আব্দুল্লাহ আল জোবায়ের
প্রকাশ : ২৯ অক্টোবর ২০২২, ০২:০৮ এএম
অনলাইন সংস্করণ

ফটোকপিতে আটকে আছে ঢাবির শিক্ষা

ফটোকপিতে আটকে আছে ঢাবির শিক্ষা

বিশ্ব আমূল বদলে গেলেও গত কয়েক দশকেও সিলেবাস বদলায়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অনেক বিষয়ের। রয়ে গেছে পুরোনো আমলের প্রশ্নরীতিও। শিক্ষার্থীদের দেখা যায় নোট আর শিট ফটোকপিতে ব্যস্ত। পুরোনো নোট মুখস্থ করেও পাওয়া যাচ্ছে প্রথম শ্রেণি।

বিশেষ করে কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের বেশ কয়েকটি বিভাগের পাঠ্যসূচি পর্যালোচনায় জানা গেছে, বাংলা, ইতিহাস, ইসলামের ইতিহাস, আরবি, উর্দু, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য, সংস্কৃত, পালি ও বুড্ডিস্ট স্টাডিজ, বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতি, দর্শন, ইসলামিক স্টাডিজ, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির মতো বিভাগগুলোর পাঠসূচি ও শিখন পদ্ধতিতে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি। বছরের পর বছর একই পদ্ধতিতে একই লেকচার দিয়ে যাচ্ছেন অনেক শিক্ষক। প্রশ্নের ধরন নিয়েও নেই তাদের মাথাব্যথা।

প্রসঙ্গত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিভাগের সিলেবাসে সংযোজন, বিয়োজন-বিয়োজন হলে সেটা সংশ্লিষ্ট বিভাগের ‘কমিটি অব কোর্সেস স্টাডিজ’ এ ওঠে। বিভাগের সব শিক্ষক সেই কমিটির সদস্য। এরপর সেটা একাডেমিক কমিটির মাধ্যমে অনুষদে যায়। এরপর সেটা ‘বোর্ড অব অ্যাডভান্স স্টাডিজ’ হয়ে চূড়ান্তভাবে একাডেমিক কাউন্সিলে গিয়ে অনুমোদন পায়। তবে নতুন কোনো বিষয় চালু হলে তার সিলেবাসের অনুমোদন লাগে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি)।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল কালবেলাকে বলেন, ‘যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাঠ্যসূচি করতে এক বছর আগে সব বিভাগকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিছু বিভাগ পাঠ্যসূচি ঢেলে সাজিয়েছে। সবার কাছ থেকে এখনো সাড়া পাওয়া যায়নি।’

শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, সেমিস্টার পদ্ধতিতে বছরে দুটি ফাইনাল ও দুটি মিড-টার্ম হয় এসব বিভাগে। দু-একটি কোর্স ছাড়া এসব বিভাগের মিড-টার্ম ও সেমিস্টার ফাইনালে প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি হয়। এক বছর বাদ দিয়ে পড়লেই কমন পাওয়া যায়।

মিড-টার্মে দিতে হয় একটি প্রশ্নের উত্তর। এর জন্য সর্বোচ্চ তিনটি প্রশ্নের উত্তর পড়েন শিক্ষার্থীরা। অনেকে আবার একটি পড়েও কমন পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন।

সেমিস্টার ফাইনালে বিভাগভেদে তিনটি থেকে পাঁচটি বড় প্রশ্ন এবং কয়েকটি ছোট প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। এসব পরীক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের বড় অংশই নির্ভর করে পুরোনো নোট-শিটের ওপর।

কলা অনুষদের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা কালবেলাকে জানান, ‘ঢাবির অনেকেই আশা অনুযায়ী বিভাগ পায় না। এতে তাদের বড় একটা অংশ হতাশায় ভোগেন। তাদের লক্ষ্য থাকে কোনোমতে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করা। নোট মুখস্থ করেই তারা পাস করার চেষ্টা করেন।’

জানা গেছে, এসব বিভাগে দুই ধরনের নোট-শিট পাওয়া যায়। কিছু শিট বিভাগের শিক্ষকরা তৈরি করেন। সেগুলো কলাভবনের পেছনের ছাউনির ফটোকপি দোকান থেকে টাকা দিয়ে শিক্ষার্থীদের সংগ্রহ করতে হয়। এসব শিট অধ্যায় ধরে তৈরি করা হয়। অনেক সময় বাজারে বই পাওয়া যায় না বলে শিক্ষার্থীরা এ শিট কিনতে বাধ্য থাকেন।

এ বিষয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এটিএম শামসুজ্জোহা কালবেলাকে বলেন, শিক্ষকদের দেওয়া শিট অনুসরণে শিক্ষার্থীদের অনাগ্রহের পেছনে কারণ হলো—প্রত্যেকটি বিভাগের মিশন ও ভিশনের সঙ্গে শিক্ষার্থীরা খাপ খাওয়াতে পারছে না। বিভাগভিত্তিক পড়াশোনা বাদ দিয়ে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই বিসিএসের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে। বিসিএস ক্যাডার হলে প্রভাব, ক্ষমতাসহ অন্যান্য সুবিধার কথা ভেবে তারা সাবজেক্টিভ পড়া থেকে দূরে চলে যাচ্ছে।

আরেক ধরনের নোট তৈরি করেন ক্লাসেরই কিছু শিক্ষার্থী। অনেকে পরীক্ষা শুরুর কিছুদিন আগে সেগুলো ফটোকপি করেন। এমনকি শুধু এ ধরনের নোট মুখস্থ করেও প্রথম শ্রেণি পাওয়া যায় জানিয়েছেন অনেকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কেউ যখন একটা বিভাগে পড়াশোনা করে, তখন আশা করা হয় সেই বিষয়ে সেই শিক্ষার্থী অভিজ্ঞ হবে। তার জ্ঞান রাষ্ট্র ও সমাজের কাজে লাগবে। প্রথাগত পদ্ধতিতে কিছু বিষয় পড়ানো হয় এবং যেভাবে প্রশ্ন করা হয়, এতে উন্নয়ন হচ্ছে না। মুখস্থনির্ভর জ্ঞান-তথ্য হয়তো পাচ্ছে, কিন্তু সত্যিকার অর্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে চাহিদা, দায়িত্ব সেই জায়গায় একটা ব্যবধান থেকে যাচ্ছে।’

সংক্ষিপ্ত নন-মেজর : কয়েকটি বিভাগের পাঠ্যসূচি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, আরবি বিভাগে আরবি সাহিত্য ও ব্যাকরণের পাশাপাশি নন-মেজর হিসেবে আছে বেসিক ও অ্যাডভান্সড ইংলিশ, মুসলিম দর্শন, বাংলাদেশ স্টাডিজ ১ম ও ২য় ভাগ, কম্পিউটার, সোশ্যাল রিসার্চ অ্যান্ড প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট।

বাংলা বিভাগে নন-মেজর কোর্স দুটি। বাংলা সাহিত্য ও ব্যাকরণের পাশাপাশি কেউ চাইলে সমাজবিজ্ঞান ও দর্শন পড়তে পারবে কিংবা ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য পড়া যাবে। আরেকটি নন-মেজর হলো ভাষাবিজ্ঞান।

উর্দুতে আছে ডেভেলপিং ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ স্কিলস, আইসিটি, ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস (১৫২৬-১৮৫৮), সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড সোশ্যাল ওয়ার্ক, বাংলাদেশ স্টাডিজ এবং বাংলাদেশের অর্থনীতি। ফারসি, সংস্কৃত ও পালিতেও প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে ইংরেজিকে। সঙ্গে আছে কম্পিউটার, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, ভারতীয় দর্শন এবং বাংলাদেশ স্টাডিজ বা রিসার্চ মেথোডোলজি, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট, কম্পিউটার সায়েন্স এসব বিষয়। এসব বিষয়ের কারিকুলাম বেশ সংক্ষিপ্ত ও বিস্তারিত পড়ানো হয় না বলে অভিযোগ অনেক শিক্ষার্থীর।

এসব বিষয়ের বেসিক জ্ঞান শিক্ষার্থীদের কী উপকার হবে জানতে চাইলে উর্দু বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মো. রেজাউল করিম কালবেলাকে বলেন, নন-মেজর বিষয়গুলোর সিলেবাস আমরা করি না। এসব বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষ, যোগ্য শিক্ষককে দিয়ে সিলেবাস করা হয়। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ হয়তো সঠিক নয়, কারণ জ্ঞানী-গুণী শিক্ষকরাই তো সিলেবাস করেন।

এদিকে, ইতিহাস বিভাগে একটি কম্পিউটার কোর্স চালু আছে। বাধ্যতামূলক এই কোর্স না করলে সনদ দেওয়া হয় না। এর মধ্যে আবার আছে মুখস্থ, লিখিত ও মৌখিক। মুখস্থ অংশে একজন শিক্ষার্থীকে কিছু প্রশ্ন দেওয়া হয়। তাকে এসবের উত্তর টাইপ করে লিখে দিতে হয়। লিখিত অংশে কম্পিউটার বিবিধ বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। সেসব লিখতে হয় খাতায়। এরপর হয় মৌখিক।

পদ্ধতি পুরোনো : কলা অনুষদের সব বিভাগেই ৩০ নম্বরের মিড টার্ম এবং ৬০ নম্বরের সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা হয়। ক্লাস উপস্থিতিতে ৫, টিউটোরিয়ালে ৫-সহ মোট ১০০ নম্বরের পরীক্ষা হয়। বিভাগ ভেদে প্রশ্নের ধরন আলাদা হলেও পরীক্ষা হচ্ছে একই রীতির প্রশ্নে।

ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষায় তিনটি বড় ও তিনটি ছোট প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। অন্য বিভাগগুলোর অবস্থাও একই।

উর্দু বিভাগে পরীক্ষা দেওয়া যায় বাংলায়। আরবি বিভাগেও তাই। এই বিভাগে সেমিস্টার ফাইনালে আরবি কবিতা, গল্প বা উপন্যাস থেকে একটি অনুবাদ আসে, যা আরবি থেকে বাংলা করতে হয়। ফারসি ভাষা ও সাহিত্যও চলছে একই ধারায়।

শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলেন, ‘কলা অনুষদের কিছু বিভাগে শিক্ষাপদ্ধতির সংস্কার হয়েছে। কিছু প্রথাগতভাবেই চলছে। সেমিস্টার পদ্ধতি থাকলেও কারিকুলাম উন্নয়ন না করলে ভালো ফল আসবে না।’

উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল কালবেলাকে বলেন, ‘ঢাবির জন্মলগ্ন থেকে কিছু বিভাগ সময়ের প্রয়োজন অনুযায়ী জ্ঞান বিতরণ করেছে। এখন পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। বৈশ্বিক চাহিদা বুঝে সিলেবাস সাজানো দরকার।’

এসব বিষয়ের জন্য নতুন প্রশ্ন পদ্ধতি কেমন হতে পারে জানতে চাইলে ইতিহাস বিভাগের একজন প্রভাষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সিনিয়র শিক্ষকরা প্রশ্ন করেন, তারা নিশ্চয়ই শিক্ষার্থীদের মেধার মূল্যায়নের বিষয়টি মাথায় রেখেই প্রশ্ন করেন। তবে প্রশ্ন পদ্ধতিতে আরেকটু সৃজনশীলতা আনা যায়।

সংস্কারের উদ্যোগ : জানা গেছে, দেশের উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নে একটি ফ্রেমওয়ার্ক অনুমোদন দিয়েছে সরকার। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তৈরি করা ফ্রেমওয়ার্কটি বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল (বিএসি)।

ফ্রেমওয়ার্কে শিক্ষা ব্যবস্থাকে দুটি অংশে ১০ ধাপে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম অংশে এক থেকে ছয় ধাপ পর্যন্ত প্রি-ব্যাচেলর এডুকেশন এবং দ্বিতীয় অংশে রয়েছে উচ্চশিক্ষা। এতে বিভিন্ন ডিগ্রির অ্যাক্রেডিটেশনের জন্য ন্যূনতম ক্রেডিট নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার সংস্কার সম্পর্কে জানতে চাইলে ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এম এম শাহিদুল হাসান বলেন, ‘বিষয়বস্তু ও শিক্ষাপদ্ধতির দিক থেকে বিশ্ব এগিয়ে গেলেও আমরা প্রথাগত কারিকুলামে রয়ে গেছি। এটা এখন চলে না। আগে স্মরণশক্তি বেশি আছে, এমন লোকদের জ্ঞানী বলা হতো। এখন স্মরণশক্তি গুরুত্বপূর্ণ নয়। কেউ এইচএসসিতে রেকর্ড মার্ক পেয়ে পাস করলেই যে সে সবকিছুর সমাধান দেবে, এমন নয়। রিয়েল ওয়ার্ল্ড নিয়ে তার ধারণা নাও থাকতে পারে।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

যে কারণে মোস্তাফিজের ওপর চটেছেন জাদেজা

চলতি বছরে হজ প্যাকেজের খরচ কমলো

রোববার গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়

দ্বিতীয় বিয়ের কারণে পুত্রের হাতে পিতা খুন

জেলেনস্কিকে ‘হত্যার ষড়যন্ত্রে’ সহায়তার অভিযোগে গ্রেপ্তার পোল্যান্ড নাগরিক

ক্ষেতে কাজ করার সময় হিটস্ট্রোকে কৃষকের মৃত্যু

পার্কে ডেকে তরুণীকে খুন, যেভাবে বদলা নিলেন মা

শেষ ওভারে ধোনির অবিশ্বাস্য কীর্তি

প্রচণ্ড গরমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা

আনোয়ার সিমেন্টে চাকরি, কর্মস্থল ঢাকা

১০

মৌয়ালকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেল বাঘ

১১

এসআইকে পিটিয়ে মাথা ফাটানোয় গ্রেপ্তার ১৬

১২

লন্ডন মাতাতে যাবেন জেমস

১৩

লোকসভা নির্বাচনে উত্তর প্রদেশ কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?

১৪

মার্কিন সংগীতশিল্পীর রহস্যজনক মৃত্যু 

১৫

সরকার চোরাবালির ওপর দাঁড়িয়ে, পতন অনিবার্য : রিজভী 

১৬

বিবর্ণ মোস্তাফিজে হতাশ বিশেষজ্ঞরা

১৭

ব্রাঞ্চ ম্যানেজার নেবে সীমান্ত ব্যাংক, ৪০ বছরেও আবেদন

১৮

আ.লীগের সব রকম কমিটি গঠন ও সম্মেলন বন্ধ : ওবায়দুল কাদের

১৯

মন্দিরে পূজা দিয়ে ফেরার পথে বাসচাপায় বাবা-ছেলে নিহত

২০
*/ ?>
X