
একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে সংলাপে দেওয়া ওয়াদা রাখা হয়নি উল্লেখ করে এবার সরকারের সঙ্গে বিএনপি আর সংলাপ করবে না বলে জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘পদত্যাগ করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে নির্বাচন দিন। তাতে যারা নির্বাচিত হবে, মাথা পেতে মেনে নেব।’
আজ মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। গতকাল সোমবার সংবাদ সম্মেলনে ‘সংলাপ কার সঙ্গে? ২০১৮-এর সংলাপের পর বিএনপি নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করেছে’—প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন বক্তব্যের জবাবে এ সময় এসব কথা বলেন ফখরুল।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, “প্রধানমন্ত্রী আরও কথা বলেছেন, যা একেবারে অসত্য, সত্যের অপলাপ। তা হচ্ছে যে, ২০১৮ সালের রেফারেন্স দিয়ে বলেছেন, ‘কার সঙ্গে কথা বলব।’ আমাদেরও কথা তাই। দেশের প্রধানমন্ত্রী, যেভাবেই আসুক, বৈঠকে (সংলাপ) সবার সামনে কমিটমেন্ট করেছেন, এই নির্বাচনে (একাদশ) সরকার কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। পুলিশ আর গ্রেপ্তার করবে না, কোনো মামলা দেবে না, নির্বাচন পর্যন্ত পুলিশি নির্যাতন হবে না। কিন্তু এর তিন দিন পর থেকে পুলিশি নির্যাতনে বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মী সব পালিয়ে গেছেন। ঘরে থাকতে পারেননি। আমি বিএনপির মহাসচিব। আমি আমার এলাকায় যেখানে গিয়েছি, সেখানেই আমার গাড়ির ওপর আক্রমণ হয়েছে। আমার কনভয়ের ওপর আক্রমণ হয়েছে। পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে। তারপর নির্বাচনের সাত-আট দিন আগে থেকে নতুন নতুন প্লট তৈরি করা হয়েছে। তারা যে নির্বাচনী অফিস তৈরি করেছিল, তাতে তারা নিজেরাই আগুন লাগিয়ে দিয়ে মামলা দিয়েছে বিএনপির নেতাকর্মীর নামে। তিন দিন আগে আমার যারা নেতৃস্থানীয় নির্বাচনকর্মী, তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমি ছিলাম ঠাকুরগাঁওতে। আমার বাসার চারদিকে বেষ্টনী তৈরি করা হয়েছে। সম্ভবত আমার নির্বাচনী এলাকায় দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পুলিশ ও এনএসআই, সিআইডি কর্মকর্তা গেছে—প্রতিটি কেন্দ্রে কেন্দ্রে। এই হচ্ছে আমার অবস্থা। আমি ঘর থেকে বের হতে পারিনি। আমাদের আলমগীর কবির সাহেব ঘর থেকেই বের হতে পারেননি। আমাদের ২১ প্রার্থীকে নির্বাচনের আগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মনিরুল হক চৌধুরী সাহেব জেল থেকে নির্বাচন করেছেন।’
ফখরুল আরও বলেন, ‘ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে আমরা গেলাম যে, সেখানেও এ ঘটনাগুলো ঘটছে। সেখানে চিফ ইলেকশন কমিশনার এমন দুর্ব্যবহার করলেন, ড. কামাল হোসেন টেবিল চাপড়ে বের হয়ে এলেন। আমরা বের হয়ে এলাম। এসবের পরেও যদি শেখ হাসিনা বলেন যে, হোয়াট ইজ দ্য রেজাল্ট...। রেজাল্ট ইউ নো, হোয়াট হ্যাভ ইউ ডান? তার পরে তিনি কী করে আশা করেন, তিনি সরকারে থাকবেন, আর এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন করবে? শুধু বিএনপি তো নয়, কেন অন্যান্য রাজনৈতিক দল বলছে, এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়া যাবে না। এমনকি সিপিবিও বলছে, এই নির্বাচনে যাওয়া যাবে না।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এ বিষয়গুলো যখন তিনি (প্রধানমন্ত্রী) বলেন, তখন চূড়ান্তভাবে সত্যের অপলাপ করেন, জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেন, জনগণকে বিভ্রান্ত করেন। এবং তিনি প্রচণ্ড রকম দাম্ভিকতায় ভুগছেন যে, গণতন্ত্রের যে মূল কথা, তা থেকে বাইরে চলে গেছেন।’
বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘আমরা তার সঙ্গে ডায়ালগ করব না। তিনি তো কথাই রাখেন না। আমরাও তো ডায়ালগের কথা বলিনি, একবারের জন্যও বলিনি। যারা দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করে জেলে দিয়েছে, তাদের সঙ্গে আমরা কী ডায়ালগ করব? ওই ধরনের মামলায় প্রত্যেকজনকে সাত দিনের মধ্যে জামিন দেওয়া হয়েছে। খালেদা জিয়াকে এখন পর্যন্ত জামিন দেওয়া হয়নি। এখন পর্যন্ত ওই নাটক চলছেই। একজন মন্ত্রী বলেন তিনি রাজনীতি করতে পারবেন, আরেকজন বলেন পারবেন না। একজন বলেন তিনি নির্বাচন করতে পারবেন না, আরেকজন বলেন পারবেন। এটা এক ধরনের প্রতারণা।’
তিনি বলেন, ‘আমার কথা পরিষ্কার। এতই যদি সাহস থাকে আপনাদের, এতই যদি উন্নয়ন করে থাকেন, জনগণ যদি আপনাদের সঙ্গে থাকে, তাহলে আপনারা রিজাইন করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা দিন। আপনারা নির্বাচন করুন। যে আসবে ক্ষমতায়, আমরা মাথা পেতে মেনে নেব।’
সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘এমন কোনো চাপ নেই, যেটি শেখ হাসিনাকে দিতে পারে। এটি মাথায় রাখতে হবে।’ এ প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তার ওপর কোনো চাপই কাজ করবে না। এ দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি তার যে কোনো দায়িত্ব নেই, তার যে কোনো সম্মান নেই, তার যে কার্যকর রাষ্ট্র করার চিন্তা নেই—তার এসব কথা থেকে বোঝা যায়। এ চাপগুলো পড়ছে কেন? প্রেশারগুলো পড়ার কারণ হচ্ছে—গত দুটি নির্বাচন করেছে একতরফাভাবে, তাদের ক্ষমতায় রাখতে যত রকমের ভোট জালিয়াতি, যত রকমের ভোট কারচুপি, যত রকমের সন্ত্রাস... সেই সন্ত্রাসের মাধ্যমে ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে বাধা দিয়ে, ভোটশূন্য রেখে ফলাফল ঘোষণা করে বেআইনিভাবে ক্ষমতায় গেছে আওয়ামী লীগ।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন আবার সামনে নির্বাচন আসছে। তারা যখন দেখছেন, তাদের সঙ্গে জনগণ নেই, যদি সত্যিকার অর্থেই সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, তাহলে তারা ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবেন না, ক্ষমতায় যেতে পারবেন না, এ কারণেই তারা যা করছেন, আগে থেকেই একটা অবস্থা সৃষ্টি করছেন যে আমাদের দেশের নির্বাচনের ব্যাপারে কেউ বাইরে থেকে হস্তক্ষেপ করবে না, কেউ কথা বলবে না। আমরা আমাদের মতো করে করছি। বিদেশিরা যারা যাচ্ছেন এবং বলছেন, আমরা একটা সুষ্ঠু নির্বাচন চাই, তখন তারা (সরকার) বলছেন—না, সব ঠিক আছে তো। নির্বাচন কমিশন আছে। তারা সুষ্ঠু নির্বাচন করবে। তারা ফ্রি, মুক্ত; তারা যা খুশি তা-ই করবে। গতকাল যে ব্রিটিশ মন্ত্রী গেলেন, তার আগে আরও একজন গেলেন, তাদের একই কথা বললেন।’
সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাইল জবিউল্যাহ, সমাজকল্যাণ সম্পাদক কামরুজ্জামান রতন প্রমুখ।