মহসীন হাবিব
প্রকাশ : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০১:৪৮ এএম
অনলাইন সংস্করণ

সাপুড়ে পাকিস্তানের বুকে সাপের ছোবল!

সাপুড়ে পাকিস্তানের বুকে সাপের ছোবল!

দেশভেদে, দলভেদে মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যু কোনোক্রমেই আমাদের কাছে কাঙ্ক্ষিত নয়। বাঙালিদের বুক এত নিষ্ঠুর-নির্মম নয়। যখন আমরা সংবাদ থেকে জানতে পাই, পেশোয়ারের বোমা হামলায় নিহত পুলিশ পরিদর্শক ইরফান উল্লাহর স্ত্রী ও পাঁচটি ছোট ছোট সন্তান রয়েছে, তখন মানুষ হিসেবে আমাদের বুক কেঁপে ওঠে। নিশ্চয়ই যারা নামাজে দাঁড়িয়েছিলেন তাদের সবারই ইরফান উল্লাহর মতো পরিবার-পরিজন রয়েছে। শেষ সংবাদ পর্যন্ত জানা গেছে, নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ভেদ করে পাকিস্তানের পেশোয়ারের পুলিশ লাইন মসজিদে ৩০ জানুয়ারি যে হামলা হয়েছে, তাতে মৃতের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়েছে। পাকিস্তানে এক দশকের বেশি সময়ের মধ্যে এটি বড় বড় অনেক হামলার একটি।

কিন্তু নির্লিপ্ত মস্তিষ্কে, যুক্তির সঙ্গে চিন্তা করলে দেখা যাবে, এ হামলা পাকিস্তানের জন্য ‘পাওনা’ হয়ে উঠেছে। পাকিস্তানের সমস্যা হলো, তারা একটি বাঘ পুষেছে। তারপর সেই বাঘকে ক্ষুধার্ত রেখে নিজেই ওই খাঁচার মধ্যে বিশ্রাম নিতে গিয়েছে। ফলাফল হিসেবে পাকিস্তানকেই বাঘে খেয়ে ফেলবে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই! এ খেলায় যুক্তরাষ্ট্রও ছিল। কখনো পাকিস্তানকে সঙ্গে নিয়ে, কখনো পাকিস্তানকে সরিয়ে দিয়ে। কিন্তু তারা তো শারীরিকভাবে এখন খাঁচা থেকে সরে গেছে। দ্বিতীয়ত তারা তো উড়ে এসেছিল, আবার উড়ে চলে গেছে! ফলে পাকিস্তানকেই খেসারত দিতে হচ্ছে এবং হবে।

এ হামলার দায় প্রথমে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান বা টিটিপি স্বীকার করে নিয়েছিল। বলেছিল, তাদের একজন আফগান তালেবান যোদ্ধার নিহত হওয়ার প্রতিশোধ হিসেবে এ হামলা। কিন্তু পরে তারা মুসলিম বিশ্বের সেন্টিমেন্টের কথা বিবেচনা করে হামলার দায় অস্বীকার করে জানিয়েছে, মসজিদে হামলা চালানো তাদের নীতি নয়। এটি ছোট একটি ফ্যাকশনের কাজ। মাত্র দুই সপ্তাহ আগে পেশোয়ারের একটি পুলিশ স্টেশনের বাইরেও আধুনিক ভারী অস্ত্রে সজ্জিত তালেবান হামলা চালায়। তারা স্নাইপার রাইফেল ব্যবহার করে এবং গ্রেনেড হামলা চালায়। ওই হামলায় তিনজন পুলিশ অফিসার মৃত্যুবরণ করেন। পাকিস্তানে তালেবানদের হামলা এখন নিয়মিত হয়ে গেছে বিশেষ করে পুলিশ, সেনাবাহিনীকে টার্গেট করে।

ঘোষিতভাবে তেহরিক-ই-তালেবান এবং আফগান তালেবানরা আলাদা হলেও প্রকৃত অর্থে তারা তাদের আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে এক। শুধু সীমান্তের এপার আর ওপার। তবে পাকিস্তানের বিশেষ করে সীমান্তবর্তী খাইবার পাখতুনখার অবস্থা এতটাই ঘোলাটে যে, প্রকৃত অর্থে প্রদেশটি তালেবানদের হাতে চলে গিয়েছে। পাকিস্তানের প্রশাসনিক কাজও সেখানে সম্ভব হচ্ছে না।

পাকিস্তানের এ জটিল ও সহিংস পরিস্থিতি নিয়ে লিখতে গেলে ভলিউম হয়ে যাবে। সংক্ষেপে বলি। এ তালেবানরা আফগানিস্তানে সোভিয়েত মদতপুষ্ট নজিবুল্লাহ সরকারকে হটানোর সময় যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের যৌথ সহায়তা পেয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার-আধুনিক অস্ত্র আসে পাকিস্তানি মিলিটারি-গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এবং তালেবান গেরিলাদের জন্য। সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগানিস্তানে পতনের পর যুক্তরাষ্ট্র তার তৎপরতা শিথিল করলেও পাকিস্তান থামেনি। বেশ কিছু কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের মধ্যেও সম্পর্ক শিথিল হতে থাকে। যেমন তার একটি হলো,

গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারকে ওপিয়াম-হেরোইন ব্যবসায় পাকিস্তানের মদত দেওয়া। হেকমতিয়ার মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ তথা আন্তর্জাতিক বাজারে ওপিয়াম, এমনকি কারখানা বসিয়ে হেরোইন পাচার শুরু করলে যুক্তরাষ্ট্র তার বিরোধিতা করে। কিন্তু পাকিস্তান হেকমতিয়ারের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কাজ করে। যদিও হেকমতিয়ারের সঙ্গে তালেবানদের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ছিল। সেই ইতিহাস অনেক দীর্ঘ।

তালেবানরাও পাকিস্তানের পোষা ছিল। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক রিপোর্টে বলা হয়, ২০০১ সালের এপ্রিল ও মে মাসের প্রায় প্রতিদিন পাকিস্তান থেকে প্রায় ৩০টি করে ট্রাকে আর্টিলারি শেল, রকেট প্রপেলার, গ্রেনেড সাপ্লাই দেওয়া হয়। ৯/১১-এর পর যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান আক্রমণ করে। তখনো কিন্তু পাকিস্তান ছিল তালেবান/আল-কায়েদার সমর্থক। তখনই মূলত যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের খাতিরে ফাটল ধরে।

কিন্তু দীর্ঘকাল পর পাকিস্তানের সঙ্গে তালেবানদের অশুভ যোগসূত্রে ফাটল ধরেছিল প্রধানত ২০১৪ সালে, বিশেষ করে পেশোয়ারে স্কুলে হামলার পর। তালেবানদের ওই হামলায় ১৩২ জন স্কুলশিশু নিহত হয়। রাজনৈতিক ও গণমানুষের চাপে ২০১৪ ও ’১৭ সালে পাকিস্তান সরকার তালেবানদের বিরুদ্ধে অপারেশন চালায়। সেই থেকে সমস্যাটি তীব্র আকার ধারণ করতে থাকে।

এদিকে ২০ বছর আফগানিস্তানকে নিয়ন্ত্রণে রেখে অবশেষে ২০২১ সালেরে আগস্ট মাসে পেছনের দরজা দিয়ে অনির্বাচিত আফগান তালেবানদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র দেশটি থেকে সরে যায়। এ সময় যেসব তালেবান বিভিন্ন অপরাধে কারাগারে ছিল তাদের ছেড়ে দেয় তারা। তখন থেকেই তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান তাদের পাকিস্তানে আটক যোদ্ধাদের ছেড়ে দেওয়ার জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রতি চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। ইমরান খান সরকার তেহরিক-ই-তালেবানের পাঁচ হাজার সদস্যকে আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তানে নিয়ে এসে পুনর্বাসনের চেষ্টা করেন। কিন্তু নানা দুর্বলতার কারণে তা ব্যর্থ হয়েছে। তালেবানদের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক শীতল হওয়ার আরও একটি কারণ হলো ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া ডুরান্ড লাইন। এ সীমান্ত লাইন তালেবানরা কোনোক্রমেই মানছে না। এরই মধ্যে আফগান তালেবান সরকারের বাহিনীর সঙ্গে সীমান্তে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়েছে। এমনকি কোনো কোনো জায়গা থেকে পরমাণু অস্ত্রধারী পাকিস্তান বাহিনীকে পিছু হটতে হয়েছে। হতাহতও হয়েছে পাকিস্তানের পক্ষে বেশি। আফগান তালেবানদের সঙ্গে সম্পর্ক যত অবনতি হচ্ছে, পাকিস্তানের তালেবানরাও ততই শক্তিশালী হয়ে হানা দিচ্ছে। উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক গবেষক মাইকেল কুগেলম্যানের একটি কথা সত্য।

তিনি বলেছেন, পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর তালেবানদের হামলা বৃদ্ধি একটি কথাই প্রমাণ করে—পাকিস্তান দেশটি তাদের ঠেকাতে ব্যর্থ।

পাকিস্তানের আরও দুটি ভয়াবহ বিষয় যুক্ত আছে তালেবানদের এ হামলার পেছনে। তা হলো—রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক। পাকিস্তানে ইমরান খান সরকারের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর শাহবাজ শরিফ ক্ষমতায় আসেন। এ দুই রাজনৈতিক ব্যক্তি বা দলের মধ্যে তালেবানরা মন্দের ভালো মনে করে ইমরান খানকে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী নেওয়াজ শরিফের ভাই এবং পাঞ্জাবের সাবেক চিফ মিনিস্টার শাহবাজ শরিফ ক্ষমতায় এসে তালেবানদের বিরুদ্ধে চিরুনি অভিযানের পরিকল্পনা করেন, যা তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানকে (টিটিপি) আরও ক্ষিপ্ত করে তোলে। পাকিস্তানের সঙ্গে তেহরিকের শান্তিচুক্তি ভেঙে যায়। এদিকে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা দেশটির স্বাধীনতার পর থেকে সবচেয়ে বিপর্যস্ত অবস্থায় পড়েছে। চরম মুদ্রাস্ফীতি, ডলারের সংকট, ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা গোটা পাকিস্তানের জনগণকেই হতাশা ও বিপদের মধ্যে ফেলেছে।

এরকম পরিস্থিতিতে খাইবার পাখতুনখার দক্ষিণ ও উত্তর ওয়াজিরিস্তান এখন প্রায় পুরোটাই পাকিস্তান প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। উন্মুক্তভাবে তালেবানরা প্রকাশ্যে বিচার, সালিশ, চাঁদা তোলার কাজ করছে। জনগণের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নে এক্সপার্ট পাকিস্তান বাহিনী এখন সত্যিই এক ভয়ানক পরিস্থিতির শিকার। দীর্ঘদিন ধরে বালুচিস্তান প্রদেশে পাকিস্তান বাহিনীর গুম, খুন, নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে। দীর্ঘকাল ধরে বালুচিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদের হত্যা, ছাত্রদের তুলে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করে লাশ ফেলে দেওয়ার ঘটনায় বালুচদের চরমভাবাপন্ন করে তুলেছে। এ বালুচিস্তানকে এখন বালুচরা বলে সেকেন্ড বাংলাদেশ।

অর্থাৎ তারা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বালুচিস্তানের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখছে। এমন অবস্থায় অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, পাকিস্তান ভেঙে টুকরো হয়ে যাওয়াটা সময়ের ব্যাপার। কিছুদিন আগে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘এখনই যদি সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা না হয় তাহলে পাকিস্তান ভেঙে তিন টুকরো হয়ে যাবে।’ কিন্তু প্রশ্ন হলো, সঠিক সিদ্ধান্ত কী এবং নেবে কে? মিলিটারি, না রাজনীতিবিদরা? ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত পাকিস্তানের কোনো সরকার, পাকিস্তানের কোনো সেনাশাসক কোনো ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি, শুধু গায়ের জোর খাটানো ছাড়া। যার ফলে ২২ কোটি মানুষের পরমাণু অস্ত্র, একটি ধনাঢ্য সেনাবাহিনী অফিসার্স গোষ্ঠী এবং মুষ্টিমেয় ধনিকগোষ্ঠী ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট নেই। মানুষের পেটে ভাত নেই, জীবনের নিরাপত্তা নেই, আইনের শাসন নেই। এ অবস্থায় পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ কী, তা সত্যিই বলা মুশকিল।

লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বিএনপির আরেক নেতা বহিষ্কার

ওমরাহ নিয়ে বড় সুখবর দিল সৌদি সরকার

বঙ্গোপসাগরে জাহাজ ডুবিতে ১১ নাবিক উদ্ধার, নিখোঁজ ১

বাংলাদেশকে অন্য দেশের চোখ দিয়ে দেখে না যুক্তরাষ্ট্র : মার্কিন কর্মকর্তা

তপ্ত রোদে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের নামাজ আদায়

গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা / জবি ক্যাম্পাসে গাড়ি প্রবেশ নিষেধ 

বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় দিয়ে কিডনি কেটে বিক্রি করেন মিল্টন সমাদ্দার?

গণঅধিকার পরিষদের খাবার পানি ও ফল বিতরণ

সিনিয়র এক্সিকিউটিভ পদে মেঘনা গ্রুপে চাকরি, কর্মস্থল ঢাকা

ফের মাউশির ডিজি হলেন অধ্যাপক নেহাল

১০

আজও দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়

১১

স্বাস্থ্য শিক্ষার এডিজি হলেন স্বাচিপ মহাসচিব

১২

উপনির্বাচনকে সামনে রেখে ফের উত্তপ্ত শৈলকুপা

১৩

হিটস্ট্রোকে শিক্ষার্থীর মৃত্যু

১৪

চাঁদা না পেয়ে ছাত্রলীগ নেতাকে বেধড়ক পিটুনি

১৫

সাংবাদিকসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি মামলা

১৬

স্ত্রীর দাবি, সালমান শাহ-শাকিবের মতোই এবার টার্গেট জয়

১৭

প্রীতি উরাংয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যু, গুরুতর অপরাধে লঘু মামলা হয়েছে

১৮

বাংলাদেশের উন্নতি দেখে আমাদের লজ্জা হয় : পাক প্রধানমন্ত্রী

১৯

শাহজাদপুরে বৃষ্টি কামনায় ইসতেসকার নামাজ আদায়

২০
*/ ?>
X