বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
চিররঞ্জন সরকার
প্রকাশ : ০৫ নভেম্বর ২০২২, ০৩:২১ এএম
অনলাইন সংস্করণ

এলিট শ্রেণি ও কর্তৃত্ববাদী সরকার

এলিট শ্রেণি ও কর্তৃত্ববাদী সরকার

আমাদের দেশে নির্বাচন হবে কিনা, হলে সেটা সুষ্ঠু হবে কিনা—এই নিয়ে সচেতন মহলে ব্যাপক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, আলাপ-আলোচনা চলছে। কারণ, গত দেড় দশকে দেশে নির্বাচনব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। নির্বাচন কমিশন তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে। আমাদের দেশে নব্বইয়ের গণআন্দোলনের পরে ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত চারটি নির্বাচন অন্তত অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। এই চারবারই নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের পরিবর্তনও ঘটেছিল।

নবম সংসদ নির্বাচন সেনাসমর্থিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। এই সরকার সংবিধান সম্মত পন্থায় গঠিত হয়নি। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি আসনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করে। এরপর আওয়ামী লীগ সরকারের সিদ্ধান্তে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রহিত করে ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীনে এবং সংসদ বহাল থাকা অবস্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান করা হয়। এ বিধান প্রবর্তনের পর দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

দশম সংসদ নির্বাচনে প্রত্যক্ষ ভোটের জন্য উন্মুক্ত ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৪ আসনের প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এ নির্বাচনটি দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট বর্জন করার কারণে এটি অনেকটা একতরফাভাবে অনুষ্ঠিত হয়। যে ১৫৬টি আসনে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ভোট গ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়, তাতে বেশিরভাগ আসনেই অত্যন্ত নগণ্যসংখ্যক ভোটারের উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করা যায়। একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি অংশ নিলেও, এ নির্বাচনও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। নানা অনিয়মে জর্জরিত এ নির্বাচনকে অনেকে প্রহসন হিসেবেও আখ্যায়িত করেন। মূলত এর পর থেকেই সাধারণ ভোটারের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে, ভোটের ফলাফল নির্ধারণে জনমত ও জনসমর্থনের চেয়ে ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের আকাঙ্ক্ষাই মুখ্য। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছার পুতুল মাত্র।

আমাদের দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে যখন এমন অনিশ্চয়তা চলছে, তখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিয়মিত সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সেসব নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দলগুলো সরকার গঠন করছে; কিন্তু সমস্যা দেখা দিচ্ছে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সেই সরকারগুলোর আচরণ ও চরিত্রে। পৃথিবীর অনেক দেশেই বর্তমানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত সরকারগুলো স্বৈরাচার ও কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠছে। কয়েক বছর ধরে পৃথিবীর নানা প্রান্তে কর্তৃত্ববাদী নেতাদের আবির্ভাব ঘটছে। এমন প্রশ্ন তাই জোরেশোরে উঠছে যে, গণতন্ত্র কি তবে বিপন্ন? গণতন্ত্রের সংজ্ঞাটি বহুমাত্রিক, যার অন্যতম মাত্রা হলো জাতি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে দেশের যে কোনো নাগরিকের কিছু বিশেষ অধিকারের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠা। নির্বাচিত সরকার সংবিধানের সম্মান বজায় রাখছে কিনা, তা দেখার দায়িত্ব দেশের বিচার বিভাগ ও সংবাদমাধ্যমের। তাই কোনো দেশে এই দুটি স্তম্ভ স্বাধীন আর শক্তিশালী না হলে সেই দেশকে গণতন্ত্র বলা যায় না।

পৃথিবীর সব দেশেই এই দুটি বিভাগ চালান অনির্বাচিত, কিন্তু বিশেষ ধরনের নেতৃত্ব গুণসম্পন্ন কিছু মানুষ; ইংরেজিতে যাদের ‘এলিট’ বলা হয়। বৃহত্তর অর্থে এলিট শ্রেণি হিসেবে রাজনীতির বাইরে থাকা ক্ষমতাবান জনগোষ্ঠীকে দেখা যেতে পারে। গণতন্ত্রকে বলা যেতে পারে এই এলিটদের সঙ্গে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা ভাগ করে নেওয়ার একটি প্রক্রিয়া।

দ্বিতীয়, বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর সময়ে উন্নত দেশগুলোতে এক ধরনের জনকল্যাণমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়। অধিকাংশ উন্নত দেশেই যথেষ্ট পরিমাণে বেকার ভাতা দেওয়া হতো। শিক্ষা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা আর পরিবহনে ভর্তুকি ছিল প্রচুর। সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষায় সরকারকে ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। মূলত বিশ্বায়নের হাত ধরে আশির দশক থেকে সরকারের চরিত্র বদলে যেতে থাকে। অনুন্নত দেশগুলোতে শ্রমের মূল্য অনেক কম থাকায় উন্নত দেশের শিল্পপতিরা তাদের কলকারখানা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সরিয়ে নিয়ে যেতে শুরু করলেন আরও বেশি লাভের আশায়। ফলে নিজের দেশের শ্রমিকরা কাজ হারাতে থাকেন। দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি হলেও শ্রমিক শ্রেণির অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়নি, বরং কর্মক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা বেড়েছে, কমেছে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা।

গণতন্ত্রে সাধারণ মানুষের স্বার্থ দেখার দায়িত্ব নির্বাচিত সরকারের; কিন্তু নির্বাচনে জয়ের জন্য সব রাজনৈতিক দলেরই প্রয়োজন অর্থানুকূল্যের। সেই সিন্দুকের চাবি শিল্পপতিদের হাতে। দরিদ্র দেশগুলোতে বিশ্বায়নের সর্বাধিক সুফল ভোগ করছেন এলিটরা। তাদের একটা বড় অংশ ব্যবসায়ী। বিশ্বায়নের ফলে তাদের বাজার ও উপার্জন বেড়েছে বিপুল হারে। এসব দেশের দ্বিতীয় শ্রেণির এলিটরা হলেন উন্নতমানের চাকরিজীবী। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি তাই এই দুই দল এলিটকেই রাজনৈতিকভাবে অনেক বেশি প্রভাবশালী করে তুলেছে।

উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কর্তৃত্ববাদী নেতাদের সমর্থনের মূল ভিত্তি তাই এই দুই শ্রেণির এলিটরা। কোনো উন্নয়নশীল দেশে গণতন্ত্রের ভিত্তি শক্ত না হলে কর্তৃত্ববাদী নেতা জনগণকে খুব একটা পাত্তা দেন না। কর্তৃত্ববাদী নেতারা চান ব্যবসায়ী, শিল্পপতি আর আমলাদের তুষ্ট করে ক্ষমতায় থাকতে। জনগণকে ছিটেফোঁটা কিছু দিয়ে প্রচার করেন অনেক বেশি। তারা ঝগড়া-ফ্যাসাদ-দাঙ্গা-যুদ্ধ বাধিয়ে সব সময় একটা উত্তেজনা তৈরি করে রাখেন। নানা ইস্যুতে মানুষকে ক্ষেপিয়ে, কোনো একটা দুর্বল প্রতিপক্ষকে টার্গেট করে, তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়ে একটা সংকটের বাতাবরণ তৈরি করেন। উন্নত বা উন্নয়নশীল, সব দেশেই কর্তৃত্ববাদী শাসকের ক্ষমতায় থাকার প্রধান অস্ত্র ঘৃণা। কখনো এই ঘৃণার লক্ষ্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, কখনো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, কখনো অনুন্নত দেশ থেকে আসা নাগরিকরা, কখনো বা অন্য কোনো দেশ। কর্তৃত্ববাদী নেতারা তাই প্রবল জাতীয়তাবাদী।

আসলে এই নেতারা চান গণতন্ত্রের মানবিক অধিকারের দিকটিকে যতখানি সম্ভব দুর্বল করতে। আমলাতন্ত্র ও ব্যবসায়ীদের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বশে রাখার চেষ্টা করেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের উত্থানকে রুখে দিতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করেন। সমালোচকদের উচিত শিক্ষা দিতে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করেন আইন ও পুলিশকে। ক্ষমতাকে ধরে রাখতে এসব নেতা অনেক ক্ষেত্রেই অত্যন্ত ভয়ংকর হয়ে ওঠেন।

তবে পৃথিবীর সব কর্তৃত্ববাদী নেতার ভূমিকা এক নয়। তাদের অনেকেই দেশের আর্থিক উন্নতি ঘটিয়েছেন। পুতিনের আমলে রাশিয়ানদের আয় বেড়েছে কয়েক গুণ। চীনেও অসংখ্য মানুষ দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠে এসেছেন একাধিক কর্তৃত্ববাদী নেতার রাজত্বে। একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশেও। সাধারণভাবে বিরোধীর প্রতি নির্দয় হলেও তাদের আসল লক্ষ্য সব ধরনের আন্তর্জাতিক সংস্থার সর্বোচ্চ স্তরে নিজেদের সমর্থকদের প্রতিষ্ঠিত করে উন্নত দেশের এলিটদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা। নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রে তাদের আপত্তি নেই। মুক্ত সংবাদমাধ্যমের বদলে তারা চান পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম, যা শাসকদের বিরোধিতা করবে না। তথাকথিত উন্নয়নের গুণকীর্তন করবে। এই কাজে এই নেতাদের মূল সহায় সেই দেশের শিল্পপতি ও তাদের সহায়ক এলিটরা। আজ গণতন্ত্রের সংকটের চাবিকাঠিটিও লুকিয়ে আছে দেশের সব নীতিনির্ধারণে জনসাধারণের বদলে এলিটদের বিপুল প্রভাবে।

বর্তমান পৃথিবীর রাজনীতি উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো এলিটদের ক্রমাগত নিজেদের পাল্লা ভারী করে চলার রাজনীতি। বিশ্বায়নের ফলে এই দুই ধরনের এলিট পরস্পরের সংস্পর্শে এসেছেন। এর অবধারিত ফল একের দ্বারা অন্যের মানসিকতা ও সংস্কৃতির পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের ছাপ পড়ছে তাদের নিজেদের দেশের শাসনব্যবস্থাতেও। গণতন্ত্রে এলিটদের অবিসংবাদী প্রভাবে পড়ছে স্পষ্ট কর্তৃত্ববাদের ছাপ, আর কর্তৃত্ববাদ অল্প হলেও গণতন্ত্রের কিছু ভালো দিককে নিজের করে নিয়ে সেই গণতন্ত্রেরই আদর্শগত বিকল্প হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে রাজনৈতিক স্বাধীনতাবিবর্জিত এক অর্থনৈতিক মোক্ষের লোভ দেখিয়ে। বর্তমান পৃথিবীতে গণতন্ত্র আর কর্তৃত্ববাদের সীমারেখাটি ক্রমশ সংকীর্ণ হতে হতে মিলিয়ে যাওয়ার পথে। কাজেই বর্তমানে শুধু সুষ্ঠু নির্বাচন নয়, কর্তৃত্ববাদী সরকারের হাত থেকে গণতন্ত্রকে কীভাবে রক্ষা করা যায়, সেটা নিয়েও ভাবতে হবে।

লেখক : কলামিস্ট ও উন্নয়নকর্মী

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

এবার চিপকেও ব্যর্থ মোস্তাফিজ

বিএসএমএমইউর উপ-উপাচার্যের দায়িত্ব নিলেন ডা. আতিকুর

চাঁদপুরে টাউন হল মার্কেটে আগুন

টি-২০ খেলতে সিলেটে ভারত নারী ক্রিকেট দল

সুদের ওপর কর অব্যাহতি পেল অফশোর ব্যাংকিং

এফডিসিতে সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণের ঘটনায় বাচসাস’র নিন্দা

চবিতে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ কর্মীকে মারধর

ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে প্রবাসীর স্ত্রী থেকে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ

সেতুমন্ত্রীর পদত্যাগ চাওয়ায় শাহবাগ থানায় জিডি

পদ্মা ব্যাংকের এমডির পদত্যাগ

১০

আদাবরে স্ত্রীর রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার, স্বামী পলাতক

১১

ভর্তি পরীক্ষায় জবিতে থাকবে ভ্রাম্যমাণ পানির ট্যাংক

১২

অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও ভাইরাল করার হুমকি, বিপাকে পুলিশ কনস্টেবল

১৩

গরমে বেড়েছে ডায়রিয়া, ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি ৮৩

১৪

একাধিক অন্তরঙ্গ ভিডিও ভাইরাল, কে এই তরুণী

১৫

‘পরকীয়ার জেরে’ হত্যা করা হয় মিতুকে : মা

১৬

গাজার সেই শহরে আবারও নারকীয় হামলার ঘোষণা

১৭

রাস্তায় পানি ছিটানোর সুপারিশ সংসদে 

১৮

যেসব জেলায় শিলাবৃষ্টির আশঙ্কা

১৯

‘জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রয়োজন ৫৩৪ বিলিয়ন ডলার’

২০
*/ ?>
X