ইরানের পূর্ব নাম পারস্য। ১৯৩৫ সালে রেজাশাহ পাহলভি পারস্যের নতুন নামকরণ করেন ইরান। পারস্য ছিল প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে সম্রাট সাইরাস দ্য গ্রেট কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত পারস্য সাম্রাজ্য ছিল পৃথিবীর প্রথম পরাশক্তি। উন্নত শাসনব্যবস্থা, ধর্মনিরপেক্ষতা, শিল্প-সংস্কৃতি, স্থাপত্যকলা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি প্রভৃতি ক্ষেত্রে পারস্য সভ্যতা এক অনন্য নজির স্থাপন করেছিল। ৬৫১ খ্রিষ্টাব্দে মুসলিমরা পারস্য জয় করলে সেখানে ইসলাম ধর্মের রক্ষণশীলতার পরিবর্তে এক উদারনৈতিক ধারা প্রবর্তিত হয়, যার নাম সুফিবাদ। পারস্যের সুফিবাদের ঢেউ ভারতে এসেও পড়ে। সুফিবাদের প্রভাবে মুসলিম আমলেও পারস্যে অনেক জ্ঞানী-গুণী, চিন্তাবিদ, দার্শনিক, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীর আবির্ভাব হয়। যেমন—আল খাওয়ারিজমি, আর রাজি, ইবনে সিনা, শেখ সাদি, ওমর খৈয়াম, কবি হাফিজ, ফরিদউদ্দিন আত্তার প্রমুখ যাদের জ্ঞান বিজ্ঞানের আলোকে আলোকিত হয়ে উঠে মুসলিম সাম্রাজ্য।
এমন একটি উদারনৈতিক দেশে ১৯৭৯ সালে শিয়া ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামী বিপ্লব। এ বিপ্লবের ফলে মোহাম্মদ রেজাশাহের মতো একজন উদারনৈতিক শাসককে বিতাড়িত করে ইরানে শুরু হয় শরিয়া শাসন। ইসলামী বিপ্লবের পর থেকে ইরানে শুরু হয় মৃত্যুদণ্ড, কারাদণ্ড, রক্তপাত ও দমন-নিপীড়নের ইতিহাস। বিশেষ করে নারীর প্রতি বিরূপ আচরণ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয়। রেজাশাহের আমলে মাহনাজ আফকামি ও ফারুক পারসা নামে দুজন নারী মন্ত্রী ছিলেন। বিপ্লবের সময় মাহনাজ আফকামি রাষ্ট্রীয় সফরে যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন। ফলে তিনি বেঁচে যান। আর ফারুক পারসাকে ফাঁসি দেওয়া হয়, তাও যৌনপল্লীতে নিয়ে। তাদের মতে, তিনি বেশ্যার চেয়েও খারাপ। তিনি নারীদের ঘর থেকে বের করে আনছিলেন। শাহ সমর্থক শত শত শিক্ষক, আইনজীবী, চিকিৎসক, বিচারক, অফিসার, কর্মচারী, সাংবাদিক, শিল্পী, সাহিত্যিক, মুক্তমনাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে, হত্যা করা হয়েছে। যে কমিউনিস্টরা শাহের বিরুদ্ধে খোমেনির সঙ্গে আন্দোলন করেছিল, বিপ্লবের পর তাদের নাস্তিক আখ্যা দিয়ে নিধন করা হয়।
ইসলামী বিপ্লবের পর ইরানকে মধ্যযুগের ধ্যান-ধারণায় ফিরিয়ে নেওয়া হয়। রেজাশাহের পারিবারিক সুরক্ষা আইন, পর্দাবিরোধী আইন বাতিল করা হয়। মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ থেকে ৯ বছরে নামিয়ে আনা হয়। অবশ্য ২০০২ সালে তা ১৩ বছর করা হয়। বহুবিবাহকে উৎসাহিত করা হয়। নারীর স্বাধীন চলাফেরা রহিত করা হয়। এমনকি দেশ ছাড়ার জন্য পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি নিতে হয়। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় করা হয়। নারীদের প্রশাসনিক ও বিচার বিভাগের উচ্চপদ থেকে রহিত করা হয়। নারীদের পর্দা, বোরকা, হিজাব পরতে বাধ্য করা হয়। কোনো নারী পর্দা পুশিদা ঠিকমতো করছে কিনা তা দেখার জন্য ধর্ম পুলিশ টহলের ব্যবস্থা করা হয়। ব্যত্যয় হলে নারীরা পুলিশের হাতে আটক হয়, মার খায়, মারাও যায়। এমন একটি ঘটনা ঘটে ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২ তারিখে। ঠিকমতো হিজাব পরিধান না করায় মাইশা আমিনি নামক ২২ বছর বয়সী মেয়ে পুলিশের হাতে আটক হন এবং পুলিশ হেফাজতে মারা যান। এর প্রতিবাদে হিজাববিরোধী তুমুল আন্দোলন হয়। এ আন্দোলনে পাঁচ শতাধিক লোক নিহত হয়। নিহতদের মধ্যে ৬৩ জন শিশু রয়েছে।
খামেনি সরকার হিজাববিরোধী আন্দোলনকে কঠোর হস্তে দমনের সিদ্ধান্ত নেয়। এইচআরএএনএর প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরে শুরু হওয়া ইরানের বিক্ষোভে এখন পর্যন্ত ১৯ হাজার ২৬২ জন বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ইরানের বিচার মন্ত্রণালয় আন্দোলনকারীদের আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী হিসেবে আখ্যায়িত করে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করছে এবং ভীতি সৃষ্টির লক্ষ্যে মধ্যযুগীয় কায়দায় প্রকাশ্যে ফাঁসি দিচ্ছে। গত ৮ ও ১২ ডিসেম্বর মোহসেন শেকারি ও মাজিদ রেজা রাহনাভার্দ নামক দুই ব্যক্তিকে তেহরানের রাস্তায় প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হয়। তাদের বিরুদ্ধে খোদাদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়। খামেনি সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ মানে খোদাদ্রোহিতা।
বিচারের নামে চলছে প্রহসন। অভিযোগ গঠনের মাস পেরোতে না পেরোতেই দেওয়া হয় মৃত্যুদণ্ড। নেই কোনো আপিলের ব্যবস্থা। আত্মপক্ষ সমর্থনের তেমন সুযোগ নেই। ১৩ ডিসেম্বর এক দিনে রাজধানী তেহরানের একটি আদালত অন্তত ৪০০ জন হিজাববিরোধী বিক্ষোভকারীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন। তাদের মধ্যে ১৬০ জনকে ৫ থেকে ১০ বছরের এবং বাকিদের ২ থেকে ৫ বছরের সাজা দেওয়া হয়। এ ছাড়া ৭০ জনকে জরিমানাও করা হয়। আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির ভাগ্নি প্রকৌশলী ফরিদা মোরাদখানি নারীর পোশাকের স্বাধীনতার দাবিতে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকার কড়া সমালোচনা করায় তাকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অভিযোগে ইরানের বিচার বিভাগ ৯ জানুয়ারি সালেহ মিরহাশেমি, মাজিদ কাজেমি ও সাইদ ইয়াগৌবির মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে।
নরওয়েভিত্তিক ইরান হিউম্যান রাইটসের ভাষ্যমতে, ইরানে ২০২০ সালে ২৬৭, ২০২১ সালে ৩১৪ এবং ২০২২ সালে ৫০৯ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। গত জুন মাসে ৪৫ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ৮ জুন ২০২২, ইরানের সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশের জাহেদানের প্রধান কারাগারে ১২ বন্দির ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর থেকে ধর্মীয় নেতা খোমেনির নীতি ও আদর্শের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করলে নেমে আসে অমানুষিক নির্যাতন। হাসান লাহোতি আশকেভারি ছিলেন আয়াতুল্লাহ খোমেনির ঘনিষ্ঠ একজন সহযোগী। কিন্তু বিপ্লবের পর তিনি খোমেনির অনেক বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করতে শুরু করেন। বিপ্লবের দুই বছর পর তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয় এবং সেখানেই তিনি মারা যান।
তার পরিবারের অভিযোগ, তাকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে। ২০২১ সালে রক্ষণশীল নেতা ইব্রাহিম রাইসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে খামেনির পদাঙ্ক অনুসরণ করতে থাকেন। ১৯৮৮ সালে রাইসি তেহরানের বিপ্লবী আদালতের ডেপুটি প্রসিকিউটর ছিলেন। ওই সময়ে মার্কসবাদী ও অন্যান্য বামপন্থিকে গণহত্যার সঙ্গে তার নাম যুক্ত ছিল। ফলে দুই রক্ষণশীল নেতার শাসনে ইরানবাসী পার করছে বিভীষিকাময় সময়। কবে এ বিভীষিকাময় সময়ের যবনিকাপাত হবে কে জানে? তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খামেনি সরকার আপাতত বেঁচে গেছে, নইলে খবর ছিল! পশ্চিমা শক্তির হাত থেকে রেহাই পাওয়া এত সহজ ছিল না।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক