
সময়টা ২০২১ সালের ১৪ আগস্ট। তালেবান কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার আগের রাতে ‘টোলো নিউজ’ এবং ‘রেডিও টেলিভিশন আফগানিস্তান’ এ প্রাইম টাইম নিউজ শো উপস্থাপনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন শবনম দাওরান।
ওই সময় তালেবান আশপাশের সব অঞ্চলের দখল নিয়ে ক্রমশ রাজধানীর দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। ২৪ বছরের উদীয়মান উপস্থাপক শবনম তখন খবরের পরিচিত মুখ। দর্শক-শ্রোতারা তালেবানের এই অগ্রসর হওয়ার খবর জানতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন।
এই উপস্থাপক সম্প্রতি বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমি এতটাই আবেগপ্রবণ ছিলাম যে আমি মূল গল্পটিও পড়তে পারিনি। তখন যারা আমাকে দেখছিলেন, তারাই বলতে পারবেন তখন আমি কোন অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম।’
পরের দিন সকালে শবনম যখন ঘুম থেকে উঠলেন, ততক্ষণে রাজধানী কাবুলের দখল নিয়ে নিয়েছে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী তালেবান। একজন তালেবান সদস্য তাদের সাদা-কালো পতাকা নিয়ে স্টুডিওতে ঢুকলেন। আগের রাতে শবনম যেখানে বসেছিলেন, সেখানেই বসলেন তিনি। এই দৃশ্য একটি পরিবর্তনের চিহ্ন হয়ে রইল।
প্রথম সংবাদ সম্মেলনে তালেবানের পক্ষ থেকে জানানো হলো, কর্মক্ষেত্রে তারা নারীদের জন্য কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে না। পরের দিন উদ্বিগ্ন ও বিচলিত শবনম অফিসে গেলেন। কয়েকজন তালেবান সদস্য তাকে অফিসের গেটের কাছে আটকালো। জানানো হলো, শুধু পুরুষরাই ভেতরে যেতে পারবে।
একজন তালেবান সৈন্য তাকে জানালেন, ইসলামিক আমিরাত (তালেবানের অধীনে থাকা আফগানিস্তান) এখনও নারীদের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। তার সঙ্গে থাকা অপর এক সৈন্য উপহাসের সঙ্গে বললেন, ‘আপনি অনেক কাজ করেছেন, দয়া করে এবার আমাদের করতে দিন।’
নারী হলেও তার কাজ করার অধিকার আছে, প্রসঙ্গটি তুলতে একজন সৈন্য ক্ষিপ্ত হলেন। তিনি শবনমের দিকে বন্দুক তাক করে বললেন, ‘আপনার জন্য তাহলে একটি গুলিই যথেষ্ট হবে। আপনি কি যাবেন, নাকি আমাকে বাধ্য করবেন?’
বাড়িতে এসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনা তুলে ধরে একটি ভিডিও বানান শবনম। ভিডিওটি পোস্ট করার পর সেটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় পড়েন তিনি।
পরের দিনেই হাজারও আফগান শরণার্থীর সঙ্গে মিশে গিয়ে আফগানিস্তান ছেড়ে যুক্তরাজ্যে পাড়ি দেন শবনম দাওরান। এর কিছু দিন পর তার দুই ভাই-বোনও তার সঙ্গে যোগ দেন।
নতুন পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে বেশ বেগই পোহাতে হচ্ছে শবনমকে। কারণ, তিনি ইংরেজি জানেন না, শরণার্থী হওয়ায় তার জন্য চাকরির বাজারও সংকুচিত।
তিনি বলেন, ‘ইংরেজি না জানায় প্রথম দিন আমি বাজার পর্যন্ত করতে পারিনি। আমরা কী বলতে চাই, তা প্রকাশ করা আমাদের জন্য কঠিন। আমাদের প্রথম থেকে আবার সবকিছু শুরু করতে হবে। ইংরেজি শিখতে হবে, কলেজে ভর্তি হতে হবে।’
বর্তমানে শবনম ও তার বোন মীনা দাওরান স্থানীয় একটি কলেজে ভর্তি হয়ে পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার ছোট ভাই হেমায়েত দওরানও একটি স্কুলে ভর্তি হয়েছেন।
শবনম জানান, যুক্তরাজ্যে তারা ভালো আছেন। তার মতো সব শরণার্থী সৌভাগ্যবান নন। কারণ, তিনি কাউন্সিল হাউজে একটি রুম পেলেও অন্যরা তা পাননি।
তিনি বলেন, যুক্তরাজ্য সরকার ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। আগে আসার পরেও অনেক আফগান শরণার্থী এখনও ভালো আবাসস্থল পাননি। তারা বিভিন্ন হোটেলে থাকছেন, যেখানে তারা ভালো নেই।
এ বিষয়ে দেশটির স্বররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, ইউক্রেনীয় ও আফগান শরণার্থীদের একে অপরকে মুখোমুখি দাঁড় করানোটা ভুল। আমরা উভয়কে নিয়ে কাজ করছি।
মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছে- ঝুঁকিতে থাকা ২০ হাজার আফগান শরণার্থীর আবাসন নিশ্চিত করবে যুক্তরাজ্য, যা চলমান। এ জন্য অন্তত ৩০০টি সংস্থাকে নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। বিষয়টি জটিল ও সময় সাপেক্ষ হওয়ায় এখন পর্যন্ত ৬ হাজার শরণার্থীর আবাসন নিশ্চিত হওয়া গেছে, বাকিগুলোও চলমান।