বিদ্যুৎ ও ডিজেলের দাম বৃদ্ধির বড় ধাক্কা লাগবে বোরো আবাদে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত বছরের তুলনায় এবার রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলায় কৃষকের বাড়তি খরচ হবে প্রায় ১৭২ কোটি টাকা। এ অবস্থায় কৃষি এবং কৃষককে টেকসই করতে এ খাতে ভর্তুকি দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা।
রংপুর আঞ্চলিক কৃষি অফিস জানিয়েছে, চলতি বোরো মৌসুমে এ অঞ্চলের পাঁচ জেলায় বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৭ হাজার ৫০ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে রংপুরে ১ লাখ ৩১ হাজার ৮০০, গাইবান্ধায় ১ লাখ ২৮ হাজার ৯৫০, কুড়িগ্রামে ১ লাখ ১৬ হাজার ৯০০, লালমনিরহাটে ৪৭ হাজার ৭০০ ও নীলফামারী ৮১ হাজার ৭০০ হেক্টর জমি। ইতোমধ্যে ১ লাখ ৩৫ হাজার ৭৭০ হেক্টর জমিতে বোরো রোপণ করা হয়েছে।
কৃষকরা জানান, গত বোরো মৌসুমে এক বিঘা (৩২ শতক) জমিতে উৎপাদন খরচ ছিল ১৪ হাজার ৯০০ টাকা। এ বছর তা দাঁড়াবে ১৯ হাজার ৪৫০ টাকায়। অর্থাৎ বিঘায় খরচ বাড়বে ৪ হাজার ৫৫০ টাকা।
জানা গেছে, গত মৌসুমে প্রতি বিঘা জমিতে সেচের খরচ ছিল ১২০০ টাকা, এবার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬০০ টাকা। বীজ প্রতি কেজি ছিল ২০০ টাকা, এবার ৩৫০ টাকা। জমি তৈরির ব্যয় ৯০০ থেকে ১৩০০ টাকা হয়েছে। সার খরচ ২০০০ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৫০০ টাকা। কীটনাশক ব্যয় ৬০০ থেকে ১০০০ টাকা হয়েছে। ধান রোপণ ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকা, ধান কাটা-মাড়াই ৩০০০ থেকে ৪০০০ টাকা হয়েছে। সঙ্গে যুক্ত হবে জমির ভাড়া ৫০০০ টাকা। সে হিসাবে গত মৌসুমে এক বিঘা জমিতে বোরো উৎপাদনের খরচ ছিল ১৪ হাজার ৯০০ টাকা। আর এ বছর তা দাঁড়াবে ১৯ হাজার ৪৫০ টাকায়। অর্থাৎ বিঘায় খরচ বাড়ছে ৪ হাজার ৫৫০ টাকা।
কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, রংপুর অঞ্চলে বিদ্যুৎচালিত গভীর সেচ পাম্প ৬২ হাজার ৭৫৩টি, অগভীর ২ লাখ ৪৯ হাজার ৭৭৪টি, ডিজেলচালিত গভীর সেচ পাম্প ৩৩২টি এবং অগভীর সেচ পাম্প রয়েছে ১৭ লাখ ২৭ হাজার ১৮টি। এ ছাড়া বিদ্যুৎচালিত গভীর-অগভীর সেচ পাম্পের সংখ্যা ৩ লাখ ১২ হাজার ৫২৭টি এবং ডিজেলচালিত সেচ পাম্পের সংখ্যা ১ লাখ ৭৩ হাজার ৩০টি। শুধু সেচেই কৃষকের ব্যয় বাড়বে প্রায় ১৬ কোটি টাকা। বোরো ধান সেচনির্ভর হওয়ায় উৎপাদন খরচের একটি বড় অংশ ব্যয় হয় সেচে।
রংপুর মহানগরীর ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা শেখ ওয়াজেদুল ইসলাম বলেন, এ এলাকায় প্রচুর আলুর আবাদ হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যে আলু উঠে যাবে। এরপর ওই জমিতে শুরু হবে বোরো চাষ; কিন্তু এবার সবকিছুর দাম অনেক। সে কারণে বাড়তি খরচও হবে।
কাউনিয়া উপজেলার কৃষক রহমত আলী বলেন, ‘এবার সার, বীজ, কীটনাশকের দামও বাড়ছে। কামলার দামও বেশি। মাঝেমধ্যে কামলা পাওয়াই যায় না। তা ছাড়া শুনছি বিদ্যুতের দামও বাড়বে। তাহলে কৃষক তো মরি (মরে) যাইবে। খরচ অনুযায়ী তো দাম বাড়বে না। দাম না বাড়লে এবার মরণদশা হবে।’
পীরগাছা উপজেলার তাম্বুলপুর ইউনিয়নের পরান এলাকার কৃষক আকরামুল ইসলাম বলেন, ‘হামার নিজের জমিজমা নাই। মাইনষের জমি আদি নিয়্যা আবাদ করি। গরু নাই দেকি ট্রাক্টর দিয়্যা চাষ করি। এ্যালাতো সোগেরে দাম বেশি। তাতে হামার মতো গরিব মাইনষোক চাষাবাদ ছাড়ি দেওয়া নাগবে।’
সরেজমিন দেখা গেছে, বীজ, সার, কীটনাশক ও শ্রমিকের দাম বাড়লেও বসে নেই প্রান্তিক চাষিরা। মাঘের শীতেও সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জমি প্রস্তুত করছেন তারা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, খরচ কমাতে কৃষকদের পরিমিত সেচ এবং নিয়ম মেনে সার ও কীটনাশক ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, বোরো চাষে অতিরিক্ত সেচ লাগে। সেচ দিতে যেন পানির অপচয় না হয়, সেজন্য আমরা কৃষকদের লক্ষ রাখতে বলছি। একই সঙ্গে সারের সুষম ব্যবহারে উৎপাদন যাতে বৃদ্ধি পায় তার জন্যও কৃষকদের নিয়মিত পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
কৃষক ও কৃষি নিয়ে কাজ করেন অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানি। তিনি বলেন, প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়েছে। মাঠ পর্যায়ে শ্রমিকের দামও বেড়েছে। তাই কৃষকের কৃষি উপকরণ নাগালের বাইরে। এ অবস্থায় সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের উচিত সরাসরি মাঠে গিয়ে তাদের একটি তালিকা করে বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করা। এভাবে প্রণোদনা না দিলে কৃষক উৎপাদন করতে আগ্রহ হারাবে।