মানুষের জীবন পৃথিবীর সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ভ্রমণ কাহিনি

ডিবির হাওড়, সিলেট। ছবি : সংগৃহীত
ডিবির হাওড়, সিলেট। ছবি : সংগৃহীত

ভ্রমণ নিয়ে সাক্ষাৎকার?

কিছুটা কৌতূহলী চাহনি জনপ্রিয় ব্যান্ড চিরকুটের গীতিকার, সুরকার, ভোকালিস্ট শারমিন সুলতানা সুমির চোখেমুখে! 

তারপর তাকে বিষয়টা আরেকটু খোলাসা করে বললাম, নাহ, আমি সাক্ষাৎকার নিতে আসিনি, আমি আপনার ভ্রমণের গল্প শুনতে এসেছি। ধরে নেওয়া যাক এটা আমাদের ভ্রমণ নিয়ে গল্প বলার সেশন। আপনি বক্তা আমরা শ্রোতা।

হালদেন, নরওয়ে। ছবি : সংগৃহীত
হালদেন, নরওয়ে। ছবি : সংগৃহীত

সুমি হাসলেন, তার সেই স্বভাবসুলভ মিষ্টি হাসি। আর তারপর যে কথাটা বললেন সেটা কিছুটা স্তম্ভিত করে দিল আমাকেই—‘ভ্রমণ তো অদ্ভুত ব্যাপার। তবে আমার কাছে মনে হয় মানুষের জীবনের চেয়ে রোমাঞ্চকর ভ্রমণ কাহিনি পৃথিবীতে আর নেই। সুখ, দুঃখ, হাসি-কান্না, সম্পর্ক, কর্ম, প্রেম এবং মানুষকে ঘিরে আর অন্যান্য সবকিছু যার উপজীব্য। এখানে কেউ হয়তো সশরীরে পৃথিবী ভ্রমণ করেও অনেক কিছু দেখতে পায় না। আবার কেউ হয়তো হৃদয়ের বিশালতায় কোথাও না ঘুরেও বুকের ভেতর পৃথিবীকে ধারণ করে। ভ্রমণ করে। সবকিছুকে কানেক্ট করতে পারে। জীবনের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে। আসলে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আমরা সবাই ভ্রাম্যমাণ, এ ভ্রমণের অংশ। এই যেমন তুমি আর আমি আজ কথা বলছি, এটাও সেই ভ্রমণ পরিক্রমারই একটা অংশ। আমরা দুজনই দুজনের ভ্রমণ প্রক্রিয়ার এই মুহূর্তে এসে একটা হল্ট বা বিরতি নিয়েছি মাত্র, তাই না?’

ম্যানহাটন নিউইয়র্ক সিটি। ছবি : সংগৃহীত
ম্যানহাটন নিউইয়র্ক সিটি। ছবি : সংগৃহীত

আমাদের গ্রামের নাম পাঁচপাখিয়া। আব্বার ছিল সেই গ্রামের প্রতি ভীষণ টান। আমি হয়তো অনেকটা উনার গুণ পেয়েছি। ওই যে বললাম জীবনটাই একটা ভ্রমণ, তো আব্বা যেদিন তার দুনিয়া ভ্রমণের ইতি টানলেন, সেদিন বাসার সবাই যখন কাঁদছিল; আমি আব্বার মৃতদেহের কাছে গিয়ে প্রাণভরে কপালের গন্ধ নিয়ে রেখেছিলাম। সে গন্ধেই আমি এখনো আব্বার সব পাই। আব্বার গ্রাম, আব্বার সবুজ মাঠ, পুকুর, প্রিয় হাসি সব। এখন আমি চাইলেই সে গন্ধটা টের পাই, নিতে পারি। নিই। গন্ধটা আমার বুকের ভেতরে এক অন্যরকম অস্তিত্বের ভ্রমণ তৈরি করে।

এতটুকু বলে সুমি একটু থামলেন। হয়তো বাবাকে নিয়ে একটু খারাপ লাগা কাজ করছিল, তাই প্রসঙ্গ পাল্টাতেই প্রশ্ন করলেন… শিমুল ফুল ফোঁটার সময়টা এখন না?

পর্তুগালের সমুদ্র তীরে। ছবি : সংগৃহীত
পর্তুগালের সমুদ্র তীরে। ছবি : সংগৃহীত

উত্তরের অপেক্ষা না করেই বললেন… আমার ছাতিম আর শিমুল ফুল খুব পছন্দ। মানে বৃক্ষ ফুল আর কি। হয় না বিশাল জায়গাজুড়ে শিমুল ফুল বিছিয়ে আছে… কী যে সুন্দর লাগে দেখতে!!!

এরপর গল্পে কয়েক সেকেন্ডের বিরতি। সে বিরতি ভেঙে সুমিকে প্রশ্ন করি—কাজের প্রয়োজনে তো দেশের অনেক জায়গায় যাওয়া হয়, এমন কখনো হয়েছে যে কোথাও গিয়ে সেখান থেকে আর ফেরার ইচ্ছে হয়নি?

প্রশ্নটা শুনে সুমির ঝটপট উত্তর, হ্যাঁ দুটো জায়গা কক্সবাজার আর শ্রীমঙ্গল। চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, বান্দরবানও খুব প্রিয়। প্রথম কথা হলো আমি খুব পাহাড় পছন্দ করি। সমুদ্রও খুব ভালো লাগে, কিন্তু সমুদ্রের চেয়ে বেশি পাহাড়।

নিজেকে কক্সবাজারের প্রেমিকা দাবি করেন সুমি। ছবি : সংগৃহীত
নিজেকে কক্সবাজারের প্রেমিকা দাবি করেন সুমি। ছবি : সংগৃহীত

আগে কক্সবাজারের কথাই বলি, এই একটা জায়গা সেখানে যতবারই গিয়েছি আমার কেমন যেন ফিরতে মন খারাপ লাগে। আমি নিজেকে কক্সবাজারের প্রেমিকা দাবি করি। তুমি হয়তো শুনলে অবাক হবে যে, এই কক্সবাজারের প্রেমে আটকে গিয়ে আমি আজ পর্যন্ত কখনো সেন্টমার্টিন যাইনি। যাইনি ইচ্ছে করেই, কারণ সবাই বলে আমি যদি একবার সেন্টমার্টিন যাই তাহলে এরপর আমার আর কক্সবাজারকে ভালো লাগবে না। আমি বলি এত ভালো লাগার দরকার নেই! জানি খুব যুক্তিহীন কথা। কিন্তু এমন যুক্তিহীন পাগলামি না থাকলে কি প্রেম হয় নাকি, বলো! কী এক আজব যে আমার এই প্রেম! তুমি হয়তো বলতে পারো পৃথিবীর অনেক দেশেই তো অনেক সুন্দর সাজানো গোছানো সমুদ্রসৈকত আছে, তাহলে কক্সবাজার কেন এত ভালো লাগে। বিষয়টা আসলে এখানেই। প্রথমত নিজের দেশের কিছুর সঙ্গে অন্য কিছুর তুলনা চলে না। এটা আবেগের ব্যাপার। দ্বিতীয়ত ধরো অস্ট্রেলিয়া কিংবা আমেরিকার সমুদ্রসৈকতগুলো অনেক সুন্দর, সাজানো গোছানো। কিন্তু কক্সবাজারের মতো বিশালতা সেগুলোতে নেই। এই কক্সবাজারে গেলেই মনে হয় সেই বিশাল সৈকতের মাঝে একটা রাজা রাজা ভাব আছে, মোটকথা কক্সবাজারটা আমাকে চুম্বকের মতো টানে। সেখানের বাতাস আমার জন্য জরুরি।

ট্যাগাস নদী, লিসবন। ছবি : সংগৃহীত
ট্যাগাস নদী, লিসবন। ছবি : সংগৃহীত

বান্দরবানের গল্পে বুঁদ হয়ে গেলেন সুমি। এর ফাঁকেই প্রশ্ন করি কত দেশেই তো ভ্রমণ করা হলো। ওসব দেশের সঙ্গে এ দেশটার সবচেয়ে বড় পার্থক্য কোথায় খুঁজে পেলেন?

সুমি মনে হয় প্রশ্নের উত্তর প্রস্তুত করেই রেখেছিলেন ঠোঁটের কোণায়। উত্তর দিলেন—সব দেশেরই স্বকীয়তা আছে। প্রতিটি দেশই যে যার মতো সুন্দর। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ আর তাদের আতিথেয়তার কাছে হার মানবে যে কেউ। আমাদের দেশের মানুষ প্রচণ্ড রকমের ভালোবাসতে জানে, আপন করে নিতে জানে, আতিথেয়তা করতে জানে, যা পৃথিবীর আর কোথাও গিয়ে খুঁজে পাইনি। আমাদের মাটির গন্ধটা একদম আলাদা। তবে আমি যে দেশেই যাই না কেন, সেখানকার স্থানীয় সংস্কৃতিকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করি। কত হাজার হাজার মানুষ, কত রূপ, কত সংস্কৃতি, কতশত হাজার বছরের ঐতিহ্য। অথচ আবেগের জায়গা সবার এক।

ভালোবাসা, প্রিয়জনের প্রতি অনুভূতি সবার এক। হয়তো প্রকাশভঙ্গি ভিন্ন। এগুলো দেখতে খুব ভালো লাগে। চিরকুট-এর মাধ্যমে ব্যান্ড মেম্বাররাসহ কিংবা একা অনেক দেশ, অসংখ্য শহর নগরী ঘোরার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, স্পেন, সুইজারল্যান্ড, মালয়েশিয়া আরও কিছু দেশ। তবে পর্তুগাল, শ্রীলঙ্কা, নরওয়ে আর ইন্ডিয়া আমার মনে বেশি দাগ কেটেছে। কোথাও সংস্কৃতির, কোথাও ভাবের আদান-প্রদানের একটা মিল আছে। আর দেশের বাইরের প্রবাসী বাঙালিদের কথা বিশেষ করে বলতেই হয়। আসলে দেশের বাইরে গেলে মানুষ আমাদের বুঝতেই দেন না যে আমি আমার দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও এসেছি। আমাদের হয়তো অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু এভাবে ভালোবাসতে বোধহয় বাংলাদেশের মানুষই পারে।

ইভোরা, পর্তুগাল। ছবি : সংগৃহীত
ইভোরা, পর্তুগাল। ছবি : সংগৃহীত

সুমি হাসলেন, কিছুটা উচ্ছ্বাসভরা গলায় বললেন—তুমি বিশ্বাস করবে না যে ওই বাড়িটাতে ঢুকতেই সত্যিই গা ছমছম করা একটা পরিবেশ টের পেলাম। সেই ভূতবাড়িতে বিশাল একটা হাসনাহেনাগাছ আছে। এত বড় হাসনাহেনাগাছ আমি জীবনেও দেখিনি। হাসনাহেনা ফুলের গন্ধে কেমন যেন পাগল পাগল লাগছিল। আর সে বাড়িতে যাদের সঙ্গে কথা বলেছি, মনে হচ্ছিল তিনিই ভূত হয়ে কথা বলছেন। এমন নাকি ওখানে বহুবার হয়েছে। যে ভূত সামনের মানুষটার বেশে দাঁড়িয়ে থাকে। ওখান থেকে আসার পর মনে হচ্ছে, তোমার সামনে যে আমি কথা বলছি সে কি সুমি না ভূত, তাইবা কে বলতে পারে; বলে সুমি মজা করে হাসলেন!

প্যারিসের আইফেল টাওয়ার। ছবি : সংগৃহীত
প্যারিসের আইফেল টাওয়ার। ছবি : সংগৃহীত

সুমি বিশ্বাস করেন পৃথিবীতে কে কোথায় কখন থাকবেন, কে কী পাবেন, কতদূর যাবেন তার নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে না। সব হয় সৃষ্টিকর্তার ইশারায়। এক জীবনের জাগতিক ভ্রমণে তার ইশারায় সারা দেশসহ পৃথিবী ঘোরার যে সৌভাগ্য সুমির হয়েছে একজন যাযাবর মানুষ হিসেবে তা শুধুই তাকে নত হতে, মাটির আরও কাছাকাছি থাকতে শিখিয়েছে। শিখিয়েছে নিজের ভুল শুধরে সহজ মানুষ হওয়ার চেষ্টা করতে। ধৈর্যশীল হতে। ক্ষমা করতে। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির বিশালত্বের কাছে এই জীবন যে কত ক্ষুদ্র, নশ্বর তাই যেন তিনি বারবার উপলব্ধি করেন প্রতিবার ভ্রমণে। আর এভাবে ঘুরতে ঘুরতে দিগ্বিজয়ী সুমির নাকি এখন পুরো পৃথিবীটাকেই নিজের ঘর মনে হয়।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.
logo
kalbela.com