‘আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি, আমি ফিরেছি, আব্বু তুমিও ফিরে আসো।’ জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে কথিত হিজরতের নামে ঘরছাড়া এক কিশোরের মায়ের আকুতি এটা।
আম্বিয়া সুলতানা এমিলি নামে এক মা উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজের ১৫ বছর বয়সী একমাত্র সন্তানকে পাঠান কথিত ‘জিহাদ’ করার প্রশিক্ষণ নিতে। পরে ভুল বুঝতে পেরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন তিনি। এখন সন্তানকে ফিরে পাওয়ার আকুল আবেদন জানাচ্ছেন।
জঙ্গি সংগঠন ‘জামা’আতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র আরও তিন সদস্যকে গ্রেপ্তারের তথ্য জানাতে গতকাল বুধবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে সংস্থাটির মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে র্যাব। ওই সংবাদ সম্মেলনে হাজির করা হয় আম্বিয়া সুলতানা এমিলি ও তার স্বামীকে। তারা সেখানে সন্তানকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে আহ্বান জানান।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, ২০২১ সালের প্রথম দিকে গৃহশিক্ষক আল আমিনের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে সংগঠনে যোগ দেন এমিলি। এরপর ২০২২ সালের মার্চে ওই গৃহশিক্ষকের নির্দেশনায় এমিলি তার ছেলেকে কথিত হিজরতে পাঠান। গত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে পাহাড়ে প্রশিক্ষণের জন্য ওই কিশোরকে বান্দরবানে নেওয়া হয়। তাকে বান্দরবানে নিয়ে যাওয়া জঙ্গি রনিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আম্বিয়া সুলতানা এমিলি বেসরকারি ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের কেবিন ক্রু ছিলেন। খণ্ডকালীন দায়িত্ব পালন করেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সেও। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘গৃহশিক্ষক আল আমিনের মাধ্যমে তিনি জঙ্গিবাদে জড়িয়েছিলেন। এরপর ছেলেকেও পাঠান ভুল পথে।’
সম্প্রতি কথিত হিজরতের নামে অর্ধশতাধিক তরুণ ঘর ছাড়ে। বিষয়টি জানাজানি হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের উদ্ধারে তৎপরতা শুরু করে। র্যাবের পক্ষ থেকে ঘরছাড়া ৫৫ জনের তালিকা প্রকাশ করা হয়, তাতে এমিলির সন্তানও ছিল।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, নারায়ণগঞ্জের বাসা থেকে ওই কিশোর নিখোঁজ হওয়ার পর তার বাবা থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। কিন্তু তখনো তিনি স্ত্রী-সন্তানের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি জানতেন না। এমিলি স্বামীর কাছে তা গোপন করেন। পরে র্যাব নিরুদ্দেশ ৫৫ জনের তালিকা প্রকাশ করলে ওই কিশোরের তথ্য সামনে আসে। ৩ নভেম্বর র্যাব নতুন জঙ্গি সংগঠনটির মহিলা শাখা সম্পর্কে তথ্য পেয়ে এমিলিকে শনাক্ত করে। গত ৫ নভেম্বর তাকে র্যাব হেফাজতে নিলেও তার ভুল বুঝতে পারায় পরিবারের জিম্মায় দেওয়া হয়।
র্যাবের একজন কর্মকর্তা দৈনিক কালবেলাকে জানান, র্যাব পাহাড়ে জঙ্গি আস্তানায় অভিযান শুরু করলে এমিলি ছেলের চিন্তায় হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। ভুল বুঝতে পেরে অনুশোচনা করতে থাকেন। পরে র্যাব সদস্যরা তার সন্ধান পেলে সন্তানকে ফিরে পেতে ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং নিজের ভুল শিকার করেন।
সংবাদ সম্মেলন থেকে সন্তানের উদ্দেশে এমিলি বলেন, ‘আব্বু তুমি যদি আমার মেসেজ পেয়ে থাকো, তাহলে বলছি তুমি চরম ভুল পথে আছ। তুমি তোমার এ মাকে বিশ্বাস করতে পার। তোমার কাছে আমার অনুরোধ, তুমি যদি কখনো মাকে ভালোবেসে থাকো, তাহলে দেশের জন্য কোনো ধরনের হুমকির কাজ করবে না, বিশৃঙ্খলা করবে না। আমি অনুরোধ করছি তুমি আত্মসমর্পণ করো। প্রশাসন সদয় হবে।’
এমিলি বলেন, চরম একটা ভুল পথ সঠিক মনে করে সন্তানকে দিয়েছিলেন। হয়তো তার আদরের সন্তান বান্দরবানে পাহাড়ে অর্ধমৃত অবস্থায়। তিনি জানেন না, সন্তান বেঁচে আছে কিনা। জানেন না, কখনো তাকে আর দেখতে পারবেন কিনা। মা হিসেবে চরম ব্যর্থতা স্বীকার করে বলেন, ‘শিক্ষিত মেয়ে হয়ে আমি বুঝতে পারিনি। বুঝতে পারিনি কোনটা সঠিক, কোনটা ভুল। আমার কোরআন-হাদিসের দক্ষতা কম ছিল। আমাকে ও আমার ছেলেকে ভুল পথে নেওয়া হয়েছে।’
এর আগে মঙ্গলবার রাতে নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড থেকে নতুন জঙ্গি সংগঠনটির অন্যতম অর্থ সরবরাহকারী আব্দুল হাদি সুমন ওরফে জন, আবু সাঈদ শের মোহাম্মদ এবং রনি মিয়াকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। জন ও আবু সাঈদ সংগঠনটির অর্থ সংগ্রহ করত আর রনি ঘরছাড়া তরুণদের বান্দারবানে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বে ছিল বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।