অনেক পণ্যের মতো দেশে কয়লার বাজারেও চলছে অস্থিরতা। তিন মাসের ব্যবধানে প্রতি টনে দাম বেড়েছে ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা। কয়লার প্রধান ব্যবহারকারী ইটভাটার মালিকরা বলছেন, আমদানিকারকরা সিন্ডিকেট করে অতি মুনাফা করছেন। তবে দাম বৃদ্ধির জন্য বৈশ্বিক পরিস্থিতিকে দুষছেন আমদানিকারকরা।
কয়লার বাজার পরিস্থিতি নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে ইট প্রস্তুতকারক সমিতি। এতে দাম বাড়ানোর জন্য আমদানিকারকদের সিন্ডিকেটকে দায়ী করা হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে কয়লার বাজার পর্যালোচনার জন্য প্রতিযোগিতা কমিশনকে দায়িত্ব দিয়েছে মন্ত্রণালয়।
জানা গেছে, প্রতিযোগিতা কমিশন আমদানিকারক, কয়লা ব্যবসার মধ্যস্বত্বভোগী ও ইটভাটার মালিকদের মতামত এবং তথ্য-উপাত্ত নিয়ে বাজারে কোনো ধরনের অনিয়ম রয়েছে কিনা, তা পর্যালোচনার কাজ করছে। এরই মধ্যে আমদানিকারক ও ইটভাটার মালিকদের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি শুনানিও করেছে কমিশন। মধ্যস্বত্বভোগীদের সঙ্গে টেলিফোনে আলোচনা করেছে। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতার অভাবে কয়লার বাজারে আসলে কী হচ্ছে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না কমিশন।
প্রতিযোগিতা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, শুনানিতে ৭ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ইউরোপের অনেক দেশে কয়লার চাহিদা বেড়ে গেছে। রাশিয়া থেকে গ্যাস না পাওয়ার কারণে ইউরোপের দেশগুলোতে কয়লার ব্যবহার বেড়েছে। এতে বিশ্ববাজারে কয়লার দাম বেড়েছে। আবার বেড়েছে জাহাজ ভাড়া, বীমা খরচ ও ডলারের দাম। ডলারের বাড়তি দাম দিয়েও এলসি খোলা যাচ্ছে না, যার সামগ্রিক প্রভাবে বেড়েছে কয়লার দাম।
শুনানিতে ইট প্রস্তুতকারক সমিতির মহাসচিব আসাদুর রহমান জানান, বর্তমানে ইট তৈরির মৌসুম চলছে। দেশের সিংহভাগ ইটভাটার প্রধান জ্বালানি কয়লা, যার পুরোটাই আমদানিনির্ভর; কিন্তু কয়লা আমদানিকারকরা অতিরিক্ত দাম রাখায় ভাটাগুলোর খরচ বেড়ে গেছে। এতে ইটের উৎপাদন খরচ বাড়বে।
আসাদুর রহমান শুনানিতে আমদানিকারকদের সিন্ডিকেটের অভিযোগ করেন। এ সময় আমদানিকারকরাও ইট প্রস্তুতকারকদের বিরুদ্ধে মজুতদারির অভিযোগ তোলে। আমদানিকারকরা বলেন, ইট প্রস্তুতকারকরা তাদের (কয়লা আমদানিকারক) কাছ থেকে কয়লা কিনে মজুত করে রাখেন। পরে বেশি দামে বিক্রি করেন।
কয়লা আমদানিকারক জে এইচ এম ইন্টারন্যাশনালের ম্যানেজার মো. শামসুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, ডলারের উচ্চ মূল্য, জাহাজ ভাড়া বেড়ে যাওয়া এবং সময়মতো এলসি খুলতে না পারার কারণে কয়লার সরবরাহ কমে দাম বেড়েছে।
আরেক আমদানিকারক যশোরের নওয়াপাড়ার সরকার ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী আবু সাঈদ সরকার বলেন, গত বছরের অক্টোবরের পর থেকেই কয়লার দাম বাড়ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম বেড়েছে। আবার দেশে এলসি খোলা যাচ্ছে না। ফলে দাম বেড়েছে।
প্রতিযোগিতা কমিশনের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কয়লার বাজার নিয়ে পর্যালোচনা চলছে। বড় বড় আমদানিকারকদের চিঠি দিয়ে ২০২১ সাল থেকে এ পর্যন্ত কোন দেশ থেকে কী পরিমাণ আমদানি, বিক্রি, মূল্যসহ বিভিন্ন তথ্য চাওয়া হয়েছে। আমদানিকারকরা এখনো তথ্য সরবরাহ করেননি। যে কারণে এখনই বলা সম্ভব হচ্ছে না যে, কয়লার বাজারে মজুতদারি বা সিন্ডিকেশন কাজ করছে কিনা। তবে এই বাজারটিতে এক ধরনের ধোঁয়াশা রয়েছে।
আমদানিকারকসহ সংশ্লিষ্টদের বারবার তাগাদা দিয়েও তথ্য উপাত্ত এবং অন্যান্য সহযোগিতা পাচ্ছে না প্রতিযোগিতা কমিশন। যে কারণে কমিশন মনে করছে, এ বাজারে অনিয়ম, অসাধুতা রয়েছে। আমদানিকারক, মধ্যস্বত্বভোগী ও ব্যবহারকারী এই তিন পর্যায়েই মজুত হয় বলে ধারণা করছে প্রতিযোগিতা কমিশন।
বাংলাদেশ ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, প্রতি টন কয়লার আমদানি খরচ ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা। কিন্তু কয়লা আমদানিকারকরা অস্বাভাবিক দাম নিচ্ছে। প্রতি টনের দাম নেওয়া হচ্ছে ২৯ থেকে ৩১ হাজার টাকা পর্যন্ত। যদিও সম্প্রতি কয়লার দাম কিছুটা কমেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ার কয়লা প্রতি টন ২৪ হাজার ৭০০ টাকা, দক্ষিণ আফ্রিকার কয়লা ২৭ হাজার, অস্ট্রেলিয়ার কয়লা ২৭ হাজার ৫০০ ও ভারতের কয়লা ২৪ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যদিও আমদানিকারকরা দাবি করেছেন আরও কম দামে কয়লা বিক্রি হচ্ছে। গতকাল প্রতি টন কয়লা মানভেদে ২২ থেকে ২৪ হাজার টাকায় বেচাকেনা হয়েছে।
ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারত থেকে প্রধানত বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা কয়লা আমদানি করেন। এর মধ্যে মোট আমদানির প্রায় ৬০ ভাগ আসে ইন্দোনেশিয়া থেকে। ২০ শতাংশ আমদানি হয় ভারত থেকে। দেশের প্রায় শখানেক আমদানিকারক কয়লা আমদানি করে থাকে। দেশের ইটভাটাগুলোতে প্রতিবছর প্রায় ৭০ লাখ টন কয়লার চাহিদা রয়েছে।