দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। তাদের অভিমত, সংখ্যালঘু নয়- সবাইকে মানুষ হিসেবে দেখতে হবে। সবাই মিলে এক পরিবার হতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় থিতু হতে হবে বাংলাদেশকে।
শনিবার (১৪ ডিসেম্বর) দুপুরে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এক আলোচনা অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন তারা। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে সংখ্যালঘু ঐক্যমোর্চার উদ্যোগে ‘ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার : আমাদের করণীয়’- শীর্ষক এ আলোচনা অনুষ্ঠান হয়।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের অন্যতম সভাপতি অধ্যাপক নিমচন্দ্র ভৌমিক বলেন, রাষ্ট্র ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে হবে। যেখানে রাষ্ট্র ব্যবস্থা বৈষম্যের হয়, সেখানে বৈষম্য ভয়াবহ রূপ নেয়। আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং সকল গণআন্দোলনের চেতনাকে ধারণ করে এগিয়ে যাব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে যখন আমরা যাত্রা শুরু করি, তখন আমাদের স্বপ্ন ছিল- বাংলাদেশ একটি মানবিক রাষ্ট্র হবে। কিন্তু আজ অবধি তা অধরাই রয়ে গেছে। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম সাংঘর্ষিক।
তিনি আরও বলেন, ধর্মীয় বা জাতিগত সংখ্যালঘু শব্দটি অগণতান্ত্রিক মনে হয়। সবাই রাষ্ট্রের নাগরিক-এভাবে বিবেচনা করা উচিত। তাই সংবিধান থেকে এই শব্দটি বাদ দিতে হবে। সংখ্যালঘু নয়, সবাইকে মানুষ হিসেবে দেখতে হবে।
এই ইতিহাসবিদ বলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় থিতু হতে হবে। মুক্তিযুদ্ধকে নস্যাৎ করে আমরা কখনো টিকে থাকতে পারব না।
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, বর্তমানে বিভিন্ন নিয়োগে পদে পদে বৈষম্য চলছে। এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নিয়োগ হলো। ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল, জিপি, পিপি, এপিপি নিয়োগ দেওয়া হলো। বিচারক নিয়োগ হলো। সেখানে হাতেগোনো দু-একজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোক রয়েছে।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি বাসুদেব ধর বলেন, বৈষম্যবিরোধী রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। এমন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হলে সংখ্যালঘুরা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে। ৫৩ বছর ধরে আমরা নানাভাবে বৈষম্যের শিকার। সবাই মিলে এক পরিবার হওয়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, আমাদের একটি ইউনিভার্সাল আইডেনটিটি প্রয়োজন, যা ধর্মের ভিত্তিতে হবে না।
তিনি বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পর সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র চেয়েছিল বলেই বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা অন্যতম মূলনীতি হিসেবে এসেছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরীন বলেন, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের লক্ষ্য ছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে ন্যায্যতা ও বলার স্বাধীনতা। আজকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা কেন ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ করতে বাধ্য হলো- তা বিবেচনায় নিয়ে সরকার, রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজকে তাদের কৌশল নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার দোহাই দিয়ে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে হামলা জায়েজ করা যাবে না। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতাদের নামে মামলা দেওয়ার পেছনে কাজ করছে তাদেরকে ভয়ের ভেতরে রাখা। ড. নাসরীন সংখ্যালঘু জনগণকে তাদের অধিকারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ করার আহ্বান জানান।
দৈনিক সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান বলেন, যখনই কোনো সরকার পরিবর্তন হয়েছে, তখনই সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন নেমে আসে।
তিনি আরও বলেন, যেদিন বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার কবর হবে, সেদিনই সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু শব্দগুলো থাকবে না। আজকে অসাম্প্রদায়িক আন্দোলনকে সর্বজনীন আন্দোলনে নিয়ে যেতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব হবে দোষীদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা।
মানবাধিকারকর্মী শামসুল হুদা বলেন, সংখ্যালঘুদের হামলার পেছনে বৈষ্যয়িক স্বার্থ জড়িত রয়েছে। সংখ্যালঘুরা সুরক্ষিত না হলে সে রাষ্ট্র সভ্য রাষ্ট্র হতে পারে না।
রমনা ক্যাথলিক চার্চের পাল পুরোহিত ফাদার অ্যালবার্ট টি রোজারিও বলেন, সংখ্যালঘুরা ট্রাম্পকার্ড হিসেবে সব সরকারের আমলেই ব্যবহৃত হয়েছে, এখনও হচ্ছে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের নিরাপত্তার বিষয়টি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, বিএনপি মহাসচিব এবং জামায়াত আমিরকে অবহিত করা হয়েছে বলে জানান মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সভাপতি জয়ন্ত কুমার দেব।
সভাপতির বক্তব্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার আদায়ে সচেতনতার ওপর গুরুত্ব দেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের অন্যতম সভাপতি নির্মল রোজারিও। তিনি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নেতাদের ‘হয়রানিমূলক’ মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানান। একইসঙ্গে চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে তার নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেন।
অনুষ্ঠানে ঐক্যমোর্চার পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপনা করেন ঐক্য পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মনীন্দ্র কুমার নাথ। ঐক্য পরিষদের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য রঞ্জন কর্মকারের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে কারিতাস ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের পরিচালক থিউফিল নকরেক, বুদ্ধিস্ট ফেডারেশনের সুনন্দপ্রিয় ভিক্ষু, জাতীয় হিন্দু মহাজোটের এস কে রায়, মানবাধিকার কর্মী মনিরুজ্জামান, সাংবাদিক সাইফুর রহমান তপন, অধ্যাপক চন্দন সরকার, অতুল চন্দ্র মণ্ডল, ঋষি পঞ্চায়েত ফোরামের রাজকুমার দাস প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজল দেবনাথসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, আলোচনা থেকে পাওয়া সুপারিশসমূহ নিয়ে সংখ্যালঘু ঐক্যমোর্চার পক্ষ থেকে একটি অবস্থানপত্র তৈরি করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত সকল কমিশনকে দেওয়া হবে।
মন্তব্য করুন