জাকির হোসেন
প্রকাশ : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৩:৪৫ এএম
অনলাইন সংস্করণ

ভ্যালেনটাইনে ম্রিয়মাণ প্রতিরোধ দিবস

ভ্যালেনটাইনে ম্রিয়মাণ প্রতিরোধ দিবস

আজ পহেলা ফাল্গুন, ফুল ফোটার দিন, পাখি ডাকার দিন। ফাগুনের উদাসী বাতাসে মনের মানুষের আরও কাছে আসার দিন, কোকিলের মিষ্টি কলতানে ভালোবাসায় মেতে ওঠার দিন। এসবের আড়ালে রয়েছে বারুদের গন্ধমাখা স্মৃতিবিজড়িত একটি অগ্নিঝরা দিন। ফাগুনের আগুন ঝরা এই দিনটির সঙ্গে মিশে আছে ১৯৮৩ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শহীদ জাফর জয়নাল, দিপালী সাহার লাল টকটকে রক্ত- আত্মত্যাগের এক সংগ্রামী ইতিহাস। এদিন স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে সূচিত হয়েছিল প্রথম বড় ধরনের আন্দোলন, যা মধ্য ফেব্রুয়ারির আন্দোলন হিসেবে পরিচিত।

জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিক্ষোভ মিছিল বের করে। এরপর ওই বছর শিক্ষা দিবসকে (১৭ সেপ্টেম্বর) সামনে রেখে মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিল এবং সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ১৬ সেপ্টেম্বর মৌন মিছিল করে ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রী এবং ছাত্র ঐক্য ফোরামসহ কয়েকটি সংগঠন। ১৯৮২ সালে ‘৭ নভেম্বর’ উপলক্ষে ৮ নভেম্বর বিক্ষোভ মিছিল করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। পুলিশ ওই মিছিলের ওপর বেপরোয়া হামলা চালায় এবং লাঠিচার্জ করে। ফলে পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের তীব্র সংঘর্ষ বাধে এবং এ সংঘর্ষ কয়েক ঘণ্টা চলে। পুলিশ একপর্যায়ে কলা ভবনের ভেতরে ঢুকে ছাত্র এবং শিক্ষকদের ওপর বেপরোয়া হামলা চালায়। এতে অনেক ছাত্রছাত্রী এবং কয়েকজন শিক্ষক আহত হন। এর পরিপ্রেক্ষিতে এদিন (৮ নভেম্বর) ছাত্র সংগঠনের মধ্যে ঐক্য আরও দৃঢ় হয় এবং ১৪টি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হওয়ার পর ১৩ ডিসেম্বর এ সংগঠন বিক্ষোভ সমাবেশ কর্মসূচির ডাক দেয়।

এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি এরশাদের উপদেষ্টা মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিল এবং সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি দেওয়া হয়। এ কর্মসূচি সফল করতে ছাত্রদের একটি বিশাল বিক্ষোভ মিছিল বেলা ১১টার দিকে শিক্ষা ভবনের সামনে পৌঁছলে পুলিশ বাধা দেয়। ফলে ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হয়। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে পুলিশ গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে নিহত হন জয়নাল, জাফর, কাঞ্চন এবং দিপালী সাহাসহ কয়েকজন। নিহতদের কয়েকজনের লাশ গুম করে সরকার। বিকালে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা এবং বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ও ঢাকা শহরে কারফিউ জারি করা হয়। একই সঙ্গে ওই সময় পুলিশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্রাবাসে ঢুকে ছাত্রছাত্রীদের ওপর বেপরোয়া হামলা চালায় এবং ব্যাপক সংখ্যক ছাত্র গ্রেপ্তার করে। ছাত্রহত্যা এবং পুলিশি হামলার প্রতিবাদে পরদিন এ আন্দোলন জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। ফলে পর দিন সরকার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করে।

১৯৮৪ সাল থেকে বাংলাদেশের প্রগতিশীল ছাত্রসমাজ ১৪ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত পরিসরে নানা কর্মসূচির মাধ্যমে পালিত হয় স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস। এরপর পশ্চিম থেকে আগত ভ্যালেন্টাইন ডে’র জোয়ারে ভেসে যেতে শুরু করে রক্তের অক্ষরে লেখা গৌরবময় সংগ্রামের এই ঐতিহাসিক দিন। নব্বইপরবর্তী মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রবল জোয়ারে দিনটি পরিণত হয়েছে বহুজাতিক কোম্পানির পণ্য বিক্রির দিন হিসেবে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যারা আত্মাহুতি দিয়েছেন, তাদেরকে এখন আমরা প্রায় ভুলতে বসেছি।

সামরিক স্বৈরাচার এরশাদের শাসনামলে সংবাদপত্রের ওপর এতই নিষেধাজ্ঞা ছিল যে, ১৪ ফেব্রুয়ারির বিক্ষোভ এবং ছাত্রহত্যার ঘটনা ওই সময়ের কোনো পত্রিকা সরকারের প্রেসনোটের বাইরে অন্য কোনো খবর প্রকাশ করতে পারেনি। ১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাক ‘গতকালের ঘটনা সম্পর্কে সরকারি প্রেসনোট’ এবং দৈনিক সংবাদ ‘রাজধানীতে কারফিউ ॥ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা’ শিরোনামে প্রধান খবর হিসেবে প্রকাশ করে। ইত্তেফাকে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়, ‘গতকাল (সোমবার) সন্ধ্যায় বাংলাদেশ সরকার এক প্রেসনোটে ঢাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা ভঙ্গের লক্ষ্যে পরিচালিত ক্রমবর্ধমান ও পরিকল্পিত ছাত্র গোলযোগ বন্ধের উদ্দেশ্যে কতিপয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা ঘোষণা করিয়াছেন। প্রেসনোটে বলা হয়, এই ছাত্র গোলযোগ শান্তিপ্রিয় জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করিতেছিল।...

(দৈনিক ইত্তেফাক, ১৫ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার ১৯৮৩)।

এরশাদের ক্ষমতা দখল

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জেনারেল এরশাদ এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। রাজনৈতিক দলগুলো এরশাদের এভাবে ক্ষমতা দখলকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা না করে অনেকটাই নীরবে মিলিটারি স্বৈরশাসন মেনে নিতে বাধ্য হয়। রাজনৈতিক দলগুলো মেনে নিলেও ছাত্ররা মেনে নেয়নি এই সামরিক অভ্যুত্থান। সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্বৈরাচার এরশাদ ক্ষমতায় ছিল ৮ বছর ২৫৬ দিন। এ সময় দেশের হাজার হাজার মানুষ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে কারাবরণ করেছে। হত্যা-গুমের শিকার হয়েছে অসংখ্য নারী-পুরুষ। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বিশেষত ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি মিছিলে পুলিশের গুলিতে ছাত্র নিহত হওয়ার পর থেকেই দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে ওঠে।

রক্তাক্ত ১৪ ফেব্রুয়ারির প্রেক্ষাপট

এরশাদের সামরিক শাসন জারির প্রথম দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রতিবাদ জানিয়ে বিক্ষোভ করে। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে পোস্টার লাগাতে গিয়ে বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর তিন সদস্য গ্রেপ্তার হন। এই ছাত্রনেতারা হলেন শিবলী, কাইয়ুম, হাবিবুর রহমান ও আব্দুল আলী। পরে সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতে তাদের সাত বছরের কারাদণ্ড হয়। সেই থেকে শুরু হয় সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্রদের আপসহীন লড়াইয়ের দিনগুলো। বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতারা ২৬ মার্চের স্বাধীনতা দিবসে সাভারের স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতে গিয়ে শহীদ বেদিতেই সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়। মিছিলের খবর শুনে সাভার সেনানিবাস থেকে সেনাবাহিনী এসে স্মৃতিসৌধে ছাত্রদের ওপর নির্মম নির্যাতন করে।

এরশাদের উত্থান ও স্বেচ্ছাচারিতা

জেনারেল এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ একটি রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। ক্ষমতা দখল করে একটি সামরিক ফরমান (এমএলআর-৮২) জারি করেন এরশাদ। এতে আকারে-ইঙ্গিতে কেউ তার সামরিক শাসনের সমালোচনা-বিরোধিতা করলে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়। এরশাদের ক্ষমতা দখলের প্রতিবাদ শুরু হলে এই এমএলআর-৮২-এর অধীনে রাজনৈতিক নেতাসহ হাজার হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়। সামরিক স্বৈরাচারী এরশাদ দীর্ঘ ৯ বছরের শাসনামলে আন্দোলন-সংগ্রাম ঠেকাতে বহু জাতীয় রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেপ্তার করেন। অন্তরীণ করেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, ওয়ার্কার্স পার্টি, গণফোরামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সিনিয়র নেতাদের কারারুদ্ধ করেন এরশাদ।

আওয়ামী লীগ নেতা প্রয়াত আবদুস সামাদ আজাদ, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, বেগম মতিয়া চৌধুরী, সাহারা খাতুন, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন প্রমুখও রেহাই পাননি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নতুন শিক্ষাক্রমে ক্লাসে ৫৫ জনের বেশি শিক্ষার্থী নয় : শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী

রেলের ভাড়া বৃদ্ধিতে প্রতিবাদ

একটি বইয়ের আলেখ্য

যে কারণে আল্লাহতায়ালা বৃষ্টি বন্ধ করে দেন

বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিতে বাস সহায়তা দেবে ববি কর্তৃপক্ষ

অনিয়ম ঢাকতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে বাধা

কমিউনিটি ব্যাংকে ক্যাড়িয়ার গড়ার সুযোগ, কর্মস্থল ঢাকা

দেশকে এগিয়ে নিতে কৃষির আধুনিকায়ন ছাড়া বিকল্প নেই : তাজুল ইসলাম

এবার মক্কা ও মদিনায় ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস

বরিশালে বৃষ্টির জন্য ইসতিসকার নামাজ আদায়

১০

জয় চৌধুরী সভ্য অভিনয়শিল্পী : শিরিন শিলা

১১

রায়ের আগে এমন গল্পে, সেন্সরের আপত্তি : খসরু

১২

ফুলবাড়ীতে হিটস্ট্রোকে এক নারীর মৃত্যু

১৩

ইরানের হাতে শক্তিশালী এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম

১৪

তীব্র তাপদাহে বৃষ্টির জন্য নামাজ ও প্রার্থনা

১৫

বিএনপি নেতা গয়েশ্বরের জামিন

১৬

শনিবারও খোলা থাকবে স্কুল, আসছে নতুন সিদ্ধান্ত

১৭

প্রতিদিন ৫০টি চড়-থাপ্পড়েই বাড়বে নারীদের সৌন্দর্য!

১৮

মোস্তাফিজের নতুন নামকরণ চেন্নাইয়ের

১৯

চাঁপাইনবাবগঞ্জে হিটস্ট্রোকে ট্রাফিক পরিদর্শকের মৃত্যু

২০
*/ ?>
X