প্রীতি গড়ার লক্ষ্যে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। এ জন্যই দরকার সেই ধরনের শিক্ষা, যাতে বিশ্ব সম্প্রীতি গড়ে তোলা যায়।

এ ছাড়া নারী শিক্ষা, নারী ক্ষমতায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী বারবার বলে থাকেন। এ ক্ষেত্রেও শিক্ষার প্রয়োজন আছে এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে নারীরা অনেকখানি এগিয়ে এসেছে। তবে আমাদের মূল্যবোধের শিক্ষার ক্ষেত্রে চরম ঘাটতি রয়েছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় মূল্যবোধ তৈরির যে সুযোগ, তা নেই বললেই চলে। আমরা জিপিএ-৫ কেন্দ্রিক যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেছি, তাতে একটা প্রতিযোগিতার শিক্ষাব্যবস্থা শুরু হয়েছে। কে কত গ্রেড পয়েন্ট অ্যাভারেজ পাবে, তা দিয়ে যে মানুষ তৈরি করা যায় না, তার দৃষ্টান্ত প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের আবরার হত্যাকাণ্ড। এর দৃষ্টান্ত হিসেবে আরও দেখা যায়, বড় বড় সরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক ব্যক্তির অনিয়ম করার বিষয়গুলো। এ অনিয়ম যারা করছেন, তারা সবাই উচ্চশিক্ষিত ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত। বঙ্গবন্ধুর কথায় আমাদের ফিরে যেতে হয় আবার, বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন—আমার শ্রমিক, আমার কৃষক দুর্নীতি করে না। দুর্নীতি করে সাদা পোশাকধারী মানুষ। সাদা পোশাকধারী বলতে উচ্চশিক্ষিত তথাকথিত জনগোষ্ঠীর কথা বলেছিলেন যিনি শিক্ষা লাভ করেন, তিনি দুর্নীতি করতে পারেন না।

আলেক্সান্দ্র সলজেনিৎসিনের (Aleksandr Solzhenitsyn) মিথ্যাকে পরিহার করার কথাটি বলেছিলাম; কিন্তু মানুষ কখন মিথ্যাকে পরিহার করবে, যখন সে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হবে। শিক্ষার আলোর প্রথম কথাই হচ্ছে মনুষ্যত্বের শিক্ষা। রবীন্দ্রনাথের একটি কথা আছে—শিক্ষার উদ্দেশ্য একটিই, তা হচ্ছে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটানো। এরপর একেকজন একেক পেশা অর্থাৎ ডাক্তার হওয়া, প্রকৌশলী হওয়ার দিকে যাবে। বঙ্গবন্ধু অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত একমুখী শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলেছিলেন, যেখানে বাংলাদেশের সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস—এ বিষয়গুলো গুরুত্ব দেওয়া হবে। যারা মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের আত্মত্যাগের কথা পড়বে বা জানবে, তারা কখনো অন্যায় করতে পারবে না; কিন্তু আমরা আমাদের শিক্ষনীতিকে সেদিকে নিয়ে যেতে পারিনি। নৈতিকতার থেকে বড় শিক্ষা আর কিছু হতে পারে না; কিন্তু নৈতিকতার শিক্ষা শুধু প্রতিষ্ঠান দিতে পারে না। এ ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পারিবারিক এ শিক্ষা থেকে আমরা অনেক দূরে সরে গেছি। আমাদের শিক্ষায় নৈতিকতার ওপর আরও অনেক বেশি গুরুত্বারোপ করা উচিত। আমরা যদি মানুষ না হই, তাহলে আমরা কীভাবে মানুষকে ভালোবাসব, দেশকে ভালোবাসব।

ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম (A. P. J. Abdul Kalam) বলেছিলেন, লবণ ও চিনি দেখলে একই রকম মনে হয়; কিন্তু পার্থক্য বোঝা যায় স্বাদে। ঠিক তেমন মানুষ ও অমানুষের মধ্যে পার্থক্য বোঝা যায় তাদের আচরণে। সুআচরণ, সুবচন, সুনীতি—এগুলো আসবে সুশিক্ষা থেকে। সেই সুশিক্ষা আমরা না দিতে পারলে প্রজাতন্ত্রকে বিশ্বের কাতারে নিয়ে যেতে পারব না। এ জন্য প্রয়োজন শিক্ষার ওপরে গুরুত্বারোপ করা।

সরকারের প্রচেষ্টা আছে বলেই, সরকার শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছে। সরকার তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা বাতিল করেছে। অর্থাৎ শিশুদের মধ্যে যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা, সেটা বাদ দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ পদ্ধতি হয়তো আরও উচ্চপর্যায়ের ক্লাস পর্যন্ত বিস্তার ঘটানো যেতে পারে। এ জন্য বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্য—এ বিভাজনটি মাধ্যমিক পর্যন্ত আর থাকছে না বলে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন। আমার মনে হয় এগুলো সময়োপযোগী যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। বিজ্ঞানের ছাত্রের কিছু ইতিহাস জানা থাকা উচিত, মানবিকের ছাত্রের কিছু বিজ্ঞান সম্পর্কে জানা থাকা উচিত। বঙ্গবন্ধুর একমুখী শিক্ষানীতিতে এ কথাটিই বলা হয়েছে।

আমাদের অধিকারের কথা সংবিধানে লেখা আছে। কিন্তু অধিকারগুলো যদি আমরা পেতে চাই, তাহলে সে জন্য কিছু দায়িত্ব আমাদের পালন করতে হবে। প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব আছে। রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দায়িত্ব আরও বেশি। তারা সংলাপে যাবেন এবং সংলাপের মাধ্যমে সমাধান করবেন। জনগণ যখন অবহিত থাকে, তখন জনগণই সমস্যার সমাধান করে। গণতন্ত্রের যে মূলনীতি জনগণের কাছে সব তথ্য উপস্থাপন করা, সত্য উপস্থাপন করা সেটা মানতে হবে। নিত্য সত্য তথ্য উপস্থাপনের কাজটি প্রতিনিয়ত চালু রাখতে হবে। সেখানেই গণমাধ্যমের গুরুত্ব ও তাৎপর্য।

আমি মনে করি, যারা নীতিবাচক কথা বলে তারা নীতিবাচক কাজও করে। তাদের এ সমাজ ভালোভাবে চেনে-জানে। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে একদল মানুষ ছিল, যারা এ দেশের স্বাধীনতা চায়নি। এ রকম নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ সবসময় সব দেশেই হয়তো আছে। ষড়যন্ত্র সব দেশেই আছে। মানবসভ্যতায় কোনো যন্ত্র আবিষ্কারের আগে ষড়যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। ষড়যন্ত্র বাংলাদেশে আছে, আগেও ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। তা মোকাবিলায় জনগণকে সচেতন হতে হবে। জনগণের সচেতনতার জন্যই আজ আমাদের গণমাধ্যম জগতে নতুন নতুন মাধ্যম প্রবেশ করছে। আজ কালবেলা সংবাদপত্র গণমাধ্যমের সীমানাকে আরও বিস্তৃত করল। এর মূল লক্ষ্য মূলত জনগণের এই সচেতনতা বৃদ্ধি করা।

লেখক : সাবেক ভিসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ইনসেট : সরকারের প্রচেষ্টা আছে বলেই, সরকার শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছে। সরকার তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা বাতিল করেছে। অর্থাৎ শিশুদের মধ্যে যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা, সেটা বাদ দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ পদ্ধতি হয়তো আরও উচ্চপর্যায়ের ক্লাস পর্যন্ত বিস্তার ঘটানো যেতে পারে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সিলেটে ট্রাক-অটোরিকশার সংঘর্ষে নিহত ২

ব্যারিস্টার খোকনের দলীয় পদ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বিএনপি 

বাড়ি ফেরা হলো না বাবা-ছেলের

বাংলাদেশের দাবদাহ নিয়ে যা বলছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম

অনুষ্ঠিত হলো বিইউএইচএস -এর প্রথম সমাবর্তন

ইউরোপ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে : ম্যাখোঁ

ছেলেদের দোষে ডুবছেন মাহাথির মোহাম্মদ

হিজাব আইন না মানায় ইরানে ব্যাপক ধরপাকড়

তীব্র তাপপ্রবাহে বৃষ্টি চেয়ে হাজারো মুসল্লির কান্না

মানব পাচারের দায়ে একজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

১০

ঝিনাইদহে স্ত্রী হত্যার দায়ে স্বামীর যাবজ্জীবন

১১

কারিগরির ফাঁকা সনদ মিলল তোষকের নিচে, গ্রেপ্তার কম্পিউটার অপারেটর

১২

ঝিনাইদহে বৃষ্টির জন্য ইসতিসকার নামাজ আদায়

১৩

ভোট দিলে যে শহরে মিলবে ফ্রি বিয়ার, ট্যাক্সিসহ নানা সুবিধা

১৪

কুমিল্লায় পানিতে ডুবে ৪ শিশুর মৃত্যু

১৫

খালেদা জিয়ার সঙ্গে ফখরুলের সাক্ষাৎ

১৬

চট্টগ্রামে জব্বারের বলী খেলায় চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লার বাঘা শরীফ

১৭

সুইজারল্যান্ডে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিশ্রুতি তুলে ধরলেন শিক্ষামন্ত্রী 

১৮

৭৩ বছরে ছাত্র ইউনিয়ন  

১৯

কৃষক খুনের ঘটনায় থামছে না ভাঙচুর ও লুটপাট

২০
*/ ?>
X