
প্রথম কোনো আদিবাসী হিসবে ভারতের রাষ্ট্রপতির শপথ নিয়েছেন দ্রৌপদী মুর্মু। আজ সোমবার সকালে ১৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন তিনি। তাকে শপথ পড়িয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এন ভি রমানা। শপথ গ্রহণের পর জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন মুর্মু।
যেখানে তিনি বলেন, ‘ভারতের দরিদ্ররাও যে স্বপ্ন দেখতে পারে, স্বপ্ন সত্যি করতে পারে, এর বড় প্রমাণ আমার নির্বাচন।’ ব্যক্তিগত জীবনের সংগ্রাম তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘অথচ প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনই আমার কাছে স্বপ্ন ছিল।’
তরুণদের উদ্দেশে দ্রৌপদী মুর্মু বলেন, ‘শুধু নিজেদের ভবিষ্যতের দিকে মনোনিবেশ নয়, দেশের ভবিষ্যতের ভিত্তিও তৈরি করুন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে আপনাদের প্রতি আমার পূর্ণ সহযোগিতা থাকবে।’ এ ছাড়া দেশটির প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য কাজ করার কথাও জানিয়েছেন তিনি।
ওডেসার ময়ূরগঞ্জ জেলার একটি আদিবাসী পরিবারে ১৯৫৮ সালের ২০ জুন জন্মগ্রহণ করেন দ্রৌপদী মুর্মু। তিনি ভারতের অন্যতম বৃহৎ উপজাতি গোষ্ঠী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষ। তার বাবা গ্রাম পরিষদের প্রধান ছিলেন।
প্রেসিডেন্ট মুর্মুকে ১৯৮০ সাল থেকে চেনেন সাংবাদিক ও অধীকার কর্মী নিগমানন্দ পট্টনায়েক। তার বিষয়ে তিনি বিবিসিকে বলেছেন-
তৎকালীন ওডিশা সরকারের মন্ত্রী কার্তিক মাঝি একবার এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। মুর্মু তার স্কুল সার্টিফিকেট হাতে নিয়ে দৌঁড়ে সেই মঞ্চে চলে যান। মন্ত্রীকে জানান, তিনি ওডেসার রাজধানী ভুবনেশ্বরে পড়তে চান। পড়াশুনার বিষয়ে ছোট্ট মেয়েটির উৎসাহ দেখে মন্ত্রী মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, মেয়েটিকে যেন রাজধানী ভুবনেশ্বরের কোনো একটি সরকারি স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করা হয়।
ভুবনেশ্বরের রমা দেবী মহিলা কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে চাকরিজীবন শুরু করেন মুর্মু। ওডেসা সরকারের সেচ বিভাগের একজন কেরানি হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত কাজ করেছিলেন সেখানেই। পরে পরিবারের যত্ন নিতে, শাশুড়ির পীড়াপীড়িতে ওই চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। ভুবনেশ্বর ছেড়ে ফিরে আসেন রায়রাংপুরে। সেখানে শ্রী অরবিন্দ ইন্টিগ্রাল স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন মুর্মু।
পট্টনায়েক বলেন, সেখানে চাকরি নিলেও বেতন নিতেন না দ্রৌপদী। তিনি বলতেন, ‘আমি চাকরি করছি না, জনসেবা করছি।’ স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে বেতন নিতে রাজি করাতে ব্যর্থ হয়ে শেষমেশ রিকশা ভাড়ার টাকা দিতো।
দ্রৌপদী মুর্মুর পুরোদস্তুর রাজনীতি জীবন শুরু ১৯৯৭ সালে। ওই বছরই পৌরসভা নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রথমবারের মতো কাউন্সিলর নির্বাচিত হন তিনি। সেসময় শহর পরিচ্ছন্ন রাখার কাজ তদারকি করতে তাকে বিভিন্ন স্থানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যেতো। যা তার জনপ্রিয়তা বাড়াতে সহায়তা করেছে।
এর তিন বছর পর রাজ্য বিধানসভায় নির্বাচিত হন ওডিশার ময়ূরগঞ্জ জেলার বাসিন্দা দ্রৌপদী মুর্মু। রায়রাংপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে দুই দফায় বিজেপির বিধায়কও হয়েছেন তিনি। ২০০৭ সালে ওডিশা বিধানসভায় সেরা বিধায়ক হিসেবে ‘নীলকান্ত’ পুরস্কার জেতেন দ্রৌপদী। ২০১৫ সালে ঝড়খণ্ডের রাজ্যপাল হিসেবে নিযুক্ত হন।
এরপর ২০১৭ সালে প্রথম লাইমলাইটে আসেন তিনি। তখন ঝাড়খণ্ড রাজ্যের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন মুর্মু। সেসময় গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিলো- বিজেপি তাকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিবেচনা করছে। তখন রামনাথ কোবিন্দ প্রেসিডেন্ট হলেও তার মেয়াদপূর্ণ হওয়ার পর অবশেষে ২০২২ সালে ভারতের প্রথম আদিবাসী রাষ্ট্রপতি হিসেবে মনোনয়ন ও নির্বাচিত হন তিনি।
২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল, এই সাত বছর দ্রৌপদী মুর্মুর জীবনের সবচেয়ে বিষাদময় সময়। এই সময়ে তার বড় ছেলের মৃত্যু হয়। সেই শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই মৃত্যু হয় তার স্বামী ও ছোট ছেলেরও। কাছাকাছি সময় নিজের ভাই ও মাকেও হারান মুর্মু। হয়ে পড়েন দিশেহারা।
রাজ্যের দলীয় সহকর্মী কবি বিষ্ণু সতপতী, যিনি মুর্মুকে ১৯৮০ এর দশক থেকে চেনেন। তিনি বলেন, ‘হঠাৎ করেই স্বামী, দুই ছেলে, মা ও ভাইকে হারিয়ে ভেঙে পড়েন তিনি। যখনই দেখা হতো, দেখতাম সে কান্না করছে। আর সেটাই স্বাভাবিক ছিলো, কারণ তিনি কাছের সবাইকে হারিয়ে ফেলেছিলেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘সবচেয়ে কাছের মানুষগুলোকে হারিয়ে ভেঙে পড়ার পরেও আবারও তিনি নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন এবং মানুষের জন্য কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। ব্যতিক্রমী ও শক্তিশালী মানসিকতা না থাকলে কারও পক্ষে এটা সম্ভব নয়। এই ব্যতিক্রমী গুনই তাকে প্রেসিডেন্ট পদের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানজনক পদে বসিয়েছে।’