বিরোধী দলের সমালোচনার মুখে বিনা পরোয়ানায় তল্লাশী ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা রেখেই বহুল আলোচিত 'সাইবার নিরাপত্তা বিল-২০২৩' পাস হয়েছে। তবে এতে মিথ্যা মামলা দায়ের করলে সেটাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে সাজার বিধানও রাখা হয়েছে।
আজ বুধবার (১৩ সেপ্টেম্বর) সংসদের বৈঠকে বিলটি পাসের জন্য উত্থাপণ করেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। বিলের ওপর আনা বিরোধী সদস্যদের জনমত যাচাই, বাছাই কমিটিতে প্র্রেরণ এবং সংশোধনী প্রস্তাবগুলো নিস্পত্তি শেষে বিলটি কণ্ঠভোটে পাস হয়।
বিলের বিভিন্ন ধারার সমালোচনা করে বিরোধী দলীয় সদস্যরা বলেন, চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং স্বাধীন গণমাধ্যমের স্বীকৃতি সংবিধানেই দেওয়া হয়েছে। অথচ এই বিলের বিভিন্ন ধারায় সংবিধান স্বীকৃত এসব অধিকার খর্ব করার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হয়েছে। একাধিক সদস্য বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার ও তল্লাশীর বিধান সংশোধনেরও দাবি জানান।
এসব সমালোচনার জবাবে প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংবিধান স্বীকৃত হলেও অবারিত নয়। স্বাধীনতা মানে কিন্তু অন্যের অধিকার ক্ষুন্ন করা নয়। আপনার স্বাধীনতা মানে যা ইচ্ছে তা বলা নয়। অন্যকে অসম্মান করা নয়। নারীকে অশ্লীল কথা বলা নয়। এসব বিষয় নিশ্চিতকরণের কোন বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, আইনটির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিরোধী সদস্যরা একমত পোষণ করছেন। স্বচ্ছতা, জবাবহিদিতা ও নিরাপদ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সাইবার নিরপত্তা আইনের বিকল্প নেই।
দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে সরকার সাইবার নিরাপত্তা আইনের উদ্যোগ নেয়। গত ৫ সেপ্টেম্বর বিলটি সংসদে উঠার পর পরীক্ষা-নীরিক্ষার জন্য সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়। আইনটির খসড়া প্রকাশের পর থেকেই মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন বলে আসছে, সাইবার নিরাপত্তা আইনও কার্যত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মূল বিষয়বস্তু বহাল রাখা হচ্ছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের মতো্ই এই আইনের অপব্যবহারের আশঙ্কা ব্যক্ত করে তারা বলছেন, প্রস্তাবিত আইনে কিছু ক্ষেত্রে সাজা কমানো ও জামিনযোগ্য ধারা বাড়ানো হলেও অপরাধের সংজ্ঞা সুনির্দিষ্ট করা হয়নি। ফলে মানুষকে হয়রানি করার সুযোগ থেকেই যাবে।
মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাদের পর্যালোচনায় বলেছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারা ২৫ (মিথ্যা বা আপত্তিকর তথ্য প্রকাশ), ধারা ২৯ (মানহানিকর তথ্য প্রকাশ) এবং ধারা ৩১ (আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর শাস্তি) সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়ায় অবিকৃত রয়েছে। ২৫ ধারায় ‘রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ও সুনাম ক্ষুণ্ন’-সংক্রান্ত কোনো ব্যাখ্যা না থাকায় এর অপব্যবহারের শঙ্কা রয়েছে।
পাস হওয়া বিলে মিথ্যা মামলা ও অভিযোগ দায়েরের অপরাধ ও দণ্ড নিয়ে নতুন একটি ধারা যুক্ত করা হয়েছে। বিলে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তির লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনাল মিথ্যা মামলা ও অভিযোগ দায়েরের অপরাধে অভিযোগ গ্রহণ ও মামলার বিচার করতে পারবে।
বিলের ৪২ ধারায় বিনা পরোয়ানায় তল্লাশী ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে পুলিশকে। এই ধারায় সাব ইন্সপেক্টর পর্যায়ের কর্মকর্তার পরিবর্তন এনে পুলিশ পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) পর্যায়ের কর্মকর্তাকে বিনা পরোয়ানায় তল্লাশী ও গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই ধারাটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও ছিল।
বিলের ৮ ধারায় ডিজিটাল মাধ্যম থেকে তথ্য–উপাত্ত অপসারণ ও ব্লক করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। বিলের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে গণফোরামের সদস্য মোকাব্বির খান বলেন, বিতর্কিত জিডিটাল নিরাপত্তা আইনের বিভিন্ন ধারা এই আইনে যুক্ত করা হয়েছে। এটা অনেকটা নতুন বোতলে পুরনো মদ রাখার মতোই অবস্থা। আইনটি নতুন করে হচ্ছে কিন্তু স্বস্তি ফিরে আসছে না। যেভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ছিল অনেকটা হুবহু সেভাবেই এই আইন করা হচ্ছে। জাতিসংঘ, সম্পাদক পরিষদসহ সাংবাদিকদের যেসব আপত্তি ছিল উদ্বেগের বিষয় ছিল সেগুলো রয়ে গেছে।
তিনি বলেন, ৯টি ধারা স্বাধীন সাংবাদিকতা মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলে সংশোধনের দাবি জানিয়েছিল সম্পাদক পরিষদ। এখন প্রস্তাবিত সাইবার আইনে ৭টি ধারায় সাজা ও জামিনের বিষয়ে সংশোধনী আনা হয়েছে। কিন্তু অপরাধের সংজ্ঞা স্পষ্ট করা হয়নি। আগের মতই রয়ে গেছে। তার দুটি ধারায় কোন পরিবর্তনই আনা হয়নি। জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর থেকে দুটি ধারা বাতিলের আহ্বান করেছিল। কিন্তু প্রস্তাবিত আইনে তা বাতিল না করে সাজা ও জামিনের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা হয়েছে।
জাতীয় পার্টির সদস্য ফখরুল ইমাম বলেন, আইনটিতে কিছু রদবদল করা হয়েছে। কিন্তু সাংবাদিকেরা বলেছেন তাঁরা সন্তুষ্ট নন। সংবিধানে বাক স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। সংবিধান হল মূল আইন। বাক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কোনো আইন তৈরি হলে তা হবে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
জাতীয় পার্টির সদস্য পীর ফজলুর রহমান বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সবার কাছে বিতর্কিত ছিল। কিছুটা পরিবর্তন করে সাইবার নিরাপত্তা আইন করা হচ্ছে। এটিও স্বাধীন সাংবদিকতা ও মত প্রকাশের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। ৪২ ধারায় বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই আইনে সাংবাদিকদের বিষয়ে আলাদা সুরক্ষা রাখা প্রয়োজন ছিল। প্রেস কাউন্সিলের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের সুযোগ ছিল। মত প্রকাশ সাংবিধানিক অধিকার। এই আইনে মত প্রকাশ ও চিন্তার স্বাধীনতা বাধার সৃষ্টি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ২৭ শতাংশ মামলা হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। বেশিরভাগক্ষত্রে বাদী ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা।
জাতীয় পার্টির সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, কিছু কারিগরি বিষয়ে এই আইনের দরকার। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার হয়েছে খুব সামান্য। মূল মামলা হয়েছে চেতনা, অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে। তিনি বলেন, সংবিধানে চিন্তা, সংবাদক্ষেত্র ও বাকস্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। এগুলো থাকা অবস্থা
মন্তব্য করুন